You dont have javascript enabled! Please enable it!

একাত্তরের রণাঙ্গন

মাহবুব এলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক

মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতিময় অধ্যায়। লাখো শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। হাজার বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ একটি জাতি দীর্ঘ পরাধীনতার গ্রানি থেকে মুক্তি পেয়েছিল শত সংগ্রাম এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্ব এবং গৌরবময় বিজয় অর্জন সমগ্ৰ বিশ্ববাসীর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আমি একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। দেশমাতৃকার টানে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম, বিজয়ী হয়েছিলাম। আমরা সত্যিই সৌভাগ্যবান সেদিন আমাদের জীবনে সুযোগ এসেছিল দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার।

যুগ-যুগান্তর ধরে অবহেলিত, বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ উত্তর জনপদের সংগ্ৰামমখুর এলাকার নাম গাইবান্ধা। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধাবাসীর অবদান চিরস্মরণীয়। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণার পর সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ যে উদ্যম নিয়ে অসহযোগ আন্দােলনের সূচনা করেছিল গাইবান্ধাবাসী সে ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে ছিল না। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শুরুতে রাজশাহীতে থাকলেও নানা ঝড়-ঝঞা এড়িয়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পরপরই গাইবান্ধা চলে আসি এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা ঢাকায় নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় সশস্ত্ৰ সংগ্রাম ও প্রতিরোধ। সে ক্ষেত্রে আমরা গাইবান্ধাবাসী বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় কোনোভাবেই পিছিয়ে ছিলাম না।

অসহযোগ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আন্দোলনের পাশাপাশি চলছিল সশস্ত্ৰ প্ৰস্তুতি । গাইবান্ধা কলেজের ইউওটিসির ডামি রাইফেল দিয়ে কলেজ মাঠে রাতের বেলা ট্রেনিং শুরু হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর প্রায় ত্ৰিশ জনের একটি বাঙালি সেনাদল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাবিলদার আফতাবের (আলতাফ নামে সমধিক পরিচিত) নেতৃত্বে কেন্দ্র করে ট্রেনিংপ্ৰাপ্ত ছাত্র-যুবকরা গাইবান্ধা ট্রেজারিতে আনসার বাহিনীর গচ্ছিত রাইফেল নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গাইবান্ধায় পাকিস্তানিদের ঢোকার দুটি পথ। একটি পলাশবাড়ী হয়ে, অপরটি মাদারগঞ্জ-সাদুল্লাপুর হয়ে। দুটি পথেই প্রতিরোধ বৃহ গড়ে তোলা হয়েছিল। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কয়েকদফা পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। আমাদের প্রতিরক্ষাবৃহ ভেদ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা ওদের সঙ্গে পেরে উঠিনি। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী গাইবান্ধায় ঢুকে পড়লে আমরা শহর ছেড়ে প্রথমে শহরের পূর্ব প্রান্তে বঁধে এবং শেষ পর্যন্ত রাতে শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে কঞ্চিপাড়ায় আমাদের সঙ্গী সাইফুলের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রাতযাপন করি। তারপর মানস নদী পার হয়ে কালাসোনারচর গিয়ে দেখি সেখানে হাবিলদার আফতাব তার বাহিনী নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমরা একত্রে বিশাল ব্ৰহ্মপুত্র নন্দ পাড়ি গিয়ে একটানা কয়েক ঘণ্টা হেঁটে এডুণ্ডাবাড়ি চরে হযরত আলী চেয়ারম্যানের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। সেখানে রাতযাপন করার পর হাবিলদার আফতাব এবং তার বাহিনীর অন্য সদস্যের সঙ্গে আলোচনায় আমাদের মতের এবং সিদ্ধান্তের অমিল দেখা দিল। আমরা আবার ফিরে এলাম কঞ্চিপাড়ায়। সেখানে ফিরে দেখা হলো নজরুল ভাইয়ের সঙ্গে (পরবতীতে শহীদ)। আরার আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে সংগঠিত হওয়ার আশা নিয়ে রওনা হলাম। প্ৰথমে কামারজানি, তারপর শরণার্থীদের নীেকায় রাতারাতি বিশাল ব্ৰহ্মপুত্র নন্দ পাড়ি দিয়ে মোল্লারচর, নয়ারচর, কোদালকাটি হয়ে রৌমারী। সেখানে রাত কাটিয়ে ভারতের মানকারচর চেকপোস্টে উপস্থিত হলাম। শুরুতেই বিএসএফ কমান্ডারের নির্দেশে আমাদের রাইফেলগুলো জমা দিতে হলো ।

