You dont have javascript enabled! Please enable it!

সম্মুখ সমরে বাঙালি

মেজর জেনারেল আমীন আহমদ চৌধুরী (অব.) বীর বিক্রম

প্রবল পরাক্রান্ত মুঘল সম্রাট আকবর একদা বাংলার এক ক্ষুদ্র দুর্কিনীত ভূস্বামীকে দমন করার জন্য তার দরবারের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি রাজা মানসিংহকে পাঠিয়েছিলেন এই বাংলাদেশে। গ্রামবাংলার সাধারণ কৃষককুল নিয়ে গঠিত বারো ভুঞার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর ঈসা খাঁর দুর্ধর্ষ বাহিনীকে দমন করতে গিয়ে রাজা মানসিংহের অপরাজেয় বাহিনী যত্রতত্র হেস্তনেস্ত হয়েছিল। সম্মুখ সমরে রাজা মানসিংহের তরবারি দ্বিখণ্ডিত করলেন ঈসা খাঁ । এতে বাঙালি মায়ের চেয়ে আফগান মাতা অনেক বেশি গৌরবান্বিতা হলেন সন্দেহ নেই। তথাপি ছোট ছোট নৌযানে ঈসা খাঁর সেই ক্ষুদ্র অথচ সুগঠিত বাহিনী কীভাবে বিশাল মুঘল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিল। ইতিহাসে তার অংশবিশেষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। ইতিহাসে বাংলার সেই বীর সেনানীদের কথা খুব সামান্যই লেখা আছে। তবে কিংবদন্তি হয়ে আজো সেই কাহিনী সজীব হয়ে আছে। বিজ্ঞ মানসিংহ বাংলা জয়ের আশা পরিত্যাগ করে দিল্লিতে বার্তা পাঠালেন–সামরিক বাহিনী দিয়ে বাংলা জয় সম্ভব নয়। বরং শুধু ভালোবাসা দিয়ে বাংলাকে জয় করা সম্ভব। মহামতি আকবর ভালোবাসা দিয়ে বাংলাকে অভিভূত করে ফেললেন। সেই থেকে বাংলার সঙ্গে দিল্লির ভালোবাসার লেনদেন শুরু।

মানসিংহ-ঈসা খাঁর যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পরিপূর্ণভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারির ঘাত-প্রতিঘাতে বাংলার সাধারণ মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি পেল; কিন্তু ভাগ্যের ফের। কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে বাংলা সম্বন্ধে রাজা মানসিংহের সেই ঐতিহাসিক উপলব্ধি যা সম্রাট আকবর বিজ্ঞ রাজনীতিবিদেয় মতো সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, সেই উপলব্ধি ব্ল্যাক ডগ পিপাসু, অতিরিক্ত উর্বর মস্তিষ্কের অধিকারী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উষ্ণ স্নায়ুতে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। ইয়াহিয়া ইতিহাস থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নেয়ার অবসর পেল না-সম্ভবত শরীরের নীল রক্তের গরিমায় গর্বিত আর বহুল প্রচারিত আমদানিকৃত প্ৰবাদ ‘বাঙালিরা যোদ্ধা নয়’ একে বেদবাক্যরূপে গ্ৰহণ করায়। ইয়াহিয়া তার আত্মম্ভরিতার জন্য প্ৰচণ্ডভাবে আক্কেলসেলামী দিল। ইয়াহিয়া ভুলে গিয়েছিল, শুধু বাংলার মাটিতেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্ম হয়, যেমন করে জন্ম নিয়েছিল তোপের মুখে উড়ে যাওয়া শহীদ তিতুমীর আর ফাঁসির মঞ্চে ঝুলন্ত অমর সূর্যসেন। এ বাঙালিরা ধুকে ধুকে মরে না, মরে মাঠে-ময়দানে। পৌরুষের ব্যঞ্জনা এদের প্রতি অঙ্গে। এরা জাগ্ৰত জনতার মূর্ত

স্বাধীনতা ৪

৪৯

প্রতীক। অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের আলো-‘পরশুরামের কুঠার’। এবারের মুক্তি সংগ্রামে শক্রর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই শুরু করি জুলাই ’৭১-এর পর থেকে। এর আগে আমরা ছিলাম ডিফেন্সে আর শক্ররা আমাদের ওপর আক্রমণ করত। বিলোনিয়া যুদ্ধের পর থেকে শক্ররা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ভূমিকা গ্রহণ করে আর আমরা আক্রমণকারীর। আমাদের ব্রিগেডের (জেড ফোর্স) প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করেন মেজর মাইন-উল হোসেন চৌধুরী, (১ম ইস্ট বেঙ্গল)। ডেল্টা কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ ও ব্ৰেভো কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ এ আক্রমণের ব্যুহ রচনা করেন। আর ক্যাপ্টেন মাহবুব (যিনি পরে সিলেটের রণাঙ্গনে শহীদ হন) কাট অফ পার্টি নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে শত্রুর ডিফেন্সের পেছনে। আক্রমণ করাকালে একটি বস্তুর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তাহলো সিংহ-হৃদয়। ডিফেন্সে যারা থাকে তারা বাঙ্কারে থাকে; ফলে স্বভাবতই ছোট ছোট হাতিয়ার এমনকি ডাইরেক্ট আটিলারি শেল থেকে রক্ষা পায়। সেজন্যই সাধারণত দেখা যায়, একটি ডিফেন্সকে আর্টিলারি থেকে শুরু করে ট্যাংক ও বিমান হামলা করে সেই ডিফেন্সটিকে তছনছ করে ফেলার পরও মাত্র দু’একজন সাহসী যোদ্ধা অকুতোভয় মনোবলে বলীয়ান হয়ে বাঙ্কার থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে মাথা নিচু করে মুখ থুবড়ে পড়ে না থেকে আক্রমণকারীর ওপর পাল্টা গুলিবর্ষণ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসা আক্রমণকারীর আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দেয়। তার প্রধান কারণই হচ্ছে আক্রমণকারীর এসেম্বলি এরিয়া পর্যন্ত লুকিয়ে আসে। কিন্তু এফইউপি’র পর থেকে সোজা দাঁড়িয়ে সঙ্গীন উচু করে লক্ষস্থলের দিকে এগিয়ে যায়। এই এফইউপি (ফমিং আপ প্লেস) সাধারণত লক্ষস্থল (টার্গেট) থেকে পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ গজ দূরে হয়ে থাকে। পদাতিক বাহিনী এই দূরত্ব তিন মিনিটে একশ’ গজ এই হিসাবে অতিক্রম করে, ফলে বিশ থেকে ত্ৰিশ মিনিট পর্যন্ত শক্রির ছোট ছোট হাতিয়ার থেকে শুরু করে মাটিতে পোতা মাইন আর পেছন থেকে নিক্ষিপ্ত আর্টিলারি ফায়ার, এমনকি ট্যাংক ও বিমান হামলা সবকিছুর টার্গেট হয়েও পায়ে পায়ে এগুতে থাকে। তাই বুঝি বলা হয়, যে সৈন্যদল কমান্ডারের হুকুমে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস রাখে, আর সাহস রাখে বলেই যুদ্ধের ময়দানে আক্রমণকারী সৈন্যদল হলো সবার সমস্যা। লাল, নীল আর সবুজ রঙের বাহার সে সালামকে ভূষিত করা যায় না। সে সালাম রক্তাক্ত দেহের রঞ্জিত হস্তের সংগ্রামী সালাম। শহীদের রক্তের মতোই শাশ্বত অমর সে সালাম। অন্যদিকে, প্রথাগত প্রতিরক্ষা অবস্থান আক্রমণ করাতে ঝুকি আরো অনেক বেশি, কারণ শত্রু শুধু সব ধরনের আত্মরক্ষামূলক পদ্ধতিতে বলীয়ান নয়। বরং সব ধরনের আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্য সর্বদা প্ৰস্তুত থাকে। সেজন্যই সাধারণত একটি লোক ডিফেন্সে থাকলে তিনটি লোক তাকে আক্রমণ করতে যেতে হয় এবং তিনটি লোক আক্রমণ করলেই যে আক্রমণ সার্থক হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে লোকটি ডিফেন্সে থাকে তার মনোেবল ভেঙে না পড়লে একের ওপর তিনের এ আনুপাতিক আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত সৈনিকের অভাবে এ অনুপাত আমরা কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারিনি।

৫০

ফলে অধিকাংশ সময় যেখানে কোম্পানি ডিফেন্সে থাকলে ব্যাটালিয়ন অ্যাটাক করা উচিত ছিল, সেখানে কোম্পানির ওপর কোম্পানি অ্যাটাক করেছে। সব ধরনের সুষ্ঠা আক্রমণই ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি পূর্বাহ্নে পরিকল্পনা গ্ৰহণ না করা হয়। আর সুষ্ঠা পরিকল্পনা নেয়া তখনই সম্ভব হয়, যখন কমান্ডার নিজে চুপি চুপি শত্রু শিবির দেখে আসে-মিলিটারি ভাষায় এই চুপি চুপি দেখে আসার নাম হচ্ছে ‘রেকি’ অর্থাৎ গা-ঢাকা দিয়ে শক্রির বাঙ্কার থেকে শুরু করে রসদপত্র আনা-নেয়ার রাস্তা, হাতিয়ারের ক্ষমতা, এসব কিছু জানলে আক্রমণের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা যায়। অবশ্য প্রায় প্রত্যেক লড়াইতে দেখা যায়, সাধারণত কমান্ডার নিজ প্ৰাণের মায়ায় চুপি চুপি শক্রর শিবির দেখা হতে বিরত থাকে।

বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ ছিলেন এক অভূতপূর্ব ব্যতিক্রম, অনন্য সাধারণ সৈনিক। পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে এসে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। যোগ দেওয়ার পর থেকে শক্রর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। ময়মনসিংহের কামালপুর বিওপি ছিল শক্ৰদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি কারণ জল ও স্থল উভয় পথে জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা সড়কের প্রবেশদ্বারই ছিল এ কামালপুর। তাই শত্রুর এখানে বাঙ্কারগুলো অত্যন্ত মজবুত করে তৈরি করে। বাঙ্কারের প্রথম আস্তরে মাটি ও টিনের দেয়াল, তারপর ছয় ইঞ্চি থেকে এক ফুট ব্যবধানে রেলের লোহার বিম। এই একই প্রকার ব্যবধানে পাকা সিমেন্টের আস্তর। বাঙ্কারের ওভারহেড কাভারের বেলায়ও একই প্ৰকার প্রস্তুতি নেয়া হতো-প্ৰত্যেকটি বাঙ্কারই প্ৰায় ঘরের মতো উচু, অন্যদিকে সব ডিফেন্স টানেলের মারফত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল; এদিকে মাইন, বুবিট্রেপ ও বাঁশের কঞ্চি ডিফেন্সটিকে দুৰ্ভেদ্য দুর্গের মতো করে রেখেছিল। পরপর দুদিন রেকি করার পরও সালাহউদ্দিন স্বচক্ষে শত্রুশিবির দেখার জন্য লে. মান্নানকে সঙ্গে করে তৃতীয়বারের মতো রেকি পেট্রোল নিয়ে নিজে শক্রশিবিরের দিকে গেলেন। বিওপির কাছে পৌছে জমির আইলের ওপর লে. মান্নান, সুবেদার হাসেম, নায়েক সফি ও দলের অন্য সবাইকে রেখে শুধু সুবেদার হাইকে সঙ্গে করে শক্রর বাঙ্কারগুলো রেকি করতে গেলেন। বলাবাহুল্য, পাকিস্তানিরা রাতে সব সময় সেকেন্ড লাইন ডিফেন্সে চলে যেত। কামালপুর রণাঙ্গনে শক্রিরা সাধারণত দিনের বেলায় অনেক এলাকাজুড়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকতো, কিন্তু রাতেরবেলায় দূরের বাঙ্কারগুলো ছেড়ে দিয়ে ছোট। অথচ ঘন ডিফেন্সে চলে যেত। খালি বাঙ্কারগুলো দেখে সালাহউদ্দিন ও হাই আরো ভেতরে চলে গেলেন। এমতাবস্থায় দু’জন শক্রসেনা সম্ভবত পেট্রোলিং করে ফিরে আসার সময় এদের দু’জনের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। একশ’ পাঁচ পাউন্ড ওজন আর ৫’-৫”। উচ্চতা বিশিষ্ট ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছয়ফুট লম্বা খান সেনার ওপর, যার হাতে জি-থ্রি রাইফেল ছিল। খানসেনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সানু খালেদ হু’ (আমি খালেদ) বলে নিজেকে সঙ্গীর কবল থেকে ছাড়াতে গিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারল যে, আসলে তারা মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খান সেনা সালাহউদ্দিনের হালকা দেহ মাটিতে ফেলে দিয়ে গলা টিপতে শুরু করে। সালাহউদ্দিন মান্নান’ বলে চিৎকার করে উঠলেন,

৫১

মান্নান ছুটে এলো। স্টেন ধরে জিজ্ঞাসা করল, “উপরে কে? সালাহউদ্দিন গোঙানীর স্বরে বলল “উপরেই তো ওই শালা’। লে. মান্নান গাব গাছের নিচে তাড়াতাড়ি পজিশন নিলেন। এদিকে সুবেদার হাইকে ‘হ্যান্ডস আপ” বলার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলেরা বাঁট দিয়ে আঘাত করে খানসেনার জি-থ্রি রাইফেল কেড়ে নিলেন, কিন্তু খানসেনা মুহুর্তের মধ্যে পেছনের বাঙ্কারে ঢুকে পড়লো। আর নায়েক শফি, যে এতক্ষণ ইতস্তত করছিল গুলি করবে। কী করবে না (কেননা ঘুটফুটে অন্ধকারে কার গায়ে গুলি লাগবে বলা মুশকিল), মুহূর্তের মধ্যে ধাবমান শত্রুর দিকে গুলি ছুড়ল, অবশ্য গুলি হাই এবং খানসেনার অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেনি বলে বা পাশের দালানে গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে হাই বাঙ্কার লক্ষ্য করে স্টেনের এক ম্যাগাজিন গুলি ছুড়লো। গুলি ছুড়ে জি থ্রি রাইফেলসহ ক্যাপ্টেন সালাহউদিনের দিকে এগিয়ে এলো। গাব গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মান্নান আস্তে জিজ্ঞেস করল ‘কে? তুরিত বেগে “আমি হাই’ বলে সালাহউদ্দিনের ওপরে অবস্থানরত খানসেনাকে স্টেনের ব্যারেল দিয়ে গুতো দিলো। ওপরের লোকটি সালাহউদ্দিনকে ফেলে দৌড়াতে শুরু করলো। সুবেদার হাই ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। অতঃপর রাইফেল দুটি নিয়ে তুরিত বেগে শত্রুশিবির ত্যাগ করে। এদিকে রাইফেল চেক করে দেখা গেল। যদিও জি থ্রির চেম্বারে গুলি ভরা ছিল না। কিন্তু থ্রি নট থ্রি রাইফেলের চেম্বারে গুলি ভরা ছিল। সালাহউদ্দিন হেসে বলল, “শালার বেটা ভড়কে না। গেলে আমাকে অতি সহজেই মারতে পারতো।‘

 

কামালপুর বিওপি আক্রমণ

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসে সালাহউদ্দিনের সাহস গেল আরো বেড়ে। এ রেকি পেট্রোল থেকে দুটি জিনিস বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়; তাহলো সুবেদার হাই ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের অদম্য সাহস ও অদ্ভূত প্রত্যুৎপন্ন-মস্তিষ্ক। শফি ও লে. মান্নানের ঠাণ্ডা মাথায় অবস্থার মোকাবেলা করার সাহস। কিন্তু এতে আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয়তা প্ৰকাশ পায় যে, মুক্তিবাহিনীর আক্ৰমণ আসন্ন, ফলে রাতারাতি শত্রু তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে ফেললো। তাতে করে কামালপুরে পাক বাহিনীর ৩১ বেলুচ ব্যাটালিয়নের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো দুই কোম্পানি (রাজাকার ছাড়া)। এজন্য বলা হয়, রেকি পেট্রোলের সময় শক্রর সামনাসামনি হওয়াকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হয়। দুদিন পর ৩০-৩১ জুলাই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আঁধারে রওনা হলো। প্ৰথমে সালাহউদিনের ডেল্টা কোম্পানি, ফলোআপ কোম্পানি হলো ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রাভো’ যার পিছে হলো ব্যাটালিয়ন “আর’ গ্রুপ এবং “আর’ গ্রুপে ছিলেন মেজর মাইন এবং সঙ্গে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। সম্ভবত ব্রিগেডের প্রথম অ্যাটাক সরেজমিনে তদারক করার জন্য মেজর জিয়া নিজেও অ্যাটাকিং ট্রপসের সঙ্গে রওনা হন। আক্রমণের “এইচ আওয়ার’ ছিল ৩০/৩১শে জুলাইয়ের রাত ৩-৩০ মিনিট। কিন্তু গাইডের অভাবে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল এফইউপিতে সময়মতো পৌছতে পারেনি, যার ফলে ৩০-৫০ মিনিটে সময় টাইম প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমাদের নিজস্ব আর্টিলারি ফায়ার যখন

