You dont have javascript enabled! Please enable it!

এম. হােসেন আলী
মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা (ধারাবাহিক পর্ব)
::::::::::::::::::::::::
নয়াদিল্লিস্থ দূতাবাসের কে, এম, শেহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হকের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ঘােষণার ঠিক ১২ দিনের মাথায় ঘটল আরেক অনিবার্য চমকপ্রদ ঘটনা, যেটার গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল আরও বহুবিস্তৃত। কেননা শেহাবুদ্দিন ও আমজাদ- দু’জনই ছিলেন, কম বয়সী ও নিম্নপদের কর্মকর্তা। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৮ই এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পাকিস্তান কূটনৈতিক ভাগ্যাকাশে এমন মহাদুর্যোগের ঘন ছায়াপাত অঙ্কিত হলাে, যা পাকিস্তান সরকারকে গভীর চিন্তিত ও (পৃষ্ঠাঃ ১৮৬) উদ্বিগ করে তুলল। এই তারিখে কলকাতাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার এবং তার নেতৃত্বে আরও ৫ জন- সব মিলিয়ে ৬ জন বাঙালি কর্মকর্তা একযােগে পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করেন। বলা যায় গােটা হাইকমিশন ভবনটিই নিজেদের বজ্র কব্জায় নিয়ে ফেলেছিলেন তারা। এপ্রসঙ্গে এইচ. টি. ইমামের ভাষ্য প্রণিধানযােগ্য। তাঁর ভাষায়: “মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরদিন অর্থাৎ এপ্রিলের ১৮ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ- সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়।.. এপ্রিলের ঐ দিনগুলি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। দিনগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল ১৮ এপ্রিল, যেদিন কোলকাতাস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের অধিকাংশ কর্মকর্তা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। অবশ্য এর আগে দিকনির্দেশনা দেন তৎকালীন তরুণ পি,এফ,এস, (Pakistan Foreign Service) অফিসার কে. এম. শেহাবুদ্দিন-দিল্লীর পাকিস্তান-দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। এ দূতাবাসের সহকারী প্রেস সেক্রেটারি আমজাদুল হক ও শেহাবুদ্দিন ৬ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের প্রবীণ কূটনীতিবিদ ডেপুটি হাই কমিশনার, এম. হােসেন আলীর নেতৃত্বে বাঙালিরা কার্যত ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিস দখল করে নেন। এই ঘটনার পর বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের ন্যায় সাজানাে-গােছানাে অবস্থায়ই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্থাপনের জন্য তাৎক্ষণিক স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের।
জনাব ইমাম লিখেছেন: “ঐ ভবনেই আরম্ভ হয় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। প্রথমদিকে কোলকাতার কর্মকর্তাবৃন্দ বেশ দ্বিধাগ্রস্তছিলেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার পর তারা আর পেছনে তাকাননি।.. প্রধানমন্ত্রী, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং আমরা যে-পরিবেশে কাজ করতাম সে-তুলনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত একটি ভবন পাওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক সুষ্ঠু কাজ করার সুযােগ পেয়েছিল।”৯
জনাব এম. হােসেন আলীর সঙ্গে এসময় আরও যারা পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে জন্মভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তারা হলেন- আর, আই. (রফিকুল ইসলাম) চৌধুরী (প্রথম সচিব), ১৯৬৫ সাল- ব্যাচের পিএফএস আনােয়ারুল করিম চৌধুরী (তৃতীয় সচিব), ১৯৬৪-র এক্স-সিএসএস (সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস) কাজী নজরুল ইসলাম (তৃতীয় সচিব), এম. মাকসুদ আলী (সহকারী প্রেস অ্যাটাশে) এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট সাইদুর রহমান (নন-ডিপ্লোম্যাটিক অফিসার)।
এখানে উল্লেখ্য, ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলী তাঁর পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগের পাশাপাশি নিজেকেই ‘হাইকমিশনার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বাস্তবে তার এ ঘােষণা যুগপৎ যে কতটা ঝুঁকিবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তা বােঝা যায়, (পৃষ্ঠাঃ ১৮৭) সদ্যগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তখনও কমনওয়েলথ ভুক্ত হয়নি বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি, অথচ তিনি নিজেকে হাইকমিশনার দাবি করে বসেন। তবে ঠিক বেঠিক যাই হােক, এ কথা অস্বীকার করার কোনােই উপায় নেই যে তাঁর এই দৃঢ়চেতা, সাহসী ও আর পেছনে না ফেরা কাজ পরবর্তীকালে অন্যদেরকেও অনুরূপ ভূমিকা গ্রহণে সাতিশয় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
অরুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন: “The Bangladesh Mission in Calcutta was the nerve centre of external relations, including relations with India. The defections of Bengali diplomats and non-diplomats abroad were announced from this Mission as was the news of important development./ .. The Foreign Office, located at the Bangladesh Mission, became somewhat exclusive. It was alleged that officers were discouraged from keeping contact with the Bangladesh Cabinet and that files of the Foreign Ministry were not sent to the Prime Minister. The climax came when Hussain Ali declared himself the High Commissioner for Bangladesh in India; this was taken exception to by the Bangladesh Prime Minister and the Cabinet. It did sound premature since Bangladesh had not joined the Commonwealth and Ali had no right to the appellation of High Commissioner.”১০