ভারত ভিন্ন দেশ, তাদের জনগণ, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি প্রশ্নে অস্ত্রসহ আমাদের গ্ৰহণ করলেও অবাধ বিচরণ সম্ভব ছিল না। আমরা যখন চেকপোস্টের ক্যাম্পে, তখনই সারা মানকারচর বন্দরে খবর পৌঁছে গেছে মুক্তিফৌজ এসেছে। আমাদের এক নজর দেখার জন্য সাধারণ মানুষের ঢল নামল। এর মধ্যেই গাইবান্ধা, সাঘাটা-ফুলছড়ি এলাকার নির্বাচিত তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য মোঃ লুৎফর রহমান এবং সাদুল্লাপুর এলাকার পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য মোঃ তালেব মিঞা এসে আমাদের সাহস বাড়িয়ে দিলেন। দু’একটা দিন বেশ ভালোই কাটলো সেখানে। কয়েকদিনের মধ্যেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। শরণার্থীর সংখ্যা প্ৰতিদিন বাড়তে লাগলো। মানকারচারের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কমিটি নামে সংগঠিত হয়ে আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। এক মাড়োয়ারির গদিঘর এবং গুদামঘর মিলে ক্যাম্প স্থাপিত হলো। সংখ্যায় আমরা চল্লিশ বা পঞ্চাশের বেশি নয়। ভৌগোলিক কারণে রৌমারী-রাজীবপুরসহ ব্ৰহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড় এলাকাটি ছিল সম্পূর্ণ পাকিস্তানি সৈন্যমুক্ত। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্ব পাড়ে কোথাও আক্রমণ করেনি। সে সুবাদে রৌমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপিত হলো। আমরা সবাই চলে এলাম রৌমারীতে। সেখানে কয়েকদিন ট্রেনিং হতে না হতেই নানা সমস্যা এসে গেল। অন্ত্র, রসদ, ইত্যাদির কোনো জোগান নেই। তারপর সবসময় পাকিস্তানিদের আক্রমণভীতি। আবার আমরা ভারতের কাছাকাছি ইপিআর ক্যাম্পকে আমাদের ক্যাম্প বানিয়ে কাজ শুরু করলাম। ক’দিন পর সেটাও থাকলো না। এবার স্থাপিত হলো কাকড়িপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্প, মানকারচর থেকে দক্ষিণে ৪ কিলোমিটার দূরে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই ক্যাম্পটি ছিল। আমরা এই ক্যাম্পে থেকেই একদিন উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য গিয়েছিলাম। উল্লেখ্য, ভারতের সেদিনের সাহায্য এবং সহযোগিতা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিল।