৫২

শুরু হয় তখনো আমাদের ছেলেরা এফইউপিতে পৌছার জন্য প্ৰাণপণ দৌড়াচ্ছে। কাদামাটিতে এতগুলো লোকের এই দৌড়াদৌড়ির ফলে যথেষ্ট শব্দ হয়, ফলে দুশমনের পক্ষে আক্রমণের দিক নির্ধারণ করা একেবারে সহজ হয়। নিমিষের মধ্যে তাদের আর্টিলারি ফায়ার এসে পড়তে থাকে। এদিকে প্লাটুন পর্যায়ে ডেপথ টু আপ হওয়ার ফলে লোক আগে-পিছে হয়ে যায়, ফলে কমান্ড ও কন্ট্রোল কায়েম করা ভয়ানক মুশকিল। হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এসেম্বলি এরিয়া থেকে পূর্বনির্ধারিত এফইউপিতে আসায় মাঝপথে আমাদের নিজস্ব আটিলারি ফায়ার শুরু হওয়াতে ১ম ইস্ট বেঙ্গল তৎক্ষণাৎ সে অবস্থাতেই কোনোক্রমে ফর্ম আপ হতে থাকে, ফলে সে কী চিৎকার আর হট্টগোল। আবার দিকনির্দেশনার অভাবে অ্যাডভ্যান্স করাকালীন একে অন্যের ওপর চড়ে বসে। আর অপেক্ষাকৃত নিচু কর্দমাক্ত জমির ওপর আসার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি ও আমাদের যুগ আর্টিলারির ক্রস ফায়ারিংয়ের নিচে আসার ফলে আমাদের বেশকিছু ছেলে হতাহত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওয়্যারলেস সেট জ্যাম হওয়াতে সংযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়, তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌছায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, হাটবাজার বসেছে আর নীলকর আদায়কারী উট সাহেবদের দেখে কে কোথায় পালাবে পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এ অবস্থায় ১ম ইস্ট বেঙ্গলের পক্ষে আক্রমণের বৃহ রচনা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। বরং সৈন্যদলের পক্ষে পিছিয়ে আসাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কারণ আক্রমণকারী সেনাদল যদি ঠিকমতো ফর্ম আপ না হতে পারে। তবে তাদের পক্ষে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে মেজর জিয়াউর রহমান বাঘের মতো গর্জে উঠলেন ‘কাম অন, এট এনি কস্ট উই উইল লঞ্চ দি অ্যাটাক” । মেজর মাইন ওয়্যারলেস ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন। আর ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও হাফিজ একপ্ৰান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একদিকে ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটল প্রসিডিউরের চামড়া পর্যন্ত তুলে ফেলছে, অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মেঘাফোনে বাংলাইংরেজি-উর্দুতে মিশিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল তার সৈন্যদলকে। কারো বা কলার ধরে লাইন সোজা করে দিচ্ছে আর কাউকে বা হাফিজ স্টেনের বঁাট দিয়ে মারছে। মুঘল রাজপুতের প্রথম যুদ্ধে আশিটি যুদ্ধবিজয়ী রানা সংগ্রাম সিংহের রণভিজ্ঞ সৈন্যবাহিনীকে দেখে আকারে ছোট মুঘল বাহিনী ভড়কে গিয়েছিল যুদ্ধের প্রারম্ভেই; কিন্তু ভেলকিবাজির মতো বাবর সে সৈন্যবাহিনীকে বাগে এনে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। তাই সামরিক নেতা হিসেবে ইতিহাসে বাবরের স্থান অতি উচুতে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন হাফিজের কৃতিত্ব বুঝি সেখানেই। চরম বিশৃঙ্খলার মাঝে শুধু মনের জোর ও অদম্য সাহসে বলীয়ান হয়ে সালাহউদ্দিন ও হাফিজ সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজ নিজ কোম্পানিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করতে সক্ষম হন এবং নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য আক্রমণ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের ময়দানে ফলাফলটা সব সময় সবকিছুর পরিমাপ নয়, বরং ঘটনাটি কীভাবে ঘটিত হলো সেটাই সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়।

এফইউপির চরম বিশৃঙ্খলা থেকে সামান্য রেহাই পেয়ে ১ম ইস্ট বেঙ্গল সবেমাত্র অগ্রসর হয়েছে, অমনি পাকিস্তানি আর্টিলারির সেলভো ফায়ার এসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে

৫৩

আমাদের হতোদ্যম সৈন্যরা মাটিতে শুয়ে পড়ল। শেষ মুহূর্তে বুঝি আর আক্রমণ করা সম্ভব হলো না দেখে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে সমগ্র বাঙালি জাতির মান-ইজতের প্রশ্ন, অন্যদিকে ২শ’ ছেলের জীবন। সালাহউদ্দিন তখন মারছে লাথির পর লাথি । কারো বা কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল ‘বেশরাম, বেগায়রত, শালা নিমক হারামের দল, আগে বাড়’। আবার সৈন্যদলের মন চাঙ্গা করার জন্য নিজের অবস্থা জাহির হয়ে যাবে জেনেও পাক বাহিনী লক্ষ্য করে মেগাফোনে উর্দুতে বলছিল, “আভিতক ওয়াকত হ্যায়, শালালোক সারান্ডার করো, নেহিত জিন্দা নেহি ছোড়েঙ্গে’ । তার পরের ইতিহাস প্রতিটি বাঙালির গৌরবের ইতিহাস। এ যেন শুধু ইতিহাস নয়, মুক্তিকামী মানুষের প্রাণবন্যার ইতিহাস। সৈন্যরা তখন ছুটছে “ঝড়ের মতো করতালি দিয়ে স্বৰ্গমর্ত করতলে’ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার মতো। ১ম ইস্ট বেঙ্গল মুহূর্তের মধ্যে ভাসিয়ে দিল পাক বাহিনীর ডিফেন্সের প্রথম সারির বাঙ্কারগুলো। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো গুরুগার্জন করে। সিনিয়র টাইগার ‘জয় বাংলা’ আর ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে প্ৰকম্পিত করে তুললো যুদ্ধের ময়দানকে। বাঙ্কার অতিক্রম করে বিশ-পঁচিশটা ছেলে কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়লো। যাদের ভেতর মাত্র দু’একজন আহত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছিল আর বাকি সবাই হাতাহাতি যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। প্রচণ্ডভাবে তখন হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। বাঘের থাবাতে যত্রতত্র ভূপাতিত পাকসৈন্যরা। পেছনে তখন আমাদের পক্ষের লাশ আসা শুরু হয়ে গেছে। মেজর জিয়া তখন বলছেন, “আই উইল একসেপ্ট নাইনটি ফাইভ পারসেন্ট ক্যাজুয়ালটি-বাট প্রেস দেম আউট, মইনা।’ আহত ক্ষতবিক্ষত জওয়ানরা বলছে, ‘স্যার নিয়ে এলেন কেন? আর সামান্য বাকি-কী হতো আমি না হয় মরে যেতাম’ গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল। এদিকে মাইন ফিন্ডে ফেসে যাওয়া সুবেদার মাইনই ফিন্ডের পেছনের বাঙ্কারগুলো ছেড়ে দিয়ে আরো পেছনে সেকেন্ড লাইনে সরে গিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের মেগাফোনে হাইকে বললেন, “হাই প্লাটুন নিয়ে ডানে যাও”। প্রথম আক্রমণ শুরুকালে সুবেদার হাইয়ের লোকসংখ্যা ছিল ৪০ জন; কিন্তু লক্ষে পৌছা পর্যন্ত সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ থেকে ২০ জনে। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়ক সফির হাত উড়ে গেল আর ধাবমান শক্ৰদের পিছু নেয়াকালে জওয়ানরা বারবার সালাহউদ্দিনকে অনুরোধ করল, “স্যার পজিশনে যান’। সালাহউদ্দিন ধমকে উঠল, “বেটা স্যার স্যার করে চিৎকার করিস না। শক্রিরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে, চিন্তা করিস না, তুই বেটা আমার কাছে এসে দাঁড়া, গুলি লাগবে না, ইয়াহিয়া খান আজো আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি”। দুদিকে বৃষ্টির মতো গুলির মাঝে দাঁড়িয়ে একথা বলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাই বুঝি আজো ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের প্রাণপ্ৰিয় সালাহউদ্দিনকে। দ্বিতীয়বার মেগাফোনে ‘হাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন সালাহউদিনের সামনে দু’তিনটি শেল এসে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে সালাহউদ্দিন ধরাশায়ী হলেন। তার দেহটা প্ৰথমে বামে, পরে আধাডানে ও শেষে দাড়াম করে পেছনের দিকে পড়ে গেল।

৫৪

আশপাশের জওয়ানরা ছুটে এসে বলে, ‘স্যার কলেমা পড়ুন’। কিন্তু বাংলার একান্ত গৌরব সালাহউদ্দিন উত্তর দিল, “কলেমা পড়ার দরকার নেই। খোদার কাছম, যে পেছনে হটবি তাকে গুলি করবো”। তারপর বিড়বিড় করে আবার বলে উঠলেন, “মরতে হয় এদের মেরে মর, বাংলাদেশের মাটিতে মর”। এমন মরণ দুনিয়ার ইতিহাসে যে বিরল তা নয়, তবে এ মৃত্যুতে আনন্দ আছে, গর্ব আছে, যা সহজে করা যায় না। উচু মাটির ঢিবিতে পড়ে থাকা সালাহউদিনের লাশটাকে দুজন সৈনিক শক্রির এলাকা থেকে টেনে আনতে চেষ্টা করলো; কিন্তু ব্যর্থ হয়ে দু’জনই মৃত্যুবরণ করে। সালাহউদ্দিনের গায়ে তখনো সেই সাদা শার্টটি ছিল, যা তার খুলে ফেলার কথা ছিল, কারণ সাদা শার্ট রাতেরবেলায় বেশি দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত সালাহউদ্দিনের ঘড়ি, স্টেন ও অন্যান্য কাগজ নিয়ে আসা হয়। ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে । হাতের স্টেন তোপের মুখে উড়ে গেলেও সামান্য আহত হয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বেঁচে গেলেন। মেজর মইন যুদ্ধের ময়দানে প্ৰচণ্ড গোলাগুলির মাঝে একটি গাছকে আড়াল নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দিচ্ছিলেন। এফইউপি থেকে লেফটেন্যান্ট মান্নান এগিয়ে এলেন কমান্ডিং অফিসারকে সাহায্য করতে। হঠাৎ করে একটা গুলি লে. মান্নানের উরু, ভেদ করে চলে গেল। এদিকে এফইউপিতে ব্যাটালিয়ন অ্যাডজুটেন্ট ফ্লাইং অফিসার লিয়াকত (পাইলট) সামান্যর জন্য আর্টিলারির শেল থেকে বেঁচে গেলেন। অন্যদিকে আহত ক্যাপ্টেন হাফিজের ওয়্যারলেস সেট নিরাপদ জায়গায় রেখে পুনরায় হাফিজকে উদ্ধারকল্পে ল্যান্স নায়েক রবিউল ছুটিল শক্ৰ অভিমুখে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দু’হাতেই গুলি এসে লাগল, তথাপি তার প্রাণপ্ৰিয় ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধার সংকল্প থেকে এতটুকু টলাতে পারেননি। যথাস্থানে পৌছে দেখে হাফিজকে অন্য কেউ নিয়ে গেছে। পড়ে থাকা ওয়্যারলেস ও রকেট লঞ্চার ওঠাবার সময় ল্যান্স নায়েক রবিউলের বুকে গুলি লাগল। রবিউল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল। পাশের জওয়ান সাহায্যের ভয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রাগে-দুঃখে রবিউল গ্রেনেড হাতে নিয়ে (উদ্দেশ্য বন্দি হব না) জীবনের আশা ত্যাগ করে নিকটবতী আখ ক্ষেতের দিকে দিল ভোঁ দৌড়। বৃষ্টির মতো শত্রুর গুলি আসছিল। কিন্তু আশ্চৰ্য, রবিউলের গায়ে লাগল না। কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে আখ ক্ষেতে গিয়ে পৌছলেই রবিউলের প্রতীতি জন্মালো সে সহজে মরছে না। আর অন্যের সাহায্য ব্যতীত সে বাঁচতে পারবে। বা হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ডান হাতের হাড়টি বের হয়ে আছে। নাকে-মুখে রক্তের ছোপ-এ অবস্থায় পালিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এসেছিল গ্রামের গৃহবধূরা, যদিও গৃহস্বামীরা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। নিজের সাখী যখন মুখ ফিরিয়ে চলে গেল তখন সে আর কারো সাহায্য প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূদের হাত ছাড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু পরের ইতিহাস আজো তার কাছে ঝাপসা হয়ে আছে। তার বিশ্বাস, দুই রমণীর কাধে ভর দিয়ে সে। এফইউপির এরিয়া পর্যন্ত পৌছাতে পারবে। এদিকে সালাহউদ্দিনের মৃত্যুর পর আমাদের সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও সেই ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছোট ছোট গ্রুপে ওরা শক্রির বাঙ্কারগুলোর ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। বেলা তখন ৭টা

