You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাংলার সশস্ত্র বিদ্রোহের কালপঞ্জি
যা মূলত ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সগ্রামের পটভূমি হিসেবে কাজ করে :
১। কৈবর্ত বিদ্রোহ : পাল আমল (অষ্টম শতক)। সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কৃষকের ক্ষমতা দখল।
২। সন্দ্বীপ বিদ্রোহ (১৭৬৪), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), বাকেরগঞ্জ বিদ্রোহ (১৭৯২), এবং এই সময়কার উপজাতীয় বিদ্রোহ।
এ বিদ্রোহ ও সংঘর্ষগুলির কারণ ছিল মূলত আঞ্চলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে।
৩। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩–১৮০০), সিলেট বিদ্রোহ (১৭৮২-১৭৯৯), কুমিল্লার ফিরিঙ্গি খেদাও বিদ্রোহ (১৮৯৭)।
এ প্রতিরোধ আন্দোলনগুলির পটভূমি ছিল ধর্মীয় কারণ। কিন্তু পরে তা জনপ্রিয় গণবিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়।
৪। ১৭৬৭ সালে সিলেট-ত্রিপুরা জেলার রোশনাবাদ পরগণায় কৃষক বিদ্রোহ ও তাদের স্বাধীন প্রলেতারিয়েত রাজ্য প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য ঘটনা।
জমিদারের অন্যায় অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে ক্রীতদাস সমশের গাজী এই অঞ্চলের যুবক-কৃষকদের সংগঠিত করে সশস্ত্র বিদ্রোহের আয়োজন করতে থাকেন। হিন্দু, মুসলমান যুবক ও কৃষকরা সমশের গাজীর বাহিনীতে দলে দলে যোগদান করেন এবং সম্মুখসমরে স্থানীয় জমিদারকে পরাজিত করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
নোয়াখালি জেলার গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, সমশের গাজী তাঁর স্বাধীন রাজ্যে গরিব ও মেহনতি ভূমিহীনদের মধ্যে বিনামূল্যে জমি বণ্টন করেছিলেন এবং গরিব জনগণের কর-খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন।১১ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ঘটনা অবিস্মরণীয় স্মৃতিবাহী।
৫. ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বিদ্রোহ এবং তার পূর্ববর্তী কৃষক প্রতিরোধ (১৮২৪ ১৮৩৩)।
৬. সুসং বিদ্রোহ (১৮২৪), নেতা টিপু শাহ
৭. ফরায়েজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন (১৮৩১), নেতা তিতুমীর (১৮২৭),
ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে সশস্ত্র যুদ্ধ হয় তাঁর নেতৃত্বে।
৮. তুষখালী বিদ্রোহ (১৮৫৮-১৮৭৫)
৯. নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬১।
১০. পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭৩)।
উপরিউক্ত বিদ্রোহগুলি মূলগতভাবে ছিল সামন্তবাদ বিরোধী, অন্তত এসব বিদ্রোহে সামন্তবাদ, রাজতন্ত্র, জমিদারতন্ত্র প্রভৃতি প্রবলভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। পূর্ববর্তী অন্যান্য বিদ্রোহের তুলনায় এ বিদ্রোহগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত সুসংগঠিত জাতীয় আন্দোলনের সমপর্যায়ভুক্ত।
১১. ১৯০০ থেকে ১৯১৮ সালে সমগ্র বঙ্গদেশ ছিল ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর জন্যে ভয়ানক দুর্যোগের সময়। এ সময় স্বাধীনতাকামী ছাত্র, যুবক-সম্প্রদায় অস্ত্র তুলে নেয় ইংরেজ হটানোর আন্দোলনের চরম পর্যায় হিসেবে। বঙ্গদেশে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর পার্টি ইংরেজদের কাছে ‘ত্রাস’ হিসেবে পরিগণিত হয়। অনুশীলন সমিতির মূল ঘাটি ছিল ঢাকা।
১২. ১৯৩০ সালে এ ধারার বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হয়। তবে বিদ্রোহীদের পরিকল্পনায় অস্ত্রাগার লুণ্ঠনই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। তারা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করারও পরিকল্পনা করেছিলেন। স্থির হয়েছিল এ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হবেন বিপ্লবী নেতা সূর্যসেন।১২
১৮ এপ্রিল সূর্য সৈনিকরা অস্ত্রাগার আক্রমণ করেন ও ২২ এপ্রিল ইংরেজ বাহিনী সমূলে উৎপাটিত হয়ে পরাজয় বরণ করে। ১৭৫৭ সালে হারতের স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে যাওয়ার পর সমগ্র ভারতে এবং এই বঙ্গদেশে ইংরেজদের এটাই ছিল প্রথম যুদ্ধে পরাজয়।
১৩. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ‘আজাদ হিন্দু কার্জ’ নামে সশস্ত্র সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন একই উদ্দেশ্যে।
১৪. নানকার বিদ্রোহ (১৯২২-১৯৫১)
১৫. টংক আন্দোলন (১৯৩৭-১৯৪৯)
১৬. তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-১৯৪৭)।
১৭. নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৯-৫০)
উপরিউক্ত সশস্ত্র আন্দোলনগুলির কয়টি ব্রিটিশ-যুগ থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক অবস্থা পর্যন্ত বিরাজ করেছিল। এই সশস্ত্র সংগ্রামগুলোর সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট পার্টি যুক্ত ছিল। বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক শক্তি সশস্ত্র সংগ্রামের পরিচালনা ও সংগঠিত করার সাথে যুক্ত হয়। ফলে এর বিস্তৃতি, প্রভাব ও আলোড়ন সমগ্র উপমহাদেশকে তোলপাড় করে ফেলেছিল। এই সময়ের একটি সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনাকারীর স্মৃতিচারণে এ সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রকৃতি অনুধাবন করা যাযঃ
লড়াই সংগঠিত করার লক্ষ্যে পাহাড়ের মধ্যে আশ্রয়স্থান ঠিক করার জন্য কমরেডদের নির্দেশ দেওয়া হল । বলা হল সামনাসামনি নয়, গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করতে হবে। এজন্য সত্তর মাইল ব্যাপী পাহাড় এলাকায় নয়টি ক্যাম্পগঠিত হল।…’
 