আমরা প্রথম ব্যাচে তুরাতে প্রশিক্ষণ শেষ করে মধ্য জুলাইয়ে মানকারচারে ফিরে এলাম। পূর্ণ সামরিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হতো নতুন যে ক্যাম্প স্থাপিত হলো সেখানে। এবার নতুন করে শপথ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ ও নির্মূল করার পালা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্ৰ যুদ্ধ এলাকাকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল এবং একেকটি সেক্টরকে ভাগ করা হয়েছিল কয়েকটি সাব-সেক্টরে। আমরা ছিলাম ১১ নং সেক্টরের অধীন। আমাদের এলাকা ছিল সমগ্র গাইবান্ধা, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজীবপুর ইত্যাদি। ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর আবু তাহের। তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনের বুকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। শত্রুর বিরুদ্ধে অদম্য সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করে তিনি তার সহযোদ্ধাদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেন। কামালপুরে শত্রুর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তানি যাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় মেজর আবু তাহের মারাত্মকভাবে আহত হন এবং একটি পা হারান। আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান। তিনি বিমান বাহিনীর একজন সুদক্ষ অফিসার। তিনি খুব দ্রুত সেনাবাহিনীর যুদ্ধকৌশল রপ্ত করতে পেরেছিলেন। বিভিন্ন সময় নির্দিষ্ট কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে বিভিন্ন প্রকার সতর্কতামূলক আলোচনার মধ্যে তিনি তার জ্ঞান এবং মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। আমাদের প্রথম অভিযানের পরিকল্পনা ঠিক হলো। গাইবান্ধা-ফুলছড়ি সড়কের বাদিয়াখালী সেতু উড়িয়ে দেয়া ছিল আমাদের প্রথম অভিযানের লক্ষ। পনেরোজন সহযোদ্ধা, আমি তাদের কমান্ডার। ২৫ জুলাই মানকারচারের আমাদের ক্যাম্প থেকে রওনা হলাম। ব্ৰহ্মপুত্র নন্দ পাড়ি দিয়ে বাদিয়াখালী সেতু আক্রমণ করতে। তখন পর্যন্ত ইতিহাসের কলঙ্ক কুখ্যাত রাজাকার বাহিনী সংগঠিত হয়নি। বাংলাদেশের অন্য প্রান্তে যাই ঘটুক আমাদের এলাকায় মোজাহিদ নামে একটি বাহিনী এবং দালাল শান্তি কমিটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে ইতোমধ্যে কাজ করছিল। সেই মোজাহিদরা সেতুটি পাহারা দিচ্ছিল। সামান্য যুদ্ধে ওরা পরাস্ত হলো, কেউবা পালিয়ে বাঁচল। সেতু ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরক লাগিয়ে উড়িয়ে দিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও আমার সহযোদ্ধাদের ভুল রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সেতুটির আংশিক ক্ষতি হলো ঠিকই, সম্পূর্ণ সফল হলো না। আমরা পেছনে ফিরে এসে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ এবং প্ৰস্তুতি নিতে লাগলাম। অস্ত্ৰবল, ট্রেনিং সবই অপ্রতুল, শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অদৃশ্য সাহসিকতাই যেন সম্বল। ইতোমধ্যেই কুখ্যাত রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়ে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালি সন্তান হয়েও বাঙালির ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করেছে। আমরা ব্ৰহ্মপুত্ৰ পাড়ি দিয়ে কালাসোনার চরে যে রাতে পুনরায় এসেছি, তার পরের দিন (১০ আগস্ট) সকালে খরব এলো মানস নদের পশ্চিম তীরে রতনপুর, উড়িয়া গ্রামগুলোতে এসে রাজাকাররা লুটতরাজ করছে। নদীর অপর প্রান্ত থেকে ব্যাপারটি পৌঁছলাম। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে শত্রুরা আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসলো।

