You dont have javascript enabled! Please enable it!

এই বাংলা, বাংলার মুখ | মাহবুব আলম

এলাকাটা পঞ্চগড়। জুলাই-আগস্ট মাস।

নদীটা পশ্চিম দিক থেকে এখানে এসে বাঁক নিয়েছে দক্ষিণমুখী হয়ে। সেই বাঁক খাওয়া জায়গাটিতেই গড়ে উঠেছে ফ্রন্ট লাইন বা অগ্রবর্তী ঘাঁটি। তিনটি প্লাটুনের অবস্থান এখানে। এফএফ প্লাটুন একটি, দুটি এমএফ প্লাটুন। মূল ডিফেন্স লাইন পেছনে। প্রায় আধা মাইল। সেখানে অবস্থানরত তিনটি কোম্পানি থেকে বাছাই করে ফ্রন্ট লাইনে পাঠানো হয়েছে দল তিনটিকে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। নদীর ওপরই শক্রর অবস্থান। তাদের সঙ্গে মুখোমুখি থেকে লড়ে যেতে হবে নিয়মিত। তারা যাতে নদী পার হতে না পারে, সেটা দেখতে হবে। তাদের অগ্রাভিযান ঠেকাতে হবে। পেছনে সজাগ ডিফেন্স লাইন। সামনের ফ্রন্টকে প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য দ্রুত এগিয়ে আসবে। শক্র দ্বারা আক্রান্ত এবং তছনছ হয়ে গলে মূল ডিফেন্স লাইন তখন পুরোদমে সক্রিয় হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। মোট কথা কোনো অবস্থাতেই তাদের আর এগুতে দেয়া হবে না। এই ডিফেন্স লাইন ভেঙে গেলেই শক্রির জন্য তেঁতুলিয়া পৌঁছতে অসুবিধা হবে না। তেঁতুলিয়া থানা এখন পর্যন্ত মুক্ত রয়েছে। সেটা কোনোভাবেই শক্রর পদানত হতে দেয়া যাবে না।

এই রণকৌশল নিয়ে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের ভজনপুর-দেবনগর-মাগুরা ডিফেন্স লাইন গড়ে উঠেছে। প্ৰলম্বিত যুদ্ধে আটকে গেছে পাকবাহিনী । অগ্রবর্তী দল তিনটিকে এই যুদ্ধে মূল ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।

নদীর এপারটা খাড়া। চড়া ভূমি ওপারে। ছোট নদী। নাম চোয়াই। ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে অমরখানায় বাংলাদেশে ঢুকেছে নদীটি পশ্চিম থেকে এসে। তারপর কিছুটা এগিয়ে এসে খাড়া বাঁক নিয়ে চলে গেছে দক্ষিণমুখী। সামনে কোথাও মিশেছে। গিয়ে করতোয়ার সঙ্গে। পাহাড়ি নদী। এমনিতে তেমন পানি থাকে না। হাঁটু জল, কোমর জল। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল এলেই হঠাৎ নদীর পানি ফুলে ওঠে। প্রবল স্রোতস্বিনী ধারা নিয়ে নদী তখন প্রচন্ড গতিময়তায় প্রবহমান থাকে। চড়াভূমি ডুবিয়ে দিয়ে অনেকটা বন্যার রূপ নেয়। এসব শোনা কথা। নদীটি এখনো তেমন রূপ ধারণ করেনি। যদিও ভরা বর্ষা চলছে। নদীর এপার-ওপার হতে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। মূল সড়কপথ ধরে শক্ৰ প্ৰথমদিকে ক’বার তেঁতুলিয়ার দিকে এগুনের চেষ্টা করেছে। পারেনি। শক্ত ডিফেন্স লাইন ভজনপুর। সেখানে বাধাগ্ৰস্ত হয়ে ফিরে এসেছে। এখন তাদের প্রচেষ্টা পাকা সড়ক বাদ দিয়ে এই গ্রামীণ এলাকা ধরে এগুনোর। কিন্তু বাধা এই নদীটি। সেটাও তেমন বড় কোনো বাধা ছিল না। এক রাতে ভরা বর্ষা মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল হঠাৎ করে এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। প্রথমে এটা তাদের নজরে আসেনি। যখন এসেছে, তখন নাকের ওপর মাছি বসার মতোই বিরক্তিকর মনে হয়েছে তাদের কাছে। আর তাই এখন তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নদীর বাঁকটিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধার দলটিকে উৎখাত করে তা দখলে নিয়ে নেয়া। কৌশলগত দিক দিয়ে সেটা দখল করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্যই তাদের নিয়মিত এগিয়ে আসার প্রচেষ্টা। আর সেই প্রচেষ্টার মুখে প্লাটুন তিনটির সদা সতর্ক অবস্থান। খাড়া পাড় থেকে বিশ-পঁচিশ গজ দূরুত্ব রেখে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্রন্ট। ট্রেঞ্চ-বাঙ্কারের সারি। পেছন দিয়ে চলাচল করার জন্য বুক সমান উচু ক্রলিং ট্রেঞ্চ । কিন্তু এখন তা পানিতে টাইটুম্বুর। বাঙ্কার-ট্রেঞ্চগুলোও প্ৰায় সয়লাব। ছেলেদের প্রাণান্তকর চেষ্টা সেগুলো শুকনো রাখার ব্যাপারে। বৃষ্টির ছাঁট অনবরত ভিজিয়ে দেয়। মেঝেতে পানি জমে যায়। একজন রাইফেল নিয়ে ভিজে পানি-কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্যজন অনবরত পানি ছেচে চলে। বাদলাদিন সব প্রকৃতির মতো এই ফ্রন্টবাসীদেরও ভিজিয়ে চলছে অনবরত।

