You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৭ ই বৈশাখ পাক বাহিনী গানবোট নিয়ে ঝালকাঠি দিয়ে কাটাখালী নদী দিয়ে শশীদের হাটে আসে। তারা এসে হাটের পাশে গানবোট রেখে গ্রামের উপর নেমে পড়ে। পাক বাহিনী গ্রামের ভিতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারী পুরুষ প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে চেষ্টা করে। পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে দামী দামী জিনিসপত্র লুটতরাজ করে এবং পরে ৯ খানা বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিন ২ জন লোককে তারা গুলি করে। এদের একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় আর একজন গুরুতর রুপে আহত হয়।

২৬ বৈশাখ পাক বাহিনী ও রাজাকাররা পুনরায় আমাদের গ্রামে আসে। তারা গানবোট ও স্পিড বোট নিয়ে ছোট খাল দিয়ে গ্রামের ভিতর ঢুকে পড়ে। মতিলাল দেবনাথ (ব্যানার্জী) ও হিরালাল দেবনাথের কাপড়ের দোকান লুট করে স্পিডবোট বোঝাই করে কাপড় নিয়ে যায়। এই সময় ওরা মতিলাল দেবনাথের কাছ থেকে নগদ ১২,০০০ টাকা নেয় এবং তাঁকে বেয়োনেট চার্জ করে পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই দিন আমাদের গ্রামে ১৮ জন লোককে পাক বাহিনী গুলি করে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। এর মধ্যে জিতেন নামে একজনকে পাক বর্বর বাহিনী  নারিকেল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার পায়ের কাছে খড়কুটো দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেলে সে ভীষণভাবে চিৎকার করতে থাকে। তখন পাক বর্বর বাহিনী গুলি করে তার মাথার অর্ধেক অংশ উড়িয়ে দেয়।

এই ঘটনা তার স্ত্রীর সম্মুখে হয়। কেননা পাক বাহিনী তার স্ত্রীকে ধরে এনে তার সম্মুখে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই সময় ক্ষীরদা সুন্দরী নামে বিধবা মেয়েকে পাক বাহিনী সারা শরীর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম্ভাবে হত্যা করে। এ সময় আর এক মহিলা পাশের জঙ্গলের ভিতর পালিয়ে ছিলো তার ছোট ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে। পাক বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে এক গুলিতে ছেলে, মেয়ে সহ তিনজনই মারা যায়। ঐদিন আমাদের গ্রামের মোট চারখানা বাড়ি বাদে আর সব বাড়ি অগ্নিসংযোগ করে দেয়।

৫ই জ্যৈষ্ঠ পাক বাহিনী ঝালকাঠি থেকে গানবোট নিয়ে পুনরায় শশীদ হাটে আসে এবং হাটের উপর ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐ দিনই পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম থেকে ২ জন লোককে হত্যা করে। তার মধ্যে একজন ছিলো স্থানীয় স্কুলের সেক্রেটারী কালী কান্তা মন্ডল। এই সময় পাক বাহিনী স্কুলের লাইব্রেরী লুট করে এবং ভেঙ্গেচুরে সব তছনছ করে দেয়। লাইব্রেরীর ভিতরে ছাত্রদের দেওয়া রিলিফের গমে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই আগুন নেভাতে গিয়েই সেক্রেটারী সাহেব গুলি খান।

পাক বাহিনী এই সময় ১০ দিন শশীদ হাটে ক্যাম্প করে থাকে। এই সময় তারা ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ করে। আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করে। পাক বাহিনী রাত্রিতে গ্রামের ভিতর ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং কিছু কিছু মেয়েকে তারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং এক একজনের উপর পরপর কয়েকজন পাক পশু ধর্ষণ করে। এই সময় ১০ বছরের একটা ছোট মেয়েকে পাক বাহিনী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং একাধারে তার উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। পাক বাহিনী চলে যাবার পর এই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। ৩ মাস পর্যন্ত এই ছোট মেয়েটি হাঁটতে পারতো না।

৮ মাসের গর্ভবতী একটি মেয়ের উপর পাক বাহিনী এই সময় অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালায় যার দরুন সন্তান প্রসব করার পর সে ও সন্তান মারা যায়।

২৫ শে শ্রাবণ পাক বাহিনীর দালালের সহযোগীতায় ঝালকাঠি থেকে গানবোট নিয়ে শঙ্কর ধবল গ্রামে আসে। আছমত আলি ও রহিনী মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে শশীদ গ্রামে আসে এবং সুনীল সরকার নামে এক ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় খুব বৃষ্টি নেমে পড়ে। পাক বাহিনী তখন রহিনী কুমার মণ্ডলের ঘরে আশ্রয় নেয়। হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা নিয়ে খুব গান বাজনা করে এবং কলা খায়। বৃষ্টি শেষে যাবার সময় গৃহকর্তা রহিনী কুমার মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে যায়। যে দুইজন লোককে তারা বন্দী করে আনে তাদের একজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় এবং একজনকে শশীদ হাটে বসে গুলি করে হত্যা করে। তাঁকে হত্যা করার আগে খুব মারপিট করে এবং গালাগালি দেয়। যাকে এই সময় ছেড়ে দেয় তাঁকে বলে তোমরা জয় বাংলা বলতে পারবে না। বলবে “জয় পাকিস্তান”।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বরূপকাঠি থানার অশ্বথকাঠি, জিনহার, মাদ্রা, পুর্বজলা বাড়ী, মৌশানী, জুলুহার, আতা, জামুয়া, জৌসার, গণপতিকাঠি, আরামকাঠি প্রভৃতি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বহু লোককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই সময় মাদ্রা গ্রাম থেকে দুইজন লোককে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ ছিল পাক সৈন্য যখন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার জন্য যায় তখন তারা দুইজন বাধা দেয়। এই সময় তারা বহু মেয়েকে ধর্ষণ করে। একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই ১ হাজারের বেশী মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করেছে।

বিভিন্ন সময় আমাদের থানাতে প্রায় ২০০/৩০০ লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। স্বাধীনতার পর আটঘর কুড়িয়ানা স্কুল ঘরের পেছনে একটা পুকুরের ভেতর থেকে ১৫৬ টা মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।

পাকবাহিনী স্বরূপকাঠি দখল করার পর স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, শশীদ, বাউকাঠি, জলাবাড়ী এইসব জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালায়। জলাবাড়ী ক্যাম্প অঞ্চলে ৩৩ টা গ্রাম শুধু হিন্দু বসতি ছিল, পাকবাহিনী সব গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

স্বাক্ষর/

যতিন্দ্র নাথ মন্ডল

গ্রামঃ শশীদ

ডাকঘরঃ মৌশানী

থানাঃ স্বরুপকাঠি

জেলাঃ বরিশাল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!