আমাদের পাল্টা আক্রমণে ওরা পরান্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা এক এক করে ১২ জন রাজাকারকে হাতেনাতে ধরে ফেললাম। দু’জনকে স্থানীয় জনগণ ক্ৰোধের বশে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে খণ্ডিত করে ফেলল। আমরা সংগ্ৰহ করতে পেরেছিলাম গোলাবারুদসহ ষোলটি রাইফেল। রাজাকার শয়তানগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সঙ্গে করে পশ্চিম তীর থেকে পূর্ব তীরে নিয়ে গেলাম কালাসোনার চরে। শয়তানগুলোকে পাঠিয়ে আমরা পরবতী নিশ্চিত যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে লাগলাম। আমাদের ধারণাই ঠিক ছিল। পাক বাহিনী রসুলপুর ক্যাম্প থেকে বিকেলে ছুটে এলো রাজাকার ধরার স্থানে। ছোট মানস নদের এপার-ওপার গুলিবিনিময় হওয়ার পর আমরা পূর্ব পাড় থেকে ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে পশ্চিম পাড়ে পার হলাম। পাক সৈন্যরা পালানোর সময় দু’জন আহত হলো, বাকিরা তাদের নিয়ে পালিয়ে গেল। কালাসোনার চরে ফিরে পরদিন জনগণের ওপর নির্যাতনঅত্যাচার নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলাম। অনুমানে এতটুকুও ভুল ছিল না। পরদিন (১১ আগস্ট) সকাল থেকেই শুরু হলো বর্বরতা, হৈ-হল্লা, চিৎকার, আর্তনাদের নারকীয় দৃশ্য। প্রথমে লুটতরাজ তারপর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে লুট করা মালামাল দুটি নৌকায় বোঝাই করে নৌকার ছৈয়ের ওপর গুন টানিয়ে পাকিস্তানিরা উজানে রসুলপুর ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হলো। পনেরো-বিশজন নীেকার ছৈয়ের ওপর অস্ত্র উচিয়ে বসে, বাকিরা পায়ে হেঁটে। যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে আমরা মোটেও ভালো অবস্থানে ছিলাম না। আমাদের অবস্থান শক্রকে আক্রমণ করার পক্ষে ছিল না। সমান্তরালভাবে আমরা চরের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সকাল থেকে শুরু করে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, একটু পানি পর্যন্ত খাওয়ার সুযোগ করা যায়নি। এবার আমাদের সামনে বিরাট বাধা এসে গেল। সামনে একটি নালা। পার হওয়ার উপায় নেই, উপরন্তু পার হলে শক্ৰ দেখে ফেলবে। উল্লেখ্য, কলাইয়ের বড় বড় গাছের কারণে নদীর তীর যেন ঘন বনাঞ্চলের মতো দেখাচ্ছিল। এতক্ষণ সুবিধা ছিল। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। একটাই পথ খোলা। তা হলো, আক্রমণ করে শক্রকে পরাস্ত করা এবং নিজেদের বাঁচানো। মুহূর্তের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। প্রথম চোঁটেই ছৈয়ের ওপর বসা সৈন্যরা পাখির মতো পানিতে পড়তে লাগল। আর যারা পাড় দিয়ে সন্ত পণে হাঁটছিল তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালানোর চেষ্টা করতে লাগল। অনেকক্ষণ গুলিবিনিময় হওয়ার পর ওদের কয়েকজন জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল। আমরা পার হয়ে নৌকার কাছে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। তিন-চারজন যুবতীর আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠল, প্ৰায় পঁচিশ-ত্রিশটি ছাগল, খাসি, বাক্স, ট্রাংক, চাল, ডাল ইত্যাদি দিয়ে নৌকা বোঝাই ছিল। গ্রামবাসী ছুটে আসতে লাগলো। বেদনা এবং বিষন্নতার মাঝেও আনন্দের বন্যা। মুরব্বিজনদের হাতে মালামাল দিলাম ফেরত দেয়ার জন্য। আমরা পাকিস্তানি সৈন্যের একটি চাইনিজ সাব-মেশিনগান ও তিনটি রাইফেল হস্তগত করলাম আর পেলাম রাজাকারদের বেশ কয়েকটি থ্রিনট থ্রি রাইফেল। দখলকৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রাজাকারদের নিয়ে যখন শক্রমুক্ত এলাকায় ফিরলাম তখন যেন আনন্দের উৎসব। জনতা ওদের হত্যা করতে চায়। আমরাই প্ৰথম বন্দি রাজাকারদের নিয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরলাম। বাঙালি সন্তান ভুল করে বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় নেমেছে-এই বিশ্বাস সেদিন ওদের ক্ষমা করেছিলাম। মজার বিষয় হচ্ছে, ওই রাজাকারসহ আরো অনেক রাজাকার

চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই ছিল। এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে এ যুদ্ধেই প্রথম পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করে চীনা অস্ত্ৰ দখল করা হয়।

আমাদের এসব অভিযানের ফলে আমাদের সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে গেল। মানকারচর সাব-সেক্টরে আর একজন অদম্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধার নাম খন্দকার রুস্তম আলী। সাঘাটা-ফুলছড়ি থানা এলাকায় তিনি তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধরত ছিলেন। তিনিও আমাদের পরপরই একটা অত্যন্ত সফল অভিযানে জয়ী হলেন। ভরতাখালী রেলস্টেশনের কাছে এন্টি-ট্যাংক মাইন দ্বারা ট্রেন অ্যাম্বুশ করার এ যুদ্ধটি এ অঞ্চলের একটি মাইলফলক যুদ্ধ।

