৩ মার্চ, ১৯৭১ঃ এক নজরে এদিন
সর্বাত্মক হরতাল
শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় সারাদেশে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়।
বিক্ষোভ বা কারফিউ লঙ্ঘনের দায়ে ১-৩ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ২৩ জন নিহত হয়েছে। প্রায় দুই শতাধিক আহত হয়েছে এর মধ্যে ১২১ জন ঢাকা মেডিকেল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে ৯০ জন গুলিবিদ্ধ। ৪০ জনের অবস্থা গুরুতর। যে সকল এলাকায় গুলিবর্ষণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক, আদমজী, মালিবাগ, রামপুরা, আলুবাজার, ঢাকা স্টেডিয়াম, রাম কৃষ্ণ মিশন রোড, বংশাল রোড, ভজ হরি সাহা স্ট্রীট, কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টার, ফার্মগেট, গ্রিন রোড, ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, টিকাটুলি, ইত্তেফাক মোড়, দৈনিক পাকিস্তান মোড়, নিউমার্কেট, এলিফেনট রোড। সবচে বেশী হতাহত হয় বাহাদুর শাহ পার্কে। এখানে মেশিন গানের গুলিবর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেনাবাহিনীর গুলিতে ছাত্রলীগ নেতা ফারুক নিহত।
আবুজর গিফারি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ও কলেজ ছাত্র সংসদ জি এস ফারুক রামপুরা নির্মীয়মাণ টেলিভিশন কেন্দ্রের সামনে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তার নেতৃত্ব এ একটি মিছিল দুপুরে এখানে আসে তাদের মিছিল অনুসরণ করে সেনাবাহিনীর একটি জীপ। ব্যারিকেড থাকায় জীপটি সামনে এগুতে পারছিল না। এই জীপের আরোহী তাকে একবার ডেকে নেয় এবং ফারুক ফিরে আসতে থাকে এর মধ্যেই গুলির আওয়াজ এবং সেই গুলিতেই ফারুকের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পরে। নিহত ফারুককে সহকর্মীরা এলাকায় নিয়ে আসে এবং কলেজে জানাজার পর মৌচাক মোড়ের আইল্যান্ডে দাফন করে। ফারুকের বাড়ী ৬৯ এর গন অভ্যুত্থানে নিহত আসাদের বাড়ীর কাছেই। আসাদের সাথে একত্রে আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল।
রংপুর কারফিউ
রংপুরে পাক সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দুপুর আড়াইটা থেকে ২৪ ঘন্টাব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকায় কারফিউয়ের মেয়াদ শিথিল করে রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।
খুলনায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে।
পল্টনে ছাত্রলীগ শ্রমিক লীগের যৌথ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ
শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে পল্টনে ছাত্র শ্রমিক সমাবেশে প্রস্তাব পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এম এ রশিদ। স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগ সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ।সভায় বক্তব্য দেন শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সাধারন সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং শ্রমিক লীগ সাধারন সম্পাদক আব্দুল মান্নান এমএনএ।
নোটঃ প্রেস সেন্সরশিপের কারনে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠের বর্ণনা কোন পত্রিকায় প্রকাশ হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের মুখপাত্র পিপলও তা ছাপেনি।
চারুবালার মৃত্যুতে যশোরে চরম উত্তেজনা
যশোর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এ মোতায়েন সশস্র রক্ষীদের গুলিবর্ষণে চারুবালা কর নামে এক মহিলার মৃত্যু হয় এবং ১২ জন আহত হয়। একটি মিছিল যখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অতিক্রম করছিল তখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এর ছাদ থেকে মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে এ হতাহত হয়। চারুবালা তার বাড়ীর আঙ্গিনায় বসা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাকে যশোর হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি সেখানে মারা যান। গোলা গুলির পর প্রায় ২৫০০০ লোকের এক মিছিল শহীদ চারুবালার লাশ নিয়ে মৌন মিছিল সহকারে নীলগঞ্জ শ্মশানঘাটে উপনীত হয়। শহরে প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করছে।
দাঙ্গায় চট্টগ্রামে শতাধিক নিহত
কিছু গুজবকে কেন্দ্র করে বিহারী বাঙালি দাঙ্গায় শতাধিক বেক্তির প্রানহানি ঘটেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৭১ টি বুলেটবিদ্ধ লাশ আনা হয়েছে। সেখানে আহত দুই শতাধিক জন চিকিৎসাধিন আছেন। আহতদের বেশির ভাগই বুলেটবিদ্ধ, কেউ কেউ এসিড দগ্ধ। নগরীর পাহাড়তলি, টাইগার পাস, ফিরোজ শাহ কলোনী, ভিক্টরী জুট মিল, ইস্পাহানী জুট মিলের কাছে এই দাঙ্গা সংগঠিত হয়।
লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসমাবেশে দলের সাধারন সম্পাদক এমএ হান্নান বলেন কারফিউ জারী না করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন জঙগণই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে। তিনি বলেন জনগনের লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামকে বানচালের উদ্দেশে নগরীর বিভিন্ন স্থানে উস্কানিদাতারা আইন শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যকলাপের উস্কানি দিচ্ছে। তিনি সকল প্রকার উস্কানির মুখে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান। তিনি আজকের মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করে বলেন শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন এবং জনগনের উপর সরকারের কোন মহল আক্রমন চালাবে বলে এক গুজব প্রচারিত হওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে অনেক নির্দোষ মানুষের প্রাণহানি ও অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। তিনি শেখ মুজিবের বিবৃতির উল্লেখ করে বলেন যারা এখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে তারাও বাঙ্গালী। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম আর সিদ্দিকি। এম আর সিদ্দিকি হুমকি দিয়ে বলেন শেখ মুজিবকে গ্রেফতার ঘৃতাহুতির সামিল হবে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দুই এমএনএ প্রহৃত
রাত্রে বাড়ী ফেরার পথে মালিবাগের কাছে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত এমএনএ আব্দুল মান্নান এবং ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমএনএ আশরাফ আলী চৌধুরী (প্রখ্যাত ধারা ভাষ্যকার শামিম আশরাফ চৌধুরীর পিতা) আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রহৃত হন। তারা ঘটনাস্থলে পৌছলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন জওয়ান তাদের ব্যারিকেড সরাতে বলে তারা তাদের নিজেদের পরিচয় দেয়ার পর তারা তা বিশ্বাস না করে তাদের মারধর করতে থাকে। মারের আঘাতে মান্নান এর পীঠে রক্তাক্ত জখম হয়। তাকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। আশরাফ চৌধুরী সামান্য আহত হন।
গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে অলি আহাদ
বাংলা ন্যাশনাল লীগ প্রধান অলি আহাদ এক বিবৃতিতে গতকাল সন্ধায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছন। তিনি বলেন সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধিকারের আওয়াজকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্তব্দ করে দেয়ার জন্য স্বৈরাচারী ক্ষমতাসীন মহল যে দমন নীতির পথ অনুসরণ করেছেন তা জাতীয় জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে বাধ্য। এই স্বৈরাচারী জুলুমের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন আমরা তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং দেশ বাসীর প্রতি আহবান জানাই শহীদানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরাচারী জুলুমের বিরুদ্ধে অজেয় প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে। তিনি বলেন স্বৈরাচারী জুলুম যতই শক্তিশালী হোক না কেন চূড়ান্ত সংগ্রামে জনগন জয়ী হবেই।
বাংলা জাতীয় লীগ আজ দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গতকালের হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানান এবং আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে স্বাগত জানান। সভায় দলের সাধারন সম্পাদক অলি আহাদ বক্তব্য রাখেন।