২৬ এপ্রিল ১৯৭১ | পতাকার পেছনের উত্তাপ।
:::::::::::::::::::::
উড়ছে ধুলো, দাউ দাউ জ্বলছে আগুণ সীমান্তের কোল ঘেঁষে। ঢাকার পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। পাকিস্তান আজ বলেছে, “ঢাকা-যশোর বিমান আবার খুলেছে। [1] কিন্তু না। সত্য হচ্ছে, শুধু আর্মির বিমান চলেছে কড়া পাহারায়। তার চেয়ে বড় ঘটনা, আজ দুপুর ২ টা থেকে তারা ভারতে পাকিস্তানের হাই কমিশন বন্ধ করে দিয়েছে।[2] সকল দড়ি ছিন্ন হল। পাকিস্তান বলল, “ভারত ভিয়েনা চুক্তি ভঙ্গ করেছে।“ [2] শুধু তাই নয়, ঢাকা থেকে ভারতের দূতাবাস বন্ধ করে দিতে বলেছে। [2] এই যুদ্ধে প্রতিদিন ১.৩ মিলিয়ন রুপি খরচ হচ্ছে পাকিস্তানের। [1] ওয়াশিংটন বদনাম এড়াতে বলছে, “২৫ মার্চ থেকে আমরা পাকিস্তানকে কোন অস্ত্র দেইনি।“ [1] কিন্তু চীন খোলাখুলিভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। [1] এসব দেখে ইন্দিরা বলেই ফেলেছেন, “ভারত নীরব দর্শক হয়ে থাকবেনা।“ এদিকে শরনার্থীদের ঢল। গণহত্যার সংখ্যাটা অলরেডি ২ লাখ। [1] সীমান্ত থেকে চার মাইল ভেতরে মুজিবনগর সরকার গঠন করে বসে নেই তাজউদ্দীনরা। [1] পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া পাকিস্তান। রাতে সারেজমিনে দেখতে ঢাকায় এসেছে পাকিস্তান আর্মির চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ খান। সাথে এয়ার মার্শাল রহিম খান। এয়ারপোর্টে তাদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষমাণ আরেক কসাই টিক্কা খান। [3] ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে নেমেছে শান্তি বাহিনীর ফরিদ আহমেদ।[4] জেলায় জেলায় কমিটি। বরিশালে বশীর উল্লাহ আতাহারী, এডভোকেট নুরুল ইসলাম, দিনাজপুরে মৌলভি মতিয়ার রহমান, আহম্মদ জান মোক্তার, ঈশ্বরদীতে মমতাজুর রহমান, বগুড়া, খুলনা, মাদারীপুর, পটুয়াখালীতে জামে মসজিদের ইমামদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। [4] মাথায় টুপি দিয়ে ইসলাম আর পাকিস্তান রক্ষার নামে হিন্দু বধ কর। আওয়ামী লীগ নামক ভারতের দালালদের ভারতে পাঠাও। জমি দখল কর। গনিমতের মাল হালাল কর। নারায়ে তাকবীর। আর্মি ভাইদের সাহায্য কর। শত্রুর মুরগি, ছাগল জবাই করে আর্মিকে খাওয়াও। নারীদের ধরে ধরে ক্যাম্পে পাঠাও। এলাকার চিরচেনা এইসব হুজুরবেশী ইমাম আর বকধার্মিকেরা পাক আর্মিকে জমিতে কাজ করা অবস্থায় কৃষকদের হত্যা করতে সাহায্য করেছে। পথ চিনিয়ে দিয়েছে। বুকের দুধ খাওয়া অবস্থায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে অসংখ্য নারীকে। যারা তাদেরই প্রতিবেশী ছিল। গ্রামে আগুণ দেখে শত শত মানুষ পালাতে থাকলো ভারতের পথে। অলরেডি যারা ক্যাম্পে এসেছে ওরা অপেক্ষা করছে কখন ওদের নাম রিফিউজি খাতায় রেজিস্টার হবে। [5] একটা বড় বিস্কুট হাতে পাবে। অথবা রুটি। বাচ্চার জন্য গুড়ো দুধ। শোবার যায়গা নাই। তাতে কি? তবু ওরা খুশি অন্তত জানটা রক্ষা। বৃদ্ধ মজিদ আহমেদ, অথবা মনিরামপুরের নিরঞ্জন দাস সবার মুখে ভীতি আর শোকের ছায়া। আশ্রয়ে আসা ৮০৮৩ জনের উদ্বাস্তু শিবিরটি যেন এক টুকরো ছিন্নভিন্ন বাংলাদেশ। [5] তবে রাজনীতির চাকা থেমে নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম এন এ এডভোকেট সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হকের পিতা), যিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিস্ট, জানালেন ২৫ মার্চ থেকেই ইয়াহিয়াকে ঘিরে রেখেছিলো ৮ জন জেনারেল। [6] তাদের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু ও বাঙালীকে শোষণ করা, হাতের মুঠোয় পুরে রাখা। এই জেনারেলরা ৭০ এর নির্বাচন দেয়ারও বিপক্ষে ছিলো। [6] সেসময় তারা মুসলিম লীগ আর জামাতকে টাকাও দিয়েছিলো। কথাটা তিনি শেখ মুজিবকেও জানিয়েছিলেন। [6] একই সময় রাজনীতির উত্তাপ ছড়িয়েছে মস্কো আর প্যারিসে। সেখানে সফরে গেছে ইয়াহিয়ার দূত আইয়ুবের শেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরশাদ হোসেন। তার একটাই কথা, “ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে।“ [7] (তবে এই আরশাদ মার্চে শেখ মুজিবের পক্ষে ছিলেন। [7]) ওদিকে আজ কোলকাতার প্রেসক্লাব সরগরম। ব্রিটিশ এম পি ব্রাশ ডগ্লাস আর নিউজিল্যান্ডের শ্রমিক দলীয় এম পি কোলকাতা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন বাংলাদেশের পক্ষে। [8] আজকের নিউ ইয়র্ক টাইমস ছেপেছে, সিলেটে লীগের সমর্থকদের হত্যা করে শিয়াল-কুকুর-শকুনের খাবার হিসেবে ফেলে রেখে গেছে পাকিস্তানি আর্মি। [9] সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদরাও বসে নেই। কাইউম মুসলিম লীগের সহ সভাপতি ও সাবেক প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিন আহমেদ শান্তি কমিটির মতই বাণী দিয়েছে আজ। [10] সব মিলে বোঝাই যাচ্ছে খেলা হচ্ছে অনেকগুলো সেক্টরে। দেশে, বিদেশে, মুজিবনগর সরকারে, রাজনীতির টেবিলে, রিফিউজি ক্যাম্পে অথবা পাকিস্তান আর্মির ডেরায়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ কি পারবে সব বাধা পেরিয়ে স্বাধীন বাঙলায় তার পতাকা ওড়াতে? দেখা যাক কাল কী হয়।
:::::::::::::::
সংশ্লিষ্ট তথ্যের ছবি, পেপার কাটিং ও বিস্তারিত পড়তে রেফারেন্সে দেয়া লিংক দেখতে পারেন।
Assimilated by Dr Razibul Bari
::::::::::::::
References:
[1] “টাইম ম্যাগাজিন, এপ্রিল ২৬, ১৯৭১ সীমান্তের দিকে চাপ | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/6476 (accessed Apr. 26, 2020).
[2] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ কলকাতায় পাক মিশন বন্ধ ঘোষণা | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55801 (accessed Apr. 26, 2020).
[3] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ জেনারেল হামিদের ঢাকা সফর | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55814 (accessed Apr. 26, 2020).
[4] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ শান্তি ও কল্যাণ কমিটির শাখা গঠনের জন্য নেতা নিয়োগ | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55799 (accessed Apr. 26, 2020).
[5] “বাঘের থাবা থেকে গাছতলাও ভাল — কৃষ্ণ দেবনাথ | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/33536 (accessed Apr. 26, 2020).
[6] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ এডভোকেট সিরাজুল হক এমএনএ এর বিবৃতি | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55789 (accessed Apr. 26, 2020).
[7] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ ইয়াহিয়ার দুত হিসেবে আরশাদ খানের বিভিন্ন দেশ সফর | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55815 (accessed Apr. 26, 2020).
[8] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে ব্রিটিশ এমপি | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55813 (accessed Apr. 26, 2020).
[9] “নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১ শকুন ও বুনো কুকুর | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/6468 (accessed Apr. 26, 2020).
[10] “২৬ এপ্রিল ১৯৭১ঃ মফিজ উদ্দিন আহমেদ এর বিবৃতি | সংগ্রামের নোটবুক.” https://songramernotebook.com/archives/55798 (accessed Apr. 26, 2020).
:::::::::::::::::
🐝 সংগ্রামের নোটবুক
::::::::::::::::