আমাদের হাজং কারিগর কমরেডরা প্রথমে দুটি গাদাবন্দুক তৈরি করলেন। …বন্দুকগুলো এত সুন্দর ও মসৃণ ছিল যে তা যন্ত্রে তৈরি আসল বন্দুকের সাথে তুলনা করা যেত। এভাবে আমাদের কারিগরেরা গোটা -পঞ্চাশেক গাদাবন্দুক তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া তারা বড় বড় কতকগুলো বন্দুকও তৈরি করেছিলেন। এগুলোতে পলিতা দিয়ে একসঙ্গে ত্রিশ-চল্লিশটি গুলি ছোড়া যেত। তারা এগুলোকে কামান বলত। এ সময় হাজং মেয়েদের রাইফেল চালনা শিক্ষা দেওয়া হয়। অন্যান্য ভলান্টিয়ারদের রাইফেল চালনা ও গেরিলা কায়দায় শিক্ষিত করা হয় । ভলান্টিয়ারদের রাইফেল চালনা ও গেরিলা কায়দায় শিক্ষিত করা হয়।১৩

১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের সিপাহিরা যে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে তাতে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষও জড়িয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর অন্যতম বাকল্যান্ড তাঁর রচিত গ্রন্থে ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের সময়কালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন নিম্নোক্তভাবেঃ

রাজশাহী বিভাগে সব সময়ই একটা আশঙ্কা ছিল ) সমস্ত নদীয়া এলাকা ও কৃষ্ণনগরে এবং যশোরের মধ্য দিয়ে একটা-অশান্তভাব চারদিক ছেয়ে পড়েছিল। বর্ধমান ও ছোট নাগপুর অঞ্চলে ছিল বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা। বাংলাদেশে এমন একটা জেলা ছিল না, যা থেকে প্রত্যক্ষ বা ঘোরতর বিপদের আশঙ্কা ছিল না।১৪

মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বারাকপুরে সিপাহিরা বিদ্রোহ করার পর চট্টগ্রামের সিপাহিরাও (১৮ নভেম্বর) বিদ্রোহ করে এবং এ সময় ভয়ে ও সন্ত্রস্ত হয়ে নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল জেলার ইংরেজ কর্মচারী ও স্থানীয় জমিদাররা ঐক্যবদ্ধভাবে এ বিদ্রোহ দমাতে যোগ দেয়। কিন্তু ফরিদপুর ও বাখেরগঞ্জ অঞ্চলের জনগণ ফরায়েজি আন্দোলনকারীদের সাথে মিলে সিপাহিদের সমর্থনে বিক্ষোভ ও জনসভা করতে থাকে। এই সময় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ফরিদপুরের বিখ্যাত ফরায়েজি নেতা দুদু মিঞা। চট্টগ্রামে বিদ্রোহের ৪ দিন পর ২২ নভেম্বর (১৮৫৭) ঢাকা দুর্গেও বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এখানে সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে তারা দুর্গের কামান দখল করে নেয়। ঢাকায় সশস্ত্র যুদ্ধের পর এখানে ৪১ জন স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী সিপাহি । শাহাদাৎ বরণ করেন।১৫

ঢাকায় এই বিদ্রোহের সময় ঢাকার খাজারা (নবাব সলিমুল্লাহর পূর্বপুরুষরা) ইংরেজদের পক্ষে এগিয়ে আসে এবং বিদ্রোহীদের ধ্বংস করতে সহযোগিতা করে।

এইজন্যে ইংরেজ সরকার খাজা আব্দুল গনি ও আব্দুল আহমদ খানকে পুরস্কৃত ও খেতাব প্রদান করে। খাজারা নবাব’ উপাধি পান এখানে থেকেই।১৬

খাজারা ‘নবাব’ উপাধি নিয়ে যখন ইংরেজদের দালালি করছেন, তখন কেরামত আলী নামক একজন বাঙালির নেতৃত্বে জনগণ সিপাহিদের সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলছেন। বাকল্যান্ড এ আন্দোলনকে বলেছেন, গণ্ডগোল।১৭

এই সময়ের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের ছোয়া বাংলাদেশের মানুষের মাঝে সংগঠিতভাবে কী প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং তা কী ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইংরেজ শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর জন্যে, তারও বিবরণ রয়েছে বাকল্যান্ডের গ্রন্থেঃ

ঢাকা বিভাগে গণ্ডগোল বাধাবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলের অভাব ছিল না।… সিলেটের …অনেককেই খুব বিপদজনক মনে হত। সব থেকে বিপদজনক ছিল ঢাকা শহর,সেখানকার প্রচুর মুসলমান জনসাধারণ সরকারের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না।১৮

কার্ল মার্কসের কাছে এ বিদ্রোহ জাতীয় মর্যাদার স্থান পেয়েছিল। তিনি তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের’ অভিধায় চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। মার্কস এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, বিদ্রোহীরা সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে এবং ইউরোপীয়ান অফিসারদের হত্যা করছে। হিন্দুমুসলমান তাদের বিদ্বেষ পরিহার করে মূল শত্রুকে চিনতে পেরেছে। আর এর ফলেই হিন্দু সিপাহিরা দিল্লিতে একজন মুসলমানকে (বাহাদুর শাহকে-লেখক) সিংহাসনে বসানোর মতো ঔদার্য দেখাতে পেরেছে। মার্কস আরো উল্লেখ করেন, বিদ্রোহ কেবলমাত্র সিপাহিদের মধ্যে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে জনতার মধ্যেও। পরিশেষে মার্কস, বেঙ্গল আর্মির মধ্যে আন্তর্জাতিক শৌর্য লক্ষ্য করেন। তিনি বলেন :

বেঙ্গল আর্মীর বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে পারস্য চীন যুদ্ধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।১৯