৫৫

বাজে। অযথা লোকক্ষয় না করে পশ্চাদপসারণ করা শ্ৰেয় জেনেও মেজর মাইন তার সৈন্যদলকে কিছুতেই পশ্চাদপসরণ করতে পারছিলেন না, আমাদের আর শত্রুর লাশে কমিউনিটি সেন্টার ভরে গেল-শেষ পর্যন্ত বেলা সাড়ে ৭টার দিকে আমাদের সৈন্যদল পশ্চাদপসরণ করে। এ যুদ্ধে আমাদের একজন অফিসারসহ ৩২ জন নিহত কিংবা নিখোেজ, আর দু’জন অফিসারসহ ৬৬ জন আহত হয়। শক্ৰদের লাশের সংখ্যা ৩ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যেতে গ্রামের লোকেরা দেখেছে। পরদিন হেলিকপ্টারে পাক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা সম্ভবত জিওসি আসেন কামালপুর পরিদর্শন করতে। বলাবাহুল্য, ওইদিনই পাক বেতারে কামালপুর যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়, প্রায় চারশ’ দুষ্কৃতকারী নিহত হয়েছে। এক অপারেশনে এত বড় সংখ্যক দুষ্কৃতকারীর নিহত হওয়ার সংবাদ ইয়াহিয়া বেতারে আর কখনো প্রচার করা হয়নি।

বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণ

জেড ফোর্সের দ্বিতীয় আক্রমণ পরিচালনা করেন মেজর শাফায়াত জামিল (৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ৩১ জুলাই ১৯৭১ সালে প্ৰায় ৩৫০ জন লোক নিয়ে দেওয়ানগঞ্জবাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের জন্য ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে রওনা হন। ওই অঞ্চলের একজন আইএ পাস ছেলে বরারামপুর গ্রামের নাসের ছিল এই আক্রমণের পথ প্রদর্শক। যার দূরদর্শিতার ফলে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৩টি বড় বড় নদী ক্ষিপ্ৰগতিতে সবার অগোচরে ১১টি নৌকাসহ অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং গানবোটে পাহারারত পাকসৈন্যদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে পাশ কেটে ১৫/২০ মাইল পথ নিরাপদে অতিক্রম করে রাত তিনটার সময় পূর্ব নির্দিষ্ট এফইউপিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের অধীনে আলফা কোম্পানি নীেকাঘাটে পাহারারত থাকে আর ১২ নাম্বার প্লাটুন ইপিআরের নায়েব সুবেদার আলী আকবরের অধীনে কাট অব পার্টির কাজ করে। ডি কোম্পানি লে. নুরুন্নবীর অধীনে বাহাদুরাবাদ ঘাটে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। নায়েব সুবেদার বুলু মিয়া ১১ নাম্বার প্লাটুন নিয়ে যায় যাত্রীবাহী ট্রেনের দিকে। আর সুবেদার করম আলী ১০ নাম্বার প্লাটুন নিয়ে যায় রেলওয়ে ট্রেনের জেটির দিকে। তখন ভোর হয় প্রায়। রেললাইনের পাশে দুশমনরা তখন স্ট্যান্ড টুর জন্য প্ৰস্তুত হচ্ছিল। এদিকে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন তখন রেললাইনের ওপর শানটিং করছিল। গাড়ি শানটিং করে পিছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার করম আলী, প্লাটুনের রকেট লঞ্চারটি নিজে কাধে করে এগিয়ে প্রথম মালগাড়িতে অবস্থানরত জেনারেটর এবং পরমুহূর্তে অগ্রসরমান শানটিং গাড়ির ইঞ্জিনকে ফায়ার করে অকেজো করে দেন আর সঙ্গে সঙ্গে ডানে অবস্থানরত সুবেদার ভুলু মিয়ার প্লাটুন ফায়ার শুরু করে এবং গ্রেনেড পার্টি রেলের প্রত্যেক কামরায় গ্রেনেড ছুড়তে শুরু করে। প্ৰায় প্রত্যেক কামরাতেই ৩/৪ জন খাকি পোশাক পারহিত লোক শুয়ে ছিল। এদিকে অ্যাকশন পার্টি উইড্রলের সঙ্গে সঙ্গে ৩” মর্টর গর্জে ওঠে, ফলে স্থায়ীভাবে যে দু’টি ফার্স্টক্লাস কামরা আমি গার্ডের জন্য রাখা হয়েছিল তা ধসে পড়ে, এছাড়া রেলওয়ে বগি এবং ঘাটে অবস্থানরত মালগাড়ি বহনকারী স্টিমার এবং জেটির ছাদের ওপর দুশমনের

৫৬

মেশিনগানের বাঙ্কার ভীষণভাবে বিধ্বস্ত হয়। স্টেশন এরিয়া থেকে উইড্র করাকালীন দুশমনের একটি গুলি নায়েব সুবেদার বুলু মিয়ার বাম বাহুতে লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। এই আক্রমণকালে নায়েব সুবেদার বুলু মিয়া ছাড়া আমাদের পক্ষে কেউ হতাহত হয়নি। পরদিন সুবেদার করম আলীর পার্শ্ববতী ব্রিজ উড়ানোর আওয়াজ শুনে দেওয়ানগঞ্জে অবস্থানরত পাক সৈন্যরা বাহাদুরাবাদ ঘাটের দিকে ধাবমান হলো। সঙ্গে সঙ্গে আলফা ও ডেল্টা কোম্পানি ক্ষিপ্ৰগতিতে দেওয়ানগঞ্জ বাজার, সুগার মিল ও রাজাকার হেডকোয়ার্টার পর্যায়ক্রমে আক্রমণ করে সেই এলাকা সম্পূর্ণভাবে তছনছ করে। তিনদিন বিজয়ের বেশে অবস্থান করার পর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিজ ক্যাম্পে ফেরত আসে। এই আক্রমণটিকে একটি পরিপূর্ণ আক্রমণ না বলে রেইড বলা অধিক সমীচীন। এই সফলতার প্রধান কারণ হচ্ছে চৌকস গাইড ধীরস্থির ও সিংহহৃদয়ের অধিকারী মেজর শাফায়াত জামিলের সৃষ্ট পরিকল্পনা ও দক্ষ পরিচালনা এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক অধিক সংখ্যায় থাকার জন্য ব্যাটেল প্ৰসিডিউর, মোতাবেক কার্যক্রম বাস্তবায়িত করতে পেরেছিল বলেই। কিন্তু পূর্ববর্ণিত ১ম ইস্ট বেঙ্গলের কামালপুর আক্রমণ সার্থক আক্রমণ বলা চলে না, কারণ এলাকা দখল করে নিজেদের কব্জার মধ্যে রাখার প্রয়াস আমরা করিনি। বরং ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের মৃত্যুর পরপরই শত্রুরা ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে আমাদের পাল্টা আক্রমণ করে, ফলে আমাদের হতোদ্যম ক্ষত-বিক্ষত সৈন্যরা আরো ভড়কে যায়, যার ফলে সালাহউদ্দিনের লাশটাও ফেরত আনা সম্ভব হয়নি-এমন প্ৰচণ্ড আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েও অতি অল্পসময়ের মধ্যেই শত্রদের এই পাল্টা আক্রমণ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। এ ধরনের আত্মরক্ষামূলক মনােভাবকে মিলিটারি ভাষায় “এগ্রেসিভ ডিফেন্স’ বলা হয়। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আক্রমণ, যেহেতু ডেলিবারেট ছিল সেহেতু আর্টিলারি ফায়ার ছিল টাইম প্রোগ্রাম অনুযায়ী। কিন্তু আক্রমণকালে এ জিনিসটা প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, ইঙ্গিতে বা “অনিকল’ রাখাই যেন ভালো ছিল। তাতে করে মনে হয়। মাঝপথে আটিলারির ক্রসফায়ারে যে হতাহত হয়েছিল তা এড়ানো যেত। এতদসত্ত্বেও কামালপুর আক্রমণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চমকপ্রদ অধ্যায়ের সূচনা করে। এই আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত রেইড ও অ্যাম্বুশ করা ছাড়া বাঙ্কারে বসে থাকা শক্রির বিরুদ্ধে পরিপূর্ণভাবে মুখোমুখি লড়াইতে আমরা অবতীর্ণ হইনি। কিন্তু এই আক্রমণেই প্রমাণিত হলো, বাঙালিরা ব্রিজ উড়াতে কিংবা রাতের আঁধারে রেইড ও অ্যাম্বুশ করতে যেমন পারদশী তেমনি হাতাহাতিযুদ্ধেও সমপারদশী। ওই সময় এমন একটি অ্যাকশনের দরকার ছিল-কারণ তখন পর্যন্ত খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমরা পিছু হটতে হটতে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে বাধ্য হই। ফলে স্বভাবতই মনোেবল কিছুটা ভেঙে পড়ে। তাই মনোেবল চাঙ্গা করার জন্য বিশেষ করে আমাদের স্বল্প ট্রেনিং প্রাপ্ত ছেলেদের মনে সাহস বাড়ানোর জন্য এবং এ বিশ্বাস জন্মানোর জন্য যে খানসেনাদের বাঙ্কার থেকে তাড়ানো তেমন কষ্টসাধ্য নয়, যদি কেউ গুলিকে ভয় না করে। সালাহউদ্দিন নিজের জান দিয়ে আমাদের মনে এ প্রতীতি জানিয়েছিলেন। নির্যাতিত, অবহেলিত ও পদদলিত মানবতার প্রতীক স্পার্টাকাস

