২ মার্চ ১৯৭১ আজকের এদিনে
আন্দোলন
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সংবাদে ঢাকার মানুষ প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়ে। সান্ধ্য আইন সত্ত্বেও সারাদিনের হরতালে ঢাকা নগরী মিছিলের নগরীতে পরিনত হয়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। যানবাহন ও এম্বুলেন্স এর অভাবে আহতদের হাসপাতালে নিতে বেগ পেতে হয়। বিক্ষোভকারীরা লাঠি, রড, ইট ইত্যাদি বহন করে এবং বিভিন্ন স্থানে আক্রমন করে। শালিমার হোটেল ও গুলিস্তান সিনেমা হল ভাংচুর করা হয়। জনতা নারায়নগঞ্জ এর গাউসিয়া জুট (বাঙালি মালিক) মিলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এদিন মাঝ রাত পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যালে ২ জনের লাশ এবং বুলেট বিদ্ধ ৬৮ জনকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে আহত একজন পরে মারা যায়। মিটফোর্ড হাসপাতালে ৯ জনকে ভর্তি করা হয়। আন্দোলনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে সারাদিন একটি হেলিকপ্টার ঢাকার আকাশে ঘুরে বেড়ায়।
ঢাকা শহরে কারফিউ জারী
সামরিক উপ প্রশাসক কর্নেল চৌধুরী মুজাফফর আলী খান জাহিদির বরাত দিয়ে ঢাকা বেতার মারফত ঢাকা শহরের ৭ থানায় রাত ৯ টা থেকে পরদিন সকাল ৭ টা পর্যন্ত কারফিউ জারির ঘোষণা করা হয়। লুটতরাজ বন্ধের জন্য এই কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে বলে প্রেস নোটে জানানো হয়। পরদিন থেকে এই কারফিউ সন্ধ্যা ৭ টা থেকে পরদিন ৭ টা পর্যন্ত বলবত থাকবে। কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র–জনতা ও শ্রমিকেরা কারফিউ–এর বিরুদ্ধে প্রবল শ্লোগান তুলে কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। তাদের শ্লোগান ছিল– “সান্ধ্য আইন মানি না”, “জয় বাংলা”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। সমস্ত শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড রচনা করা হয়। ডি.আই.টি এভিনিউর মোড়, মনিং–নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে নয়টায় সামরিক বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। বিরাট এক জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্ণর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলি চালানো হয়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চলে।
খুলনার শহর খালিশপুর দৌলতপুর এলাকায় আজ সান্ধ্য আইন জারী করা হয়।
ছাত্রলীগের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন
সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত( কলা ভবনের গাড়ী বারান্দা শেড এর উপর স্টেজ করা হয়) ঐতিহাসিক ছাত্রসমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা আ.স.ম. আবদুর রব। সঙ্গে ছিলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং নূরে আলম সিদ্দিকী। বিশাল এই সভাতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। সভার শুরুতে সমবেত ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করে। সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানের মাঝমাঝি সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই সভায় পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয়। সভায় কায়েদে আজম মুর্দাবাদ, বুত্তর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো প্রভৃতি পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান দেয়া হয়। সভা শেষে তোফায়েল আহমদ এর নেতৃত্ব এ এক বিরাট শোভাযাত্রা স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোকাররম গমন করে।
পলটনে ওয়ালী ন্যাপ এর জনসভা
পলটন ময়দানে বিকেল ৩ টায় ওয়ালী ন্যাপ এর এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জন সভায় ৬ হাজার লোকের এক জঙ্গি মিছিল যোগ দেয় যারা প্রায় সকলেই লাঠি রড ইত্যাদি নিয়ে মিছিল করে। মিছিল কারীরা সশস্র বিপ্লবের স্লোগান দেয়। প্রাদেশিক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ এর সভাপতিত্তে অনুষ্ঠিত এ সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আব্দুল হালিম, সাইফুদ্দিন মানিক, ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম নাহিদ। নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগনের প্রতি আহবান জানান। (মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতা ইমেজে দেখুন)
জাতীয় লীগের জনসভা
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে জাতীয় লীগ আতাউর রহমানের সভাপতিত্তে বায়তুল মোকাররমের কাছে জনসভা করে। সভায় বক্তৃতা করেন দলের সাধারন সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান, আমেনা বেগম, সাংগঠনিক সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী। শাহ আজিজুর রহমানের বক্তৃতার পর আমেনা বেগম ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ মুজিবের সমালোচনা করা শুরু করলে উত্তেজিত জনতা সভায় হামলা চালায়। মঞ্চ থেকে আতাউর রহমান, শাহ আজিজ বার বার মাইকে ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও জনতা শান্ত হয়নি। ফলে আমেনা বেগমকে বায়তুল মোকাররম মসজিদে লুকানো হয়। সেখানেও জনতা হামলা করার চেষ্টা করলে আমেনা বেগমকে সেখান থেকে গোপন পথে সরিয়ে নেয়া হয়।