আমাদের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারসহ মুক্ত এলাকায় স্থাপনাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত হলো। ইতোমধ্যেই আবার অন্যদিকে মুক্ত এলাকা সংকুচিত হয়ে এসেছে, কেননা প্ৰায় এক ব্রিগেড পাক বাহিনী গানবোট, বিভিন্ন ধরনের নৌযান নিয়ে ব্ৰহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে রৌমারী থানার কোলকাটিতে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। রৌমারী, রাজীবপুর এলাকা যেহেতু নদীনালায় ভরা, নেই কোনো রাস্তাঘাট, তাই পাক বাহিনীর পক্ষে ওই নদী পাড়ের কোদালকাটি ও সংশ্লিষ্ট এলাকা ছাড়া বাকি সমগ্ৰ এলাকা দখল করা সহজতর ছিল না। ইতোমধ্যে হাবিলদার আফতাবের বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্ত এলাকাতেই সংগঠিত হয়ে তিন-চারটি ক্যাম্প স্থাপন করে পাক বাহিনীর মােকাবেলা করার ক্ষেত্রে তিনি লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আগস্ট মাসের শুরুতেই আমাদের দলগুলোকে পুনর্গঠিত করা শুরু হলো। খুব সুষ্ঠুভাবে কমান্ড স্থাপিত হলো সেক্টর হেডকোয়ার্টার, সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার এবং কয়েকটি যুদ্ধরত কোম্পানি গঠনে কোম্পানি কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন খন্দকার রুস্তম আলী, মাহবুব এলাহী রঞ্জ, এমএন নবী লালু, আমিনুল ইসলাম সুজা এবং খায়রুল আলম (প্রকৃত নাম নজরুল ইসলাম) প্রমুখ। আরো একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে গাইবান্ধার ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নান্দিনায় যুদ্ধে প্রায় ত্ৰিশজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। একেকটি কোম্পানির সেনাবল ছিল একশ’ জনের বেশি; কিন্তু শেষ পর্যায়ে তা তিনশ’ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নতুন নতুন অভিযানের পরিকল্পনা গৃহীত হলো। আক্রমণ জোরদার করার সিদ্ধান্ত তো আছেই। গাইবান্ধা শহর থেকে সুন্দরগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায় দাড়িয়াপুর সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি উড়িয়ে দিলে সমগ্র উত্তর এলাকায় শত্রুরা পর্যুদস্ত হবে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার সুযোগে শত্ৰু ক্যাম্পে আক্রমণ জোরদার করা যাবে। পরিকল্পনামাফিক আমার অধীনস্থ কোম্পানির প্রায় একশ’ জন সদস্যকে নিয়ে মোল্লারচর স্কুলের অস্থায়ী ক্যাম্পে জড়ো হলাম। সেদিনই রাতে ব্ৰহ্মপুত্র নদ দিয়ে উজানে গিয়ে প্রথমে গেলাম পূর্ব শ্ৰীপুরে। সেখানে সারাদিন কাটিয়ে রাতেই সেতু উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করলাম। আজো মনে পড়ে সেই রাতটি ছিল শবেবরাতের রাত, ২৭ সেপ্টেম্বর। আমাদের পথঘাট দেখানোসহ অভিযানে আগ্ৰহী একজন লোক আমাদের সঙ্গে এসেছেন। তিনি রাজেন বাবু। তার বাড়ি ছাপড়হাটিতে; কিন্তু তখন তিনি শরণার্থী। পিতৃতুল্য এই ব্যক্তির আদর, সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং তার সাহসী ভূমিকা চিরকাল মনে থাকবে। দাড়িয়াপুর সেতুর উভয় প্রান্তে শত্রুর ঘাঁটি ভীষণ মজবুত। সেতুর প্রহরীদের ঘায়েল করে আগে সে দুটি শক্রমুক্ত করা, তারপর উড়িয়ে দেয়া। সেতুর উভয় প্রান্তে একসঙ্গে আক্রমণ করে বসলাম। দীর্ঘ সময় ধরে গুলিবিনিময় হওয়ার পর আমাদের প্রবল চাপে ওরা পালাতে শুরু করল। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে এবার ভুল এড়ানোর জন্য সতর্কতার সঙ্গে বিস্ফোরক বসানো হলো। বিকট শব্দে দাড়িয়াপুর সেতু অসহায়ভাবে ভেঙে পড়লো। একটি সফল অভিযান, উত্তর-দক্ষিণ সম্পূর্ণ সেতুটি পানিতে তলিয়ে গেল। এত বড় একটি সেতু ধ্বংস হয়ে পানিতে পড়ার দৃশ্য ইতোপূর্বে আমি নিজেও কখনো দেখিনি। যা হোক, উল্লাস করতে করতে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরছিলাম। এমন সময় আমরা দাড়িয়াপুর সেতুর উত্তরে মাছের হাটে পৌছলে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা হলো। আমাদের কাছে সেই মুহূর্তে সঠিক তথ্য না থাকায় এমনটি হয়েছিল সেদিন। গুলিবিনিময় হতে হতে ভোর হয়ে গেল। আমরা কিছুটা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। আমাদের তিনজন গুরুতর আহত হলো। আহত যোদ্ধাদের দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে এনে পরে মুক্ত এলাকায় ক্যাম্পে পাঠানো হলো। আহতদের মধ্যে সুন্দরগঞ্জের রাজা বেশি গুরুতর। সে কয়েক মাস ধরে ভারতে চিকিৎসারত ছিল। কিছুটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে আমাদের কোম্পানি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সবাই আবার মোল্লারচারে একত্রিত হলাম। ইতোমধ্যে মুক্তি বাহিনীর প্রবল আক্রমণের তোড়ে প্রায় এক ব্রিগেড সেনাশক্তি থাকার পরও পাকিস্তানিরা কোদালকাটি ঘাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। আমাকে পরবতী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশগ্রহণ করার জন্য মানকারচারের হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠানো হলো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসখ্যাত চিলমারী এলাকার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাকে ডেকে আনা হয়েছে। এটি একটি বিশাল অভিযান। ব্ৰহ্মপুত্র নদের পশ্চিম হবে। তাতে করে চিলমারী এবং উলিপুর বিশাল এলাকা দখলদারমুক্ত হবে। তাই আমাদের সব শক্তি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। খায়রুল আলম কোম্পানির কমান্ডার, তার কোম্পানি নিয়ে উলিপুর অবস্থান করছিলেন। তার সেনাশক্তি প্ৰায় ২শ’ জনেরও বেশি। যুদ্ধের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাময়িকভাবে আমাকে সেই কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হলো। সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের স্বয়ং এই অভিযানের কমান্ডারের দায়িত্বে। ১৫ অক্টোবর মানকারচর ইপিআর বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্ত মোটরলঞ্চে মেজর আবু তাহের, সাব-সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান, ক্যাম্প অ্যাডজুটেন্ট এবং সাব-সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শফিউল্লাহসহ প্ৰথমে রৌমারী, তারপর ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদের পূর্বতীরের ছালিয়াপাড়ার চরে পৌঁছি। তারপর আমি ভিন্ন নৌকায় দ্রুত ক’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ উলিপুর রওনা হলাম। বিকেল নাগাদ উলিপুর পৌঁছেই কোম্পানি কমান্ডার খায়রুল আলমের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা সেরে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। একটার পর একটা নির্দেশসহ এগিয়ে গেলাম। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল চিলমারীর বিভিন্ন পাকিস্তানি অবস্থান আক্রান্ত হওয়ার পর যেসব পাক সেনা ও রাজাকার চিলমারী, উলিপুর, কুড়িগ্রামের রাস্তা এবং রেলপথ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে তাদের পরাস্ত করা বা বন্দি করা ও বন্দিদের মুক্ত এলাকায় নিয়ে আসা।

সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৬ অক্টোবর ভোর ঠিক ৪টায় ছলিয়াপাড়া চর থেকে পশ্চিম তীরের চিলমারীর বিভিন্ন ঘাটি এবং ক্যাম্পের ওপর মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। সারারাত ধরে আমাদের ছলিয়াপাড়া অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে ছেলেরা পশ্চিম তীরে চিলমারীর উদেশে পার হয়ে এসেছে। এবার মর্টার গোলার সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ রচনা করা হলো। কৌশলগতভাবে পাক বাহিনীর অবস্থান সুদৃঢ়। পাক বাঙ্কারে ওদের অবস্থান, অস্ত্ৰবল, জনবল কোনোটার ঘাটতি নেই। দীর্ঘ সময় ধরে গুলিবিনিময়, গ্রেনেড চার্জ, বেয়নেট চার্জ এমনকি কোনো কোনো বাঙ্কারে হাতাহাতি লড়াই পর্যন্ত হয়েছিল। ওরা পর্যুদস্ত এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে, কেউ মরে, কেউ পালিয়ে গেল। শত শত রাজাকার কেউ আত্মসমৰ্পণ করল, কেউ বন্দি হলো। আমাদের অভিযান সফল হলো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওই বিজয় বেশি সময় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাক বাহিনী পুনরায় রংপুর, কুড়িগ্রাম থেকে শক্তি বৃদ্ধি করে এসে চিলমারী দখল করে ফেলে। যা হোক, আমি বেশ ক’জন বন্দি রাজাকার নিয়ে উলিপুর থেকে ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্ব তীরের পাখিমারার চরে এলাম। সেখানে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল ইপিআর বাহিনীর সুবেদার হাকিমের নেতৃত্বে। আমাদের সবাই সফল পশ্চাদপসরণ করে ফিরে এলো।