৫৭

হয়তোবা নিজে মরে যায়। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে জন্ম নেয় নিম্পেষিত মানব আত্মার লেলিহান বহ্নিশিখায় ইতিহাসের অমর বীরেরা। তাই বুঝি সালাহউদ্দিনের মৃত্যু বাংলাদেশের অগ্ৰগামিতার অভিযানের এক স্বৰ্ণোৰ্জ্জুল অধ্যায়-আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।

 

নকশি বিওপি আক্রমণ

জেড ফোর্সের আক্রমণ পরিচালনা করেন মেজর আবু জাফর মোহাম্মদ আমিনুল হক। বৃহ রচনার দায়িত্বে নিয়োজিত হই আমি নিজে। অবশ্য ২ আগস্ট তারিখে আক্রমণ রহিত করা হয়। ৩ আগস্ট আমি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো ও ডেল্টা-এ দুই কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করি নকশি বিওপি। এর আগে আমি তিনদিন পুরো বিওপি রেকি করেছি। নকশি বিওপির পূর্বতন সুবেদার হাকিম ও তার সাথীরা আমাকে এ বিষয়ে সক্রিয় সাহায্য করেছেন। তার কারণ এই বিওপি তাদের নখদর্পণে ছিল। প্রথম দিন আমি নিজে সুবেদার হাকিমসহ নকশি বিওপির আশপাশ রেকি করি। একটি উচু টিলা থেকে। বাইনোকুলারে সুবেদার হাকিম আমায় বলেছিল কোথায় শক্ৰদের বাঙ্কার, কাঁটাতার, বাঁশের কঞ্চি, মাইন ফিল্ড, কুক হাউস, মসজিদ ও বিওপির প্রবেশপথ, কোথায় কত শান্ত্রী থাকতে পারে। তারপর গারো পাড়ায় গিয়ে চুপি চুপি দেখা করলাম। শত্রুশিবিরে আমাদের প্রেরিত বাবুর্চির সঙ্গে। বাবুর্চি বলল, ৪৫ জন আর্মির লোক আসছে এবং গোটা ৫০/৬০ জন রাজাকারও বিভিন্ন ডিউটিতে আছে। দ্বিতীয় দল প্লাটুন কমান্ডারকে নিয়ে আমি আবার স্বচক্ষে হালছটি গ্রাম, শালবন ও নালা পথ রেকি করে কোথায় কোন হাতিয়ার হবে এবং কোথায় এফইউপি হবে সবাইকে পায়ে পায়ে দেখিয়ে দিলাম। ১ আগস্ট আমি সব সেকশন কমান্ডারদের পুরো সেকশন কমান্ডারকে নিয়ে পূর্বনির্দিষ্ট জায়গায় আবার দেখিয়ে দিলাম যাতে করে রাতের আঁধারে ভুল না করে। এদিকে সাপোর্টিং হাতিয়ার মেশিনগান, ১০৬ মি.মি. ও ৭৫ মি.মি. আর আর এর জন্য বাঙ্কার বানানোর জন্য ২৫টি আড়াইমনি চটের বস্তা নিয়ে এলাম। এত প্ৰস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়েছিল শালবনের ঘন আড়ালের জন্যই। অবশ্য পাকিস্তানিরা উত্তরদিকে বিওপির চারিপাশে প্ৰায় ৬০০ গজ এলাকায় সব গাছপালা, জঙ্গল পরিষ্কার করে কিলিং জোনের ফিল্ড অব ফায়ার একেবারে সাফ রেখেছিল। তৃতীয় দিনে রেকি করাকালে হালছটি গ্রামের নালার পাশে আমরা একটি আমগাছের মাথায় লাল ফুলকে মানুষ মনে করে থমকে দাঁড়ালাম। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে একগাল হাসি হাসতে যাব এমন সময় ঝুপ করে একটি শব্দ হলো, মনে হলো একটি লোক নালার ভেতর দিয়ে পালাচ্ছে। আমার সেকশন কমান্ডাররা জড়সড় হয়ে একে অপরমুখী হয়ে পজিশনে গেল। দেখে পিত্তি জ্বলে গেল। আসলে তাদের আরো ছড়িয়ে পড়ে একে অপরের বিপরীত দিকে মুখ করে (ডায়মন্ড ফর্মেশন) অলরাউন্ড ডিফেন্স নেয়া উচিত ছিল। বুঝলাম আরো অনেক ট্রেনিংয়ের দরকার। ভাগ্যিস এই বুপ আওয়াজ হয়েছিল নালাতে পাড় ভেঙে ধসে পড়া মাটি থেকে, তা না হলে গোলগাল বসে থাকা আমার দলটিকে নিমিষের মধ্যে শেষ করে দেয়া একজন শক্রি-সৈন্যের পক্ষেই যথেষ্ট ছিল। ফেরত আসার সময় একটি গারো মেয়ে আমাকে দেখে ঝুপ করে পাহাড়ের গাছের সঙ্গে

৫৮

মিশে রইল। আমি ধারণাই করতে পারিনি যে, আমন ফাঁকা জায়গায় কোনো মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। আমি মেয়েটিকে পাশ কেটে চলে যাওয়ার পর যখন সুবেদার হাকিম ইশারায় আমায় দেখালো, আমি তো ‘থ”। ভাবলাম জঙ্গলে চলতে হলে এই জংলীদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

২ আগস্ট বিকেলে মেজর জিয়াউর রহমান স্বচক্ষে আমার প্ল্যান অনুযায়ী হাতিয়ারের অবস্থানগুলো দেখলেন। রাতে রাস্থা থেকে গাড়ি পড়ে যাওয়াতে যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় তখন ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন মাহবুব (যিনি পরে ৮ ডিসেম্বর ’৭১ সালে সিলেট রণাঙ্গনে শহীদ হন) আমাকে বলেন, ‘স্যার মনে কনফিউশন থাকলে অ্যাটাক করতে যাবেন না’। আমি হেসে বললাম, “বেওকুফের মতো মরতে আমি রাজি নই”। ৩ আগস্ট রাত ১২টার দিকে এসেম্বলি এরিয়া হতে রওনা হবো। দেখি বাহাদুরাবাদ ঘাট বিজয়ী বীর মেজর শাফায়াত জিপ নিয়ে হাজির, “আমিন রিমেম্বার, ডোন্ট গো ফর ইমপসিবল টাস্ক অল বাই ইওরসেলফ। অল দি বেস্ট।’ বলাবাহুল্য, আর্মিতে ইংরেজিতে কথোপকথনটা একটু বেশি বৈকি, যদিও মরার আগে আমরা বরাবরই বাংলায় চিৎকার দিয়েছি। এসেম্বলি এরিয়া হতে অত্যন্ত সাবলীল গতিতে আমার সৈন্যরা এফইউপিতে পৌছায়। এমনকি মাঝপথে নালা ক্রস করার সময়ও কোনো শব্দ করেনি, কারণ পূৰ্ববতী দুরাত বিনা শব্দে পানির ওপর চলার প্র্যাকটিসও করেছিলাম। অন্যদিকে একই সময় দুই প্লাটুন রাঙ্গাটিয়াতে যায় কাটঅফ পার্টি হিসেবে। যদিও ইপিআর গাইড ছিল, তথাপি মনে হয়। এফইউপি মার্কিং করলে যে সামান্য বিশৃঙ্খলাটুকু হয়েছিল তাও হতো না। সৈন্যরা যখন এফইউপিতে যাচ্ছে আমি তখন ৮/১০ জন গণযোদ্ধা নিয়ে মেশিনগান ও আরআর-এর এমুনেশন বাঙ্কারে পৌঁছিয়ে দিই। উদ্দেশ্য ওদের মনে সাহস জোগানো, কারণ যুদ্ধেও ফলাফল এদের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছিল। বাঙ্কারের পেছনে অবস্থানরত সুবেদার হাকিম তখন রীতিমতো ক্ষেপে গেছেন। কারণ ইনি নিজে তো খাবার পাননি নিজের ছেলেরা যারা সারারাত ওই আড়াইমনি বস্তায় বালি ভরে বাঙ্কার বানিয়েছে ওরাও পায়নি। দেমাক ঠাণ্ডা রেখে বললাম, ‘সাব ভুলি নাই। তবে আপনাদের রুটি পেছনে এসেম্বলি এরিয়াতে রয়ে গেছে, কাউকে পাঠিয়ে দিয়ে নিয়ে আসেন”। এফইউপিতে আমার কমান্ডিং অফিসার মেজর আমিন একাকী শক্রমুখে ঠেলে না দিয়ে আমার সঙ্গে উনি নিজেও যেতে চাইলেন। আমি সেই দুঃসাহসিক বীরযোদ্ধাকে ইকোনমির কথাটা বুঝাতে চাইলাম। নিছক ভাবালুতাতে কাজ হবে না এক সঙ্গে দু’জন অফিসার হারানো মুক্তিবাহিনীর জন্য নিছক বোকামি। রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে এফইউপিতে পজিশন নিলাম। আমার ডানে ১২ নং প্লাটুন আর আমার এক ভাগ্নে আইএ ক্লাসের ছাত্র জহিরুল আনোয়ার ওরফে সানু সাধারণ সৈনিক হিসেবে আমার পাশেই ছিল। যুদ্ধের ময়দানে আমার ভাগ্নের উপস্থিতি আমি টের পাইনি। স্বাধীনতার পর জার্মানি থেকে চিকিৎসা সেরে ফেরত আসার পর পরিচয় ঘটে অষ্টম বেঙ্গলের সেই সৈনিকের সঙ্গে চৌমুহনী পোস্ট অফিসে, যে পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার ওর পিতা একেএম