এপর্যায়ে কলকাতা মিশনপ্রধান (তখন পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন মূলত মাহবুবুল আলম চাষী, পিএফএস) এম. হােসেন আলীর তখনকার দাপ্তরিক দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বাইরে আরও যে অনেক ধরনের ভূমিকা পালন করতে হতাে, সেসম্বন্ধে একটু জানিয়ে তার প্রসঙ্গ আলােচনা শেষ করব। যেমন, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তদানীন্তন স্বাস্থ্যবিভাগীয় মহাপরিচালক (Director General of the Health Service of Bangladesh) টি, (তাজুল) হােসেন এর সম্পর্কে লিখেছেন: “..In those days, because the residence of the former Pakistani Deputy High Commissioner in India was a spacious one and the legitimate inheritance of Bangladesh Mission, it made the most comfortable place one could stay in in (sic) Calcutta../ Mr Hossain Ali used to console everyone throughout that time. Many fine men came from many directions and Hossain Ali’s place was the only meeting ground for all those people./ One day, at my suggestion and K.K. Sinha’s initiative, Hossain Ali was invited to speak at the South Calcutta Rotary Club. I went with Syed Abdus Sultan to listen to Mr Hossain Ali(‘s) speak. Syed Saheb was the President of Mymensingh Rotary Club and, as such, he was given a respectful introduction. Mr Hossain Ali delivered a very remarkable speech that night and answered many tricky (পৃষ্ঠাঃ ১৮৮) questions the people had in mind at the time. His speech was in the newspapers the next morning.” ১১
আগেই বলেছি, কে, এম, শেহাবুদ্দিন, আমজাদুল হক ও এম হোসেন আলী- এই ত্রয়ীর পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য বাঙালি কূটনীতিক এবং তাঁদের জুনিয়র সহকর্মীদেরও বিপুলভাবে উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করেছিল সময়ের তাগিদে প্রকৃত মাতৃভূমিপ্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। বলা যায় সেটা ছিল শুরু মাত্র, যার সূতিকাগার দিল্লি-কলকাতা তথা ভারত থেকে, পরে তা সমগ্র দুনিয়ায় প্রসারিত হয়েছিল।
এপ্রসঙ্গে মােঃ শামসুল হক চিশতীর বক্তব্য উদ্ধারযােগ্য। তিনি বলেন: “পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ একের পর এক বাঙালিদের মনে আশার বাণী বয়ে আনতে থাকল। এসবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১), কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলীর নেতৃত্বে সমস্ত বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একযােগে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং ওয়াশিংটন দূতাবাসের এনায়েত করিম, এস, এ, এম, এস, কিবরিয়া, এ. এম. এ. মুহিত, আতাউর রহমান চৌধুরীসহ প্রায় আধা ডজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তার বাংলাদেশ সরকারে যােগদান। এরপর প্রায়ই বিভিন্ন দূতাবাস থেকে ধীরে ধীরে বাঙালি কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগের খবর আসতে লাগল। এসব খবর রেডিও পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের পত্রিকায় প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং বি, বি, সি’র মাধ্যমে এসব খবর পেতাম।”১২ প্রকৃতই কঠোর সেন্সরশিপের যাতাকলে পিষ্ট তৎকালীন পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকায় এসব খবর তখন খুব কম প্রকাশিত হতাে। তবে ভারতীয় ও অন্য সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা ঠিকই আলাের মুখ দেখত।
কাজেই এবারে আমরা দেখব, এই প্রক্রিয়ায় আরও যারা স্বদেশমুক্তির মিছিলে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের কে, কোথায়, কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং তাঁদের ভূমিকা কীরূপ ছিল? তবে এখানে এঁদের বহুবিধ কীর্তি- কর্মকে যদি একত্র করে বলা হয়, তবে তা এইচ. টি. ইমামের কথায় বলা চলে এভাবে: “বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরােপে অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনমত সৃষ্টির কাজ করেছেন; সরকারের ভিতরে এবং বাইরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্বকে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবির যৌক্তিকতা এবং পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে কী নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসতাণ্ডবে লিপ্ত সেটা বােঝাতে পেরেছিলেন। এর পাশাপাশি ছিল প্রচারমাধ্যম যেমন, সংবাদপত্র, রেডিও, টি.ভি., আলােচনা, জনসমাবেশ, দৈনন্দিন মিছিল ইত্যাদি।”১৩
(পৃষ্ঠাঃ ১৮৯)
নিয়মিত বা পেশাগত কূটনীতিকরা ছাড়াও অর্থাৎ তাদের বাইরে এর মধ্যে প্রবাসী সর্বস্তরের বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙালিদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত এ কথা তাই যথার্থই উচ্চারিত হয়েছে যে, “বস্তুত প্রবাসী বাঙালিরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচাইতে বড় প্রচার আর দূতিয়ালী করেছেন।”১৪
:::::::::::::::
Reference:
মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা
https://www.youtube.com/watch?v=EgwoU5Ndpsw

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!