কোনো বিশ্রাম না নিয়েই আমার কোম্পানির সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরের অভিযান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বিশ্রাম এবং প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়ে সবাই যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এক রাতে একটু-আধটু ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে রওনা ছিলাম। ব্ৰহ্মপুত্র পাড়ি দিচ্ছিলাম। মাঝনদীতে এমন ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো যে, নৌকা ভাসিয়ে রাখা দায়। আমরা রাতের অন্ধকারে ঝড়ের কবলে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। পরের দিন বিকেল নাগাদ দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কামুক্ত হয়ে আবার সবাই একত্রিত হয়ে জন্য রওনা হলাম। শক্ৰ সেতুটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ইতোমধ্যেই সেটি সংস্কার ও মেরামত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বানিয়েছে। আমরাও আমাদের কৌশল পাল্টালাম। দক্ষিন প্ৰান্ত থেকে আক্রমণ করে সফল হয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিস্ফোরক লাগিয়ে সেতুটি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিলাম। সফল অভিযান, ফিরে এলাম কালাসোনার চরে। রসুলপুর সুইস গেট সংলগ্ন পাক বাহিনীর ক্যাম্প দিনে ও রাতে কয়েকবার আক্রমণ করে ওদের আমরা আতঙ্কিত ও ভীতিসন্ত্রস্ত করে চললাম। রসুলপুর-কামারজানী বঁধে কয়েক দিন আমাদের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ হলো। ধীরে ধীরে কালাসোনার চরে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়ে উঠল। আমাদের সাফল্যে এলাকার জনগণ ইতোমধ্যে সাহসী হয়ে উঠেছে। পাক সেনাদের চলাচল ও বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত হয়ে এসেছে। আমাদের আক্রমণের চাপে পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে কামারজানী ক্যাম্প গুটিয়ে নিল। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই আমাদের আক্রমণে কাইয়ারহাট এবং কেতকীরহাট রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটেছে। বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমরা সংগ্ৰহ করেছি। ওদের কেউ আত্মসমৰ্পণ করেছে, বাকিরা জীবন নিয়ে পালিয়েছে। আমাদের অবস্থােন কিন্তু মোটেও নিরাপদ ছিল না। উত্তর-দক্ষিণ কয়েক মাইল বিস্তৃত কালাসোনার চর প্রন্থে খুব বেশি ছিল না, পূর্বদিকে বিশাল ব্ৰহ্মপুত্র নদ, পশ্চিম দিকে ছোট মানস নদের সমান্তরাল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ। বাধের ওপর শক্রর কয়েকটি ক্যাম্প বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। রণকৌশলগত বিবেচনায় কালাসোনার চরে আমাদের অবস্থান। তার ওপর পাক বাহিনীর দোভােব দালাল, শান্তি কমিটি, আলবদর, রাজাকারদের উৎপাত। আমার কোম্পানির পাঁচটি প্লাটুন নিয়ে কালাসোনার চরের বিভিন্ন স্থানে কিছুটা স্থায়ী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম। একটি প্লাটুনের সেনা ছিল প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ জনের মতো। অদম্য সাহসী জুবেল, নুরুন্নবী, হোসেন আলী, মকবুল প্রমুখ আমার প্লাটুন কমান্ডার। অক্টোবরের শুরু থেকেই পাক বাহিনীর রতনপুর ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ জোরদার করেছিলাম। যুদ্ধে যুদ্ধে দিন-রাত অতিবাহিত হচ্ছিল। পাক সেনা হত্যা, রাজাকার বন্দি, অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল হয়ে উঠল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একদিন এক পাক সেনাকে বন্দি করে মুক্ত এলাকায় নিয়ে এলাম। রাজাকার বন্দি করে অস্ত্রশস্ত্র দখলের ঘটনার প্রথম দিকে জনগণসহ সবাই যেভাবে হতবাক হতেন, পাক সেনা বন্দি করার ঘটনায়ও সবাই সেভাবেই হতবাক ও উল্লসিত হলেন। মুক্ত এলাকার জনতার সেই উল্লাস আমার স্মৃতিতে চিরজাগরকে থাকবে। সবারই চেহারায় গৌরবের দীপ্তি-আমাদের ছেলেরাও পারে। ৩ নভেম্বর তোরবেলা আমরা পাক বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পড়ে গেলাম। বালাসীঘাটের কাছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বঁধ ছিল। পাকিস্তানিদের সেই বঁধে অবস্থান, তখন আমরা ধানক্ষেত দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কৌশলগতভাবে ওরা আমাদের তুলনায় অনেক ভালো, উচু অবস্থানে। আমরা তাড়াহুড়া করে জমির আইলে অবস্থান নিলাম। গুলিবিনিময় চলতে থাকলো। ভোর থেকে প্রবল যুদ্ধ শুরু হলো। সকাল থেকে সূর্যের এবং রণাঙ্গনেরও উত্তাপ উভয়ই বাড়তে থাকলো।