শফিকুর রহমান।

৫৯

এফইউপিতে পজিশনে গিয়ে ৩টা ৪৫ মিনিটে ওয়্যারলেসে বললাম “জোরে মার’ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আর্টিলারি গর্জে উঠল। বুঝতে পারলাম আর্টিলারির আওয়াজের ধমকে আমার স্বল্প ট্রেনিংপ্ৰাপ্ত সৈনিকরা এফইউপিতে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকাটা আরো প্রকট হয়ে উঠল। যখন নিজের প্রিয় এইচ আওয়ার আর্টিলারি গোলাবর্ষণকালে দু’তিনটি রাউন্ড ভুলবশত ঠিক আমাদের এফইউপিতে এসে পড়ে। যদিওবা টার্গেট থেকে এফইউপি ছিল প্রায় এক হাজার গজ দূরে। মনে হয় এফইউপি শত্রুশিবির ও আমাদের আর্টিলারি পজিশন এক লাইনে ছিল বলে সহজে আর্টিলারির গোলা এসে এফইউপিতে পড়েছিল। অবশ্য পূর্বাহ্নে আর্টিলারির কর্মদক্ষতা সম্বন্ধে সন্দিহান হলে আমি হয়তো ডানে হালছটি গ্রামের শালবনকে এফইউপি বানাতাম। হালছটি গ্রামের শালবনটি শত্রুশিবির থেকে মাত্র তিনশ’ গজ দূরে ছিল। কিন্তু যেহেতু আমাদের আক্রমণের বেশ কিছুদিন আগে ওই শালবনকে এফইউপি বানিয়ে এফএফ কোম্পানি বিওপির ওপর আক্রমণ করেছিল, তাই আমি ওই শালবনটিকে এফইউপি বানাইনি। অন্যদিকে পূর্বদিন (২ আগস্ট) আমার পরিকল্পনা ছিল সামনের নালাকে এফইউপি বানিয়ে আর্টিলারির ফায়ার অনকল রেখে (দরকার মতো ব্যবহার করা) আক্রমণ করা। তাতে করে রাতের আঁধারে শত্রুর অজান্তে আমরা শত্রুশিবিরে দু’তিনশ’ গজ ভেতরে পৌছে যেতাম। আর নিজস্ব আরআর ও মেশিনগান আমার বিশ্বাস। আর বিশেষ দরকার মতো আটিলারি তো ছিলই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবস্থার চাপে পূর্ব পরিকল্পনা বদল করে প্রি-এইচ আওয়ার গোলাবর্ষণের কার্যক্রম নিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, আমার ছয়টি ছেলে ঘটনাস্থলে গুরুতরভাবে আহত হয়, ফলে পুরো প্লাটুন আহতদের শুশ্ৰষার নামে এফইউপিতেই থেকে যায়। এতে যথেষ্ট শোরগোলও হয়। অপরদিকে প্ৰচণ্ড গোলাগুলির মাঝে। (আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠার মিনিট খানেকের ভেতর পাকিস্তানি আটলারি গর্জে ওঠে) একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া যথেষ্ট সাহসের কাজ বৈকি, বিশেষ করে আমার দুই কোম্পানির জন্য। কারণ আমার দুই কোম্পানিতে তিনশ’ জনের মধ্যে তখন মাত্র দশ জন সামরিক বাহিনীর লোক গোটা আটেক ইপিআর এবং দু’তিনজন পুলিশের লোক ছাড়া বাকি সবাই সাতদিনের ট্রেনিংপ্ৰাপ্ত গ্রামবাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ। প্রি-এইচ আওয়ার গোলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে আমার ডানে অবস্থিত মেশিনগান ও আরআর প্রচণ্ডভাবে গর্জে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে হালছটি গ্রাম থেকে ইপিআরের প্লাটুনটি ভাওতা দেয়ার জন্য আক্রমণের বৃহ রচনা করে শক্ৰদের ভ্যাবাচ্যােকা খাইয়ে দিলো। এই কার্যক্রমগুলো অত্যন্ত সুঠু ও সাবলীল গতিতে হতে থাকে। ইপিআরের আক্রমণ চলাকালীনই আমরা চুপি চুপি এক্সটেন্ডেড লাইন ফরমেশন করে পায়ে পায়ে এগুতে থাকি। ৫০০ গজ আগে নালার কাছে পৌছে শুধু ২ মিটার ওয়ালাদের নালাপাড়কে আড়াল রেখে ৩৩০ গজ আগে শত্রুশিবিরের ওপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলাম। এই নির্দেশ না দিলেই যেন ভালো হতো, কারণ আমার এই নির্দেশের সুযোগে আমার স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকরা নালাতে আড়াল নিয়ে নেয়, তাতে কমান্ড ও কন্ট্রোল একেবারে

৬০

শিথিল হয়ে পড়ে। নায়েব সুবেদার কাদের ও বাচুর অধীনে ৫ ও ৬ নং প্লাটুন বিওপির গেটের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু তারাও নালার ভেতরে আড়াল নিয়ে মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করতে শুরু করে। সম্ভবত এজন্যই এফইউপি ত্যাগ করার পর ফায়ার এন্ড মুভ’ পদ্ধতিতে আক্রমণ করা মিলিটারি একাডেমিতে (পাকিস্তান) বিতর্কের বস্তু ছিল এবং প্রায়ই বলা হতো। এফইউপি ছাড়ার পর ডোন্ট গোটু দি গ্রাউন্ড এগেইন। নালাতে আমার সৈন্যদের এমন কাণ্ড দেখে শক্রিশিবিরের নিকটবতী এসেও আমি চিৎকার না করে পারিনি, এমনকি কাউকে কাউকে লাথি পর্যন্ত মেরেছিলাম। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে কলার চেপে ধরে আমি জোর করে আগে পাঠাতে শুরু করি। আমার বামে হাবিলদার নাছির তার সেকশন নিয়ে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ক্ষিপ্তগতিতে এগুতে থাকে এবং আমি নিজে নায়েক সিরাজকে সঙ্গে করে ডানে বাঙ্কারের দিকে এগুতে থাকি। আমাদের এই মনোেবল দেখে শক্রিরা তখন পলায়নরত-ইতোমধ্যে আমরা এসল্ট হুংকার দিই এবং পর মুহুর্তে “ইয়া আলী” বলে আমার সৈন্যরা সঙ্গীন উচু করে বেয়নেট চার্জের জন্য রীতিমতো দৌড়াতে শুরু করে। এদের উত্তেজনাকে বাড়ানোর জন্য নায়েব সুবেদার মুসলিম নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি করলে সৈন্যরা ঘন ঘন আতিশয্যে আমার সিগন্যালম্যান ওয়্যারলেস সেটা আমার সামনে এনে ধরলে আমি ধমকে উঠলাম ‘তুমি নিজেই যা পার বলে পাঠাও”। পিছু পিছু সে ওয়্যারলেসে জোশের সঙ্গে বলে বেড়াচ্ছিল, হয়ে গেছে আর একটু বাকি বাঙ্কারে বাঙ্কারে যুদ্ধ হয় ইত্যাদি। ঠিক এমন সময় শক্ৰদের আর্টিলারি শেলভো ফায়ার (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়ল আমাদের ওপর, সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন ঢলে পড়ল, যার ভেতর সম্ভবত হাবিলদার নাসিরও ছিল। আমাদের সৈন্যরা ছত্ৰভঙ্গ হয়ে গেল, আমার ডান পায়ে এসে একটা শেল লাগল-আঘাতটার গুরুত্ব উপলব্ধি করার আগেই জোশের সঙ্গে এগিয়ে আরো ৫০ গজ সামনের শত্রু বাঙ্কার থেকে মাত্র কিছু পথ বাকি, আমাদের গুটিকয়েক ছেলে তখন পলায়নরত শক্ৰদের মারছে। কেউ কেউ তখনো মাইন ফিন্ডে ফোঁসে আছে এবং শক্রির মাইনে উড়ে যাচ্ছে, কেউবা শক্রর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় অনার্স স্টুডেন্ট শামছুল আলম মাইন কিংবা শক্রর তোপের মুখে উড়ে গেল। ওই বিশপচিশটা ছেলের মন চাঙ্গা রাখার জন্য জোরে জোরে চিৎকার করে উঠলাম “বিওপি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে, আগে বাড়ো”। যদিও বিওপির মাটির দেয়াল আগের মতোই খাড়া ছিল। এমন সময় আমার বাম পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিধল, আমি পড়ে গেলাম। সম্ভবত পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে আহত এক খানসেনা এলে সঙ্গীন নিয়ে বাচ্চা ছেলে সালাম (অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এবং এক সুবেদার মেজরের ছেলে) আগেই খতম করে দিল খানসেনাকে । এদিকে যারা মাথা নিচু করে পেছনের নালা থেকে আন্দাজে ফায়ার করছিল তাদের ফায়ারে আমাদের দুটি ছেলে জখম হলো। করার কিছুই নেই তখন। এর আগে এফইউপি থেকে এডভান্স করােকালীন নালাতে অবস্থান করাকালে অমন মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করার জন্য আমি একটি ছেলের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দেই। মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি দু’জন