প্রায় এই সময়েই ১৮৬২ সালে বাংলায় প্রথম আইনসভা গঠন করা হয় এবং এই একই বছর পূর্ববাংলায় রেলগাড়ির প্রচলন শুরু হয় এবং ১৮৬৩ সালে আমেরিকায় লিঙ্কন ক্রীতদাসদের মুক্তি দেন এবং গণতন্ত্র সম্পর্ক তার বিখ্যাত ধারণা ‘গভর্নমেন্ট অব দি পিপল, বাই দি পিপল, ফর দি পিপল’ প্রকাশ করেন। এর মাত্র তিন বছর পর সমাজতন্ত্র তত্ত্বের জনক কার্ল মার্কসের ‘ডাস ক্যাপিটাল’ প্রকাশিত হয়।

১৮৭৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে আসামকে পৃথক করে দেওয়া হয়।

সমাজতান্ত্রিক চিন্তা তখনি ছাত্রদের মধ্যে কাজ করছিল

ছাত্র আন্দোলন তখনো পর্যন্ত সামাজিক কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা কিংবা বিধবাবিবাহ প্রবর্তন অথবা বহুবিবাহ রোধ ইত্যাদি বিতর্ক ও লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

এমনকি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়াও তখন ছাত্রদের একটা সামাজিক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। প্রচলিত অর্থে এগুলি ছাত্র আন্দোলন ছিল না বটে কিন্তু তৎকালীন কলকাতা কেন্দ্রীয় বঙ্গদেশের ছাত্রসমাজ এসব বিষয় নিয়েই আলোড়িত হত এবং আন্দোলন করার চেষ্টা করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে লিঙ্কনের গণতন্ত্র, মার্কসের ক্যাপিটাল এবং বাংলার দুর্ভিক্ষ ছাত্রদের নাড়া দিচ্ছে।

এই সময়কালে যেসব সংগঠন জন্ম লাভ করে তার একটিও প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের নিজস্ব সংগঠন ছিল না। ১৮৭৫ সালে তখন সবেমাত্র বিলাত থেকে আনন্দমোহন বসু ফিরেছেন, তাঁকে কেন্দ্র করে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ প্রধানত ব্রাহ্ম ছাত্রদের উদ্যোগে ছাত্র সমিতি (স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন) গঠন করা হয়। নিয়মিত সভা করে সেখানে শিখদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ইতালির মুক্তিসংগ্রাম, আয়ারল্যান্ডের মুক্তি সংগ্রাম ইত্যাদির রোমান্টিক বিবরণ আলোচনা করা হত। এভাবে ধীরে ধীরে গত শতাব্দীর শেষপ্রান্তে ছাত্রসমাজের মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও স্বাজাত্যববোধের একটা চেতনা গড়ে উঠতে থাকে। শুধু তাই নয়, সেই শতাব্দীর এই সময়তেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনাও ছাত্রযুবকদের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে। শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুপ্রেরণায় যে স্বদেশী গোষ্ঠী’ গড়ে উঠেছিল তারা অগ্নি-সাক্ষী রেখে শপথ নিয়েছিলেন যেঃ

আমরা জাতিভেদ মানিব না।… আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন বা রক্ষা করিব না। যে যাহা অর্জন করিবে, তাহাতে সকলের সমান অধিকার থাকিবে এবং সেই সাধারণ ভাণ্ডার হইতে প্রত্যেককে নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ গ্রহণ করিয়া স্বদেশের হিতকর কর্মে জীবন উৎসর্গ করিব।২০

অবশ্য ; এই সময় জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের গতিবেগ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পুরনো সংগঠনগুলি সামাজিক দিক থেকে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছিল।… কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে একটি বার্মপন্থী, র‍্যাডিক্যাল অংশ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ।২১

বাংলাদেশে এই সময় রাজনৈতিক চেতনা অত্যন্ত দ্রুত প্রসার লাভ করছিল তা বোঝা যায় তৎকালীন বাংলার প্রশাসক লেফটান্যান্ট গভর্ণর কর্তৃক বড়লাটের কাছে ১৮৭৫ সালের একটি পাঠানো চিঠি থেকে। তিনি বলেনঃ

