You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। পূর্ব বাংলা কি এতে খুশী হয়েছিলো?

এরপর ছাত্র আন্দোলনের ধারা একটু একটু সক্রিয় হয়ে উঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ের বিতর্ককে কেন্দ্র করে।

১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংস্কার প্রবর্তন করেন। এতে ব্যাপকভাবে ছাত্রবেতন বাড়ানোসহ বিশ্ববিদ্যলয়ের যাবতীয় কার্যাবলীকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের আওতাধীন করা হয়। ভারতীয় মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশকে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। ২৬

একই সময়ে বঙ্গভঙ্গ বিষয়টিও বঙ্গদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বঙ্গকে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ (ঢাকা ও কলকাতাকে কেন্দ্র করে) এই দুই ভাগে বিভক্ত করায় কলকাতা বেশ সরগরম হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মুসলিমপ্রধান অঞ্চল ঢাকা থাকে ঠিক সমভাবেই নীরব। কারণ পূর্ববঙ্গের জনগণের কাছে ঢাকাই ছিল তার কেন্দ্রস্থল। মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গ অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগসুবিধা লাভের আশায় এতে মৌন সমর্থন জানায়। তবে এ বিভক্তির পেছনে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রমূলক মহাপরিকল্পনা ছিল। সে সময়ের একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী রিজলি মন্তব্য করেনঃ

ঐক্যবদ্ধ বাংলা ইংরেজের পক্ষে একটি বিপদজনক শক্তি; বিভক্ত হলে বাংলাদেশ আর আমাদের তেমন বিপদে ফেলতে পারবে না।২৭

সেই লক্ষ্যে ১৯০৫ সালের ১৬ আক্টোবর ইংরেজ সরকার বাংলাদেশকে দু-ভাগে ভাগ করে দেয়।

পূর্ববাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করলেও বিশিষ্ট মুসলমান রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা আবদুর রসুল (পরে ব্যারিস্টার), আবদুল হালিম গজনবী (পরে স্যার), মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মৌলবী কাজিম আলী (চট্টগ্রামের কাজিম আলী মাস্টার), সিরাজগঞ্জের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বর্ধমানের আবুল কাসিম, মজিবুর রহমান (দি মুসলমান পত্রিকার সম্পাদক), মাওলানা আকরম খাঁ (আজাদের সম্পাদক), ড, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পাটনার সৈয়দ আলী ইমাম ও হাসান ইমাম (দুই ব্যারিস্টার ভাই), ব্যারিস্টার মজহারুল হক, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।

বঙ্গদেশের এই মুসলমান নেতারা নানা কারণেই এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল, বঙ্গভঙ্গের ফলে বঙ্গদেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় এই দেশে বাংলাভাষাভাষী লোকেরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। কারণ পূর্ববাংলার সব কয়টি জেলা (দার্জিলিং বাদে সমগ্র উত্তরবঙ্গ এবং আসামকে নিয়ে নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হয়। অন্যদিকে পশ্চিমবাংলা, বিহার, উতা নিয়ে অন্য একটি প্রদেশ গঠিত হয়। আসাম ছোট অঞ্চল। লোকসংখ্যা কম ছিল বলে পূর্ববাংলা সিলেট, কাছাড় এবং রংপুরের কিছু অংশ আসাম অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে পশ্চিমবাংলার বিহারউড়িশী যোগ দেওয়ায় এবং পূর্ববাংলা ভাগ আসাম যোগ দেওয়ায় বাংলাভাষী মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং দুই অংশেই তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। একই সাথে অভিন্ন বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিও ভাগ হয়ে যায়। রাজনীতি তো ভাগ হয়েছিলই।

পূর্ববাংলার সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বঙ্গভঙ্গে খুশি হয়েছিল এই কারণে যে, নতুন প্রদেশের রাজধানী হয়েছিল ঢাকায়। কলকাতার তুলনায় ঢাকায় চাকুরি ও ব্যবসার অধিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি অযাচিত কিছু ছিল না। তবে পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জমিদাররা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এই ভয়ে যে, হয়তো পূর্ববাংলায় জমিদারি প্রথাই বিলোপ হয়ে যাবে। জমিদারি প্রথার শোষণ ও নির্যাতনে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তবে ঢাকার নবাবরা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন দুটি কারণে, প্রথমত ব্রিটিশরা তাদের এইজন্যে ঘুস দিয়েছিল এবং দ্বিতীয়ত ঢাকা রাজধানী হলে তাদের কর্তৃত্ব বেড়ে যাবে সঙ্গত করণেই।

কলকাতায় এক বিরাট প্রতিবাদ সভায় বঙ্গভঙ্গ না-মানার প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ। ছাত্রসমাজ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্ররা রাখী পূর্ণিমার দিনে রাস্তায় নেমে সকলের হাতে ঐক্যের প্রতীক ‘হলদে সুতোর রাখী’বেঁধে দেয়।

আন্দোলনের চাপে সরকার শেষপর্যন্ত বাঙলা ভাগের সিদ্ধান্ত ১৯১১ সালে বাতিল করেন। কিন্তু এতে পূর্ববাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তশ্রেণী রুষ্ট হন। কারণ ঢাকাকে রাজধানী করে এই এলাকায় যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাওয়ার কথা ছিল তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল। সিদ্ধান্ত বাতিলে সবচেয়ে বেশি রুষ্ট হয়েছিল আসলে ঢাকার

নবাবরা। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে—এক, ঢাকা আর রাজধানী থাকল না (যাতে তাদের আরো প্রতাপ ও প্রতিপত্তি বাড়ার সম্ভাবনা ছিল) ; দুই, হিন্দুদের কাছে তারা নিজেদের এ ব্যাপারে পরাজিত মনে করছিল। তবে ব্রিটিশ সরকার নবাবদের খুশি রাখার জন্য সলিমুল্লাহকে নানা ধরনের খেতাবে (জি. সি, এস, আই, জি. সি. আই. ই.) ভূষিত করে উৎকোচ প্রদান করতে থাকে। নবাব সলিমুল্লাহকে অবশ্য বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করতেও ব্রিটিশরা উৎকোচ দিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল নবাবরা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করার বিনিময়ে ব্রিটিশদের থেকে চৌদ্দ লক্ষ টাকা পাবেন তাদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য। অবশ্য নবাবরা নবাব উপাধিটি এরকম অবৈধ পথেই পেয়েছিলেন। সিপাহিদের নেতৃত্বে যখন বিদ্রোহ হয়েছিল তখন তাদের দমনে সাহায্য করার উৎকোচ স্বরূপ ব্রিটিশরা পূর্বপুরুষ আবদুল গণিকে নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

অবশ্য সিদ্ধান্ত বাতিলের সম্ভাব্য পাল্টা প্রতিক্রিয়া রোধ করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই ভিত্তিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

Reference:

২৪        সুপ্রকাশ রায় : ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (কলিকাতা : ডি এন বি এ

ব্রাদার্স, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮০) পৃষ্ঠা ৩২।

২৫       Ambika ch. Mazumder : Indian National Revolution. p. 274.

সুপ্রকাশ রায়ের পূর্বোক্ত প্রস্থে উদ্ধৃত

২৬       ভারতবর্ষের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৪৯৫ ২৭ গৌতম চট্টোপাধ্যায় : পূর্বোক্ত

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস – ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ ড মোহাম্মদ হান্নান

Unicoded by Kazi Rajib

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!