৬১

ধাবমান শক্ৰকে গুলি করে ডানদিকের বাঙ্কারে অবস্থানরত শক্রসেনাকে গুলি করার জন্য বিহারি ছেলে হানিফকে ঘন ঘন নির্দেশ দিচ্ছিলাম। ওই একটি বাঙ্কারে অবস্থিত শক্রির নিখুঁত গুলিবর্ষণ আমাদের ভীষণভাবে ঘায়েল করছিল, তা না হলে আর কোনো বাঙ্কারে কোনো শক্র ছিল না, বরং শত্রু তখন বিওপির পেছনের দেয়ালকে আড় করে সম্ভবত কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচিছল অথবা পলায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অবশ্য হানিফ তখন ভীষণভাবে অনুরোধ করছে, ‘স্যার আব্ব পিছে চলা যায়ে, মাই কভারিং ফায়ার দে রাহাহ্’। বিলাবাহুল্য, বিহারি ছেলে ইপিআরের জওয়ান হানিফ ছিল আমার ব্যক্তিগত প্রহরী। বরিশালের এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছিল হানিফ-বেশ কয়েকটা অপারেশন করার পরও সন্দেহভাজন হয়ে মুক্তিবাহিনী তাকে বন্দি করে। বন্দিশিবিরে স্পষ্ট বাংলায় সে আমাকে বলল, “স্যার” আমি বেইমান না, একটা চান্স দিন, জান দিয়ে প্রমাণ করব” পিট চাপড়িয়ে আমি বললাম, হানিফ তুমি আজ থেকে আমার পার্সেনাল গার্ড। পারবে, ‘স্যার” আমার জান থাকতে আপনার গায়ে গুলি লাগবে না, প্রত্যয় ভরা মুখে উত্তর দিল হানিফা। সত্যিই সে জীবিত থাকাকালীন আমার গায়ে গুলি লাগেনি (যদিও শেল লেগেছে)। হানিফকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়ার আগেই হিস শব্দ হলো, হানিফ ঢলে পড়ল, মনে হয় ওর মাথায় গুলি লেগেছিল। আর তার মাথার স্টিল হেলমেট ছিল না। ক্রল করে ওর হেবারসেকে ধাক্কা দিয়ে ক্ষীণস্বরে বলে উঠলাম ‘হানিফ’ কোনো সাড়া এলো না। প্ৰাণটা কেঁদে উঠল-সঙ্গে শক্রির গুলিতে পাশের মাটি উড়ে গেল, বুঝতে পারলাম শক্ৰ আমায় দেখে ফেলেছে। সাইডরোল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করাকালীন বাম দিক থেকে একটা গুলি এসে আমার ডানহাতের কনুইতে লাগে। ঝা করে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। হাতের স্টেনটা ছিটকে পড়ল, বা হাতে তা কুড়িয়ে নিলাম। কবজিটা বেঁকে নিচের দিকে ঝুকে পড়ল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ফিন্ড ড্রেসিংটা বের করব, একঝাক গুলি এসে পাশের জমির আইলটা উড়িয়ে দিল। বুঝতে পারলাম শক্রর পাঁচ গজের ভেতর থাকা সম্ভব না। আমাদের দু’ধারে শুধু লাশ আর লাশ। কারণ এর আগের মুহূর্তে শক্রর এসওএস (সেভ আওয়ার সোল) এয়ার ব্রাস্ট আর্টিলারি ফায়ারে আমাদের যে আট-দশজন লোক শত্রু বাঙ্কারে ঢুকে পড়েছিল তারা ধরাশায়ী হলো। তার মধ্যে নায়েক সুজা মিয়াও ছিল। পাশে তাকিয়ে দেখি একটি কচি ছেলের লাশ। ছেলেটি কিছুক্ষণ আগে শত্রুর গুলিতে হতচকিত হয়ে শক্রির ডান বাঙ্কার এড়িয়ে কোনাকুনি আরো ডানে অধিকতর নিরাপদ স্থান হালছটি গ্রামের দিকে যেতে চেষ্টা করছিল। ওর কলার চেপে ধরে বাঙ্কারের মুখোমুখি করে আঙ্গুল দিয়ে টার্গেট দেখিয়েছিলাম।

শক্ৰশিবিরে পাঁচ গজের ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য ফিল্ড ড্রেসিং বের না করে সাইড রোল শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ডানের ঢালু জমি দিয়ে অধিকতর নিরাপদ রাস্তাতে পশ্চাদপসরণ করা। কিছুক্ষণ সাইড রোল করার পর তাকিয়ে দেখি আসলে ডানে না গিয়ে আমি কোনাকুনি শত্রুশিবিরের দিকেই যাচ্ছি। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে হবে-তাই একটু দম নিয়ে পেছনে তাকিয়ে লক্ষ্য ঠিক করে নিলাম। শরীর গরম থাকতে থাকতেই আমার হাজার গজ দূরে শালবন এলাকায় পৌঁছতে হবে। ক্রল শুরু করব, এমন সময়

৬২

দেখি বাচ্চা ছেলে সালাম যে পঞ্চাশ গজ। ক্রল করে পিছে হটে গিয়েছিল। হঠাৎ করে আবার দৌড়ে এসে পড়ে থাকা একটি এলএমজি নিয়ে জয় বাংলা’ বলে হুঙ্কার দিয়ে শক্ৰ বেষ্টনীর দিকে ধাবিত হলো। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া শত্রু তখন পুনরায় কাউন্টার অ্যাটাক করার জন্য মাটির দেয়ালের পিছে জমায়েত হচ্ছিল এবং ঘন ঘন আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি করছিল। “তোরা আমার মা-বাপ সবাইকে মেরেছিস, আমি ছেড়ে দিব?” । বিড় বিড় করে পাগলের মতো সালাম শক্ৰ বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়ল। অতিকষ্টে একবার ডাক দিলাম সালাম চলে এসো’। কিছুক্ষণ আগে যে আমার জীবন রক্ষা করেছিল সেই সালামকে আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি। অথচ বাচ্চা বলে এবং তার সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি বলে আমি তাকে যুদ্ধে শামিল করিনি, কিন্তু সে পালিয়ে এসে এসেম্বলি এরিয়াতে আমাদের সঙ্গে চুপি চুপি যোগ দেয়। বাংলার শ্যামল গালিচার দূর্বাদলের মাঝে এমনি করে লুকিয়ে আছে হাজারো সালাম। গোটা যুদ্ধক্ষেত্রটা তখন মহাশ্মশান। আমাদের পক্ষে ৬৫ জন আহত হয় অথবা নিখোঁজ হয়, যার ভেতর যুদ্ধের ময়দানে ১২ জনের লাশ থেকে যায় এবং ৩৫ জনকে গৌহাটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মৃতদেহ ছাড়া আর কোনো জ্যান্ত মানুষ নেই-বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ হচ্ছে দুদিক থেকে। শালবনে অবস্থানরত আমার মেশিনগান তখন ঘন ঘন গর্জে উঠছে, সম্ভবত আমার ক্ষতবিক্ষত পশ্চাদপসারণকারী সৈন্যদের কাভারিং থেকে বাঁচার জন্য ডানে অপেক্ষাকৃত নিচু ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে এগুতে শুরু করি, এমন সময় কে যেন চিৎকার করে উঠল, ‘এরে আঁই বাঁচতে চাই-তোরা কেউকি আঁর কথা শুনতাছ না-এরে আঁরে লই যা’। প্ৰাণটা কেঁদে উঠল, যদিও করার কিছুই ছিল না, তবুও দাত খিচিয়ে বললাম, “বেটা চিৎকার করিস না”। তবে ওর কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করার আগেই ওই এলাকা বরাবর একটি আর্টিলারি শেল এসে পড়ল। মাথাটা নিচু করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকাকালে আঁচ করলাম, স্বয়ক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে আমার পাশের মাটি উড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বঁ হাতে ঠেলে ঠেলে (কারণ এক হাতে ও এক পায়ে ক্রল করা সম্ভব হচ্ছিল না) নিজের আহত শরীরটাকে নালার দিকে নিয়ে গেলাম। ইতোমধ্যে আর কোনো চিৎকার চিৎকার শুনিনি। নালার কাছে পৌছে সব শক্তি নিয়োগ করে খাড়া হয়ে টলতে টলতে কেমন করে জানি নালাটা পার হয়ে গেলাম-আজ বলতে পারব না-মনে হচ্ছে বাঁচতে হবে এই জোরেই বুঝি নালাটা পার হয়েছিলাম আর পাড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ধাপ করে পড়ে গেলাম। তবুও স্বস্তি বোধ করলাম। এই মনে করে যে, শত্রু থেকে অনেক দূরে এসে গেছি এবং অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায় এসেছি, তাতে শক্রির স্মল আর্ম ফায়ার থেকে প্ৰায় বেঁচে গেলাম। শরীরটা ক্রমেই ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল, তাই বুঝি সমস্ত জোর দিয়ে খাড়া হয়ে দৌড় দিতে চেষ্টা করলাম। দু’এক কদম যাওয়ার আগেই একঝাক গুলি আমার পায়ের কাছের মাটি উড়িয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে ধাপ করে মাটির ওপর গিয়ে পড়লাম আবার। শক্রির আর গুলি আসছে না। দেখে আবার একটু স্বস্তি বোধ করলাম; কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই টের পেলাম ১০/১২ জন শক্রিসেনা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। পিছে নালার ওপারে আমার এক হতভাগ্য আহত জওয়ানকে পেয়ে একগাল হাসি হেসে ওরা গুলি করল।