পূর্ববাংলার বহু অঞ্চলে প্রজাদের মধ্যে লীগ ও ইউনিয়ন গঠনের মনোভাব দেখা যাচ্ছে … চাষীরা পরে খাজনার বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ হবে।… বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় এইসব দল সৃষ্টির পরিণাম ভয়াবহ হবে। ২২

ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত

এই শতাব্দীর ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সুযোগ এনে দেয় সম্ভবত ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত বিতর্ক ও জটিলতা। কোনো ইংরেজ নাগরিকের কোনো অপরাধেরই বিচার করার

অধিকার এ-পর্যন্ত ভারতীয় বিচারকদের ছিল না। বিলের খসড়ায় এই অধিকারের সুপারিশ করা হলে ইংরেজরা এর বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পাল্টা ভারতীয়রা বিশেষ করে বঙ্গদেশের ছাত্রসমাজও বিদ্রোহ করে বসে এবং রাস্তাঘাটে প্রচণ্ড ইংরেজ-বিদ্বেষী মনোভাবের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করে। এই সময়ই ইংরেজ বিচারকের আদালত অবমাননার দায়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারাদণ্ড হলে ছাত্ররা প্রচণ্ড বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। ধর্মঘট, সভা এবং মিছিল করে ছাত্ররা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। শুধু ঢাকা, কলকাতাতেই নয়, মফস্বল শহরগুলিতেও তার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল। আজকাল ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃতি বলতে আমরা যা বুঝি এটাই ছিল তার উন্মেষ। স্কুলের ছাত্ররা পর্যন্ত সেদিন ‘কালো ব্যাজ’ পরে প্রতিবাদ করতে বেরিয়েছিল। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ বিষয়ে চারুচন্দ্র দত্ত লিখেছেনঃ

স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন পরে সুরেনবাবুর জেল হল। আমরা সবাই কালো ফিতে পরলাম। সভা করে বক্তৃতা হল, সব বুঝলাম না, কিন্তু মনে একটা স্থির বিশ্বাস হল যে একটা কিছুর সূত্রপাত হচ্ছে।২৩

এই একটা কিছুর সূত্রপাতই ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত তথা জন্মকালের গোড়ার কথা । বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে এটিকেই প্রথম স্মারকচিহ্ন (মাইলপোস্ট) হিসেবে লিপিবদ্ধ করা চলে।

References:

১০. সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (কলকাতা : ডি, এন, বি, ব্রাদার্স,

তৃতীয় সংস্করণ ১৯৮০) পৃষ্ঠা ৫৭৬০

১১. Noakhali District Gazetteer. P.23

১২ পূর্ণেন্দু দস্তিদার, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরােধ আন্দোলন (সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত) (ঢাকা : এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯৮৬), পৃষ্ঠা ২৮৫

১৩ .     মণিসিংহ, টংক আন্দোলন’, পূর্বোক্ত, (বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গ্রন্থে সম্পাদিত প্রবন্ধ | পৃষ্ঠা ৩৬৯-৭০

১৪.      Buckland, Bengal Under Lit goverments. Vol. 1. pp. 6768.

১৫.       Buckland, এবং প্রমোদ সেনগুপ্ত, ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা : সুবর্ণরেখা,

১৯৮৪), পৃষ্ঠা ১৫

১৬             Buckland, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৩-৪৪ এবং আরো দেখুন, এই গ্রন্থের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন অধ্যায়ে

১৭              Buckland. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৩-৪৪

১৮             ঐ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪১-৪২

১৯             মার্কস-এঙ্গেলস, প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৮৫৭-৫৯} (মস্কো ; প্রগতি প্রকাশন ) পৃষ্ঠা ৪১

২০.       বিপিন চন্দ্র পাল ; নবযুগের বাংলা।

২১.       ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, পৃষ্ঠা, ৪৮১-৪৮২

২২.      C.E Buckland, Bengal Under Lieut. Governors. Vol. 1, p. 544

ছবি – ১৮৬০ সাল। পূর্ব বাঙলার এক গোয়ালা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!