আমাদের ফজলু অবস্থান বদল করে একটু ভালো অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করতেই গুলিবিদ্ধ হলো। যত্ন-আত্তির সুযোগ তো দূরের কথা, ভালো করে তার দিকে তাকিয়ে দেখার অবকাশও পাচ্ছিলাম না। যে ছেলে চলে যাবে তাকে বিদায় জানাতে হবে না? আমি তার কমান্ডার। হায় অসহায়ত্ব! বৃষ্টির মতো গুলি আসছে বাঁধের ওপার থেকে। মাথা তোলা যাচ্ছে না। গুলির জবাব দিতে আমাদের ছেলেরাও ব্যস্ত। গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে পাশের সহযোদ্ধাদের কণ্ঠস্বরই শোনা যায় না। এর মধ্যে ফজলুর ক্ষীণকণ্ঠ শুনতে পেলাম ‘পানি’ ‘পানি’। মনটা ডুকরে। কেঁদে উঠলো। পানি কই? পানি কই? আমাদের কারো কাছেই খাবার পানি নেই, অথচ পানিতে দাঁড়িয়ে আর শুয়ে যুদ্ধ করছি। ফজলুকে দুচুমুক পানি দেই কোথেকে, কীভাবে দেই? অসীম সাহসের মান্নান এলো পাশ থেকেই। ফজলুর পানি পানের ক্ষীণকণ্ঠের মিনতি মান্নানের কানে পৌছেছে নিশ্চয়ই। মান্নান নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে পরম মমতায় সহযোদ্ধা ফজলুকে পিঠে তুলে নিল। গুলি আসছে। ঝাঁকে ঝাঁকে। একটু দূরেই আবাদি জমিতে সেচের পানি দেয়ার কুয়ার মতো গর্ত। সেখানে পরিষ্কার পানি। মান্নান ফজলুকে নিয়ে যাবে সেখানে। ফজলুকে পিঠে নিয়ে লাফ দিতেই গুলি লাগলো। না, মান্নানের শরীরে না, ফজলুর পাঁজরে। ফজলু চলে গেল। পাকিস্তানিরাও পালিয়ে গেল। আমরা জিতে গেলাম।

আমাদের জিতিয়ে দিয়ে ফজলুরা চলে যায়। ফজলুদের চলে যেতে হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। মান্নানরা নীরবে, নিঃশব্দে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। সে কান্নার শব্দ শুনতে নেই, শোনার প্রয়োজনও নেই কারো।

মাহবুব এলাহী রঞ্জু, বীর প্রতীক

জন্ম : ১৭ জুন ১৯৫২, গাইবান্ধা। শৈশব রংপুরে এবং কৈশোর গাইবান্ধায়। একাত্তরের মার্চে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে বিভাগে প্রথম বর্ষ সম্মানের ছাত্র। গাইবান্ধায় মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসৈনিক। ১১ নম্বর সেক্টরের মাইনকারচর সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন।

যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত হন।

রেফারেন্স – স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!