৬৩

তারপর কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। মাঝে মাঝে এগুনোর আওয়াজ পাচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ করে শক্রর দল থেকে এক বাঙালি আরেক বাঙালি বলে উঠল, “মকবুল এদিকে আয়, পাওয়া গেছে’। বোধহয় ঠেলে ঠেলে আসার ফলে কর্দমাক্ত মাটিতে রাস্তা হয়ে গিয়েছিল আমার পালানোর পথ। সঙ্গে হাতের ও পায়ের রক্ত আরো বেশি করে চিহ্নিত করেছিল। সেই পথকে । সেই থেকে শক্রির সঙ্গে শুরু হলো আমার লুকোচুরি ধানক্ষেতের আড়ালে আড়ালে। প্রায় ৩০০ গজ আসার পর ধানক্ষেত শেষ হয়ে গেল। এরপরের ২০০ গজ সম্পূর্ণ খোলা ময়দান। ওইদিকে কর্দমাক্ত মাটিতে কোমর পর্যন্ত কাদাপানিতে থাকার ফলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে প্ৰায়। ভীষণ শীত করছিল, ভাবলাম আর বোধহয় বাঁচা সম্ভব নয়। আমাদের তরফ থেকে কোনো জন-প্ৰাণীর চিহ্ন নেই। যে মেশিনগান এতক্ষণ ধরে প্রচণ্ড বেগে ফায়ার করছিল সেও চুপ হয়ে গেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা গরুর গাড়ি বিওপিতে ঢুকছে। সম্ভবত ওদের লাশ নেয়ার জন্য। আমার নিজস্ব কোনো ঘড়ি ছিল না। আক্রমণের আগে রকেট লঞ্চারওয়ালা তার নিজের ঘড়িটা আমায় দিয়েছিল। সেই ঘড়িটার দিকে এবার তাকালাম। কর্দমাক্ত ঘড়ি, এমনকি কাচের ভেতরেও পানি ঢুকছে। বেলা তখন ৮টা ১০ মিনিট। রোদটা পিঠে লাগছিল। তৃষ্ণায় বড় কাতর হয়ে পড়েছি। জীবন-মরণ টাগ অব ওয়ারের শেষ মুহূর্তে এসে হেরে যাওয়ার দুঃসহ জ্বালায় আমি তখন বিহবল, বড় অসহায়। জীবন-রস ঘর্মাক্তি কলেবরে নির্গত হচ্ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল, আমার একটা জওয়ান যদি একটা কভারিং ফায়ার দেয়। তবেই আমি রক্ষা পাই। শত্রু তখন পঞ্চাশ গজ দূরে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ক্রমেই আমি তলিয়ে যাচ্ছি। শেষবারের মতো টেনেহিঁচড়ে বিক্ষত দেহটাকে আর্টিলারি শেলে সৃষ্ট একটি কালো মাটির গর্তে নিয়ে গেলাম। শক্ৰ যাতে সহজে দেখতে না পায়, গলা পর্যন্ত ধীরে ধীরে লেপে দিলাম বা হাতের কর্দমাক্ত কালো মাটি দিয়ে। স্টিল হেলমেটের মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে রইলাম। অপেক্ষায় রইলাম চরম মুহূর্তের। চোখটা আপনা থেকেই বুজে আসছে। ভেসে উঠল মায়ের মুখচ্ছবি। এলোমেলো চিন্তা দুটি অসহায় যুবতী বোনের সজল চাহনি, একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। যুদ্ধে যোগ দেয়ার আগে মা’কে দেখে আসা একান্ত উচিত ছিল। আজ মা, বাপ, ভাই-বোন, কে কোথায় কেমন আছে জানি না। তারাও জানালো না। আমি কেমন করে মরে যাচ্ছি। ভাবনা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে জোর করে চোখ খুলে চাইলাম। স্টেনটা বঁ হাতে ধরা। বন্দি হবো না কোনোক্রমেই বরং মেরে মরব। তবুও মনেপ্ৰাণে মরার কথাটা চিন্তা করতে পারিনি। কেন জানি মনে হচ্ছিল এত অল্প বয়সে মরে যাব। নিশ্চয়ই বেঁচে যাব। আশ্চৰ্য্য! এত বিহবলতার মাঝেও একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল, আহ-হা, কেউ যদি আমার হারিয়ে যাওয়া ডায়েরিটা পেত (বিশেষত ২ মার্চ ‘৭১ থেকে ১০ জুলাই ’৭১ সাল) কিংবা এখানেওখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আমার লেখাগুলো। চোখ দুটোকে আর খুলে রাখতে পারছিলাম না। ঠিক এমন সময় আমার কমান্ডিং অফিসার মেজর আমিনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো শালবন থেকে, “আমিন, “আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করো’-আহত হওয়ার তিন ঘণ্টা পর এই প্ৰথমবারের মতো সক্রিয় সাহায্য পেলাম। বস্তুত আমার নিহত বা নিখোজ

৬৪

হওয়ার সংবাদে মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে মেজর আমিন তখন কমান্ডো প্লাটুন নিয়ে আমার মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন। আমার কাছে ক্রল করে আসতে ইতস্তত করছিল দেখে মেজর আমিন নিজেই খালি হাতে ক্রল শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাবিলদার তাহের মেজর আমিনের পিছু নিলো। আমার কাছে এসে উভয়ে পৰ্যায়ক্রমে আমার পা ধরে মৃতদেহের মতো টানতে শুরু করল। পিঠের চামড়া উঠে যাচ্ছে বিক্ষত ডান পায়ের ব্যথায় ঢুকরে উঠলেও দাঁত কামড়ে রইলাম। সম্ভবত আনন্দের আতিশয্যে ব্যথা ভুলে গেলাম। লেফটেন্যান্ট মোদাসসের তখন চিৎকার করছে। শালবন থেকে, ‘তাড়াতাড়ি করেন স্যার”। তার দুই এলএমজিওয়ালা তখন দুই গাছের ওপর উঠছে। শক্রিরা তখন আমাদের ২০/২৫ গজ পেছনে একজন আহত জওয়ানকে হত্যা করে পায়ে পায়ে এগুচ্ছে। আমাদের দুই এলএমজিওয়ালা কেঁদে কেঁদে বলছে, “আপনাদের ধরে ফেললো যে স্যার’ দাঁত খিচিয়ে আমরা বললাম, “বেটা ফায়ার কর’। আমাদের ওপর দিয়ে ফায়ার করতে হবে তাই আমাদের জওয়ান ইতস্ততা করছিল। শক্রি তখন আমাদের ওপর চার্জ করে আর কী। সঙ্গে সঙ্গে এলএমজি গর্জে উঠল। ছয়-সাতটি খানসেনা তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়ল। মকবুল আর তার সাখী দালালকে আমরা হাতেনাতে ধরে ফেললাম। দুটি খানসেনা পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর আর্টিলারি ফায়ার এসে পড়তে লাগল। বৃষ্টির মতো আর্টিলারির গোলার মাঝে মেজর আমিন আমায় কাঁধে গেলেন, ‘স্যার প্লিজ আপনি চলে যান, তাহের আমায় নিয়ে আসবে” আমি বলে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত জোর করে আমি তাহেরের দিকে হাত বাড়ালাম, ‘স্যার প্লিজ চলে যান’ আবার বললাম। আর বৃষ্টির মতো আর্টিলারি ফায়ারের মধ্যে হাবিলদার তাহের আমায় কাধে নিয়ে দিল এক ভো দৌড়। ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছিল তাহের-হঁপাতে হাঁপাতে বলছে, “চিন্তা করবেন না। স্যার, মরলে দু’জন একসঙ্গে মারব”।

প্রেমিক শাহজাহান স্মৃতির মর্মর প্রস্তরে রেখে গেলেন তার প্ৰেম কাহিনী। আমি সম্রাট নই, নেই কোনো সাম্রাজ্য যে তাজমহল গড়ব, তবুও বলবো, পৃথিবীতে কোথাও যদি স্বৰ্গ থাকে, তা এখানে, তা এখানে এবং তা এখানেই।

মেজর জেনারেল আমীন আহমদ চৌধুরী (অব.), বীর বিক্রম

জন্ম : ১ জানুয়ারী ১৯৪৬। ৫ জুন ১৯৬৬ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। সত্তরের মার্চে তিনি ক্যাপ্টেন পদবীতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্তব্যরত ছিলেন। ২৪ মার্চ ১৪ ডিভিশনে জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা চট্টগ্রাম থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডান্ট ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদারসহ ক্যাপ্টেন আমীনকে আগাম কোনো সংবাদ ছাড়া হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ক্যাপ্টেন পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

তিনি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুদ্ধ করেন। ৩ আগস্ট তিনি নকশি বিওপিতে শক্ত পাকিস্তানি

অবস্থান আক্রমনকালে মারাত্মকভাবে আহত হন। সাহসিকতার জন্য তাকে ‘বীর বিক্রম’ বীরত্ব উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

রেফারেন্স – স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!