এর মধ্যে সেন্ট্রি ডিউটি চলছে। পেট্রল ডিউটি। পর্যবেক্ষণ দল গেছে তাদের পোস্টে। প্ৰতি পোস্টে ছেলেরা রয়েছে সজাগ-সতর্ক। কিন্তু এই ঝমঝম বাদল বরিষণে সবার মধ্যেই কিছুটা আলস্যভাব আসে। কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব সব ফ্রন্ট লাইনকেই গ্ৰাস করে রাখে।

কিন্তু হঠাৎ পর্যবেক্ষণ পোস্টের দিক থেকে গুলির শব্দের মতো কিছু একটা শুনতে পায় সেন্ট্রি পোষ্টে দাঁড়ানো ছেলে পহর আলী। ঝরঝর বৃষ্টির শব্দের মধ্যে ভালোভাবে কিছু বোঝা যায় না। কিছুটা এগিয়ে যায় সে সামনের দিকে। পরপর আরো কয়টি গুলির শব্দ। এবার সব ইন্দ্ৰিয় সজাগ হয়ে ওঠে তার। পর্যবেক্ষণ মিশন থেকে গুলির সিগন্যাল! তার মানে, তারা শক্রকে আসতে দেখেছে। সবাইকে সজাগ করা দরকার এবং দ্রুত। এই বোধ থেকে পহর আলী নদীর ওপার লক্ষ করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দৌড়াতে থাকে আর ফ্রন্টবাসীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে থাকে, হুশিয়ার, সাবধান, খানের দল আসতেছে, গুলি ছোড়েন …!

মালেক-মঞ্জর সিগন্যাল পহর আলীর মাধ্যমে জেনে যায় সবাই। হঠাৎ করেই এলোমেলো-হুড়োহুড়ি অবস্থা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই যে যার মতো অবস্থান থেকে নদীর ওপারে থাকা শক্রর উদ্দেশে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পেছনের ফ্রন্ট লাইনও জেগে ওঠে। নদীর ওপারে ছড়িয়ে পড়ে শত্রু। তাদের গুলি ছুটে আসতে থাকে একনাগাড়ে। ধমাধম শুরু হয় আর্টিলারি শেষ বর্ষণ। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ । গগনবিদারী শব্দ । নদীর এপার-ওপার মিলে শুরু হয়। ধুন্ধুমার যুদ্ধ। উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড় সেক্টরে একাত্তরের জুলাইয়ের শেষ দিনে শুরু হয় আর একটা মরণাপণ লড়াই।

দুলু সেই যে এলো, থেকেই গেল স্থায়ীভাবে। এখন তার যাওয়ার উপায় নেই। যদিও পিছুটান প্রচুর। যুদ্ধের উদাম জীবনটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে। এখানে রোদন-ভরা বসন্ত আছে। খোল খোল দ্বার আছে। আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো আছে। আছে তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা। শেকল ভাঙার গান আছে। ও আমার দেশের মাটি আছে। আছে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আর আছে পিন্টু। যখন-তখন তার স্টেনগানটা গিটার হয়ে যায়। আর খোলা প্ৰান্তরে উদাম গলায় সে গান করে। আনন্দ-বেদনার, ভালোলাগা ভালোবাসার, দুঃখ জাগানিয়ার।

আর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুলু। অফুরন্ত প্ৰাণশক্তি। সদা হাস্যরসিক। রোমান্টিকতায় ভরপুর। জয়বাংলার জন্য নিবেদিত সাহসী যুবক। এ দু’জনে জমিয়ে রাখে অবকাশ-অবসরের নিজস্ব সময়গুলোতে। যুদ্ধের মাঠে এমনিতেই সময় পাওয়া যায় না। যে সময়টা তবুও বের হয় তা নিংড়ে নিয়ে উপভোগ করে ছেলেরা। পিন্টু দুলুর সঙ্গে যোগ দেয়, মধুসূদন, মতিয়ার, খলিল ও মোসারফ পাগলা। একদল তাজা প্ৰাণের তরুণ যুবক।

-হাতিয়ার চালানো জানেন? রাইফেল?

-জি, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কলেজে কয়দিন ট্রেনিং নিয়েছিলাম।

-ওতেই চলবে।

দুলুর ইন্টারভিউ হয়ে যায়। ওকে রাইফেল দেয়ার নির্দেশ দিই। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি ছুড়তে ছুড়তেই রাইফেল চালানো শিখে যাবে। ইচ্ছা শক্তিটাই এখানে বড়। আর প্রয়োজন সাহসের। মনে হয় ওর দু’টোই আছে।

গৌরবর্ণ হালকা-পাতলা শরীর, লম্বাটে গড়নের হাস্যোজ্বল যুবক। দু’গালের চোয়াল কিছুটা ভাঙা । তাকে বলি, রিচার্ড হ্যারিসন নাকি?

-কী যে বলেন!

-অভিনয় করেছেন কখনো?

-জীবনে একবার।

-গান?

-কিছু কিছু। তবে যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে সব পালান দিছে।

-পালান দেয়ার পরও কিছুটা তো আছে? হোক দেখি!

পিন্টুকে ইশারা দিই। পিন্টু এগিয়ে আসার জমিয়ে বসে। দুলু গান ধরে, তুই ফেলে এসেছিস কারে মন … ।

বাইরে বৃষ্টি, তা ঝিরঝিরিয়ে বর্ষার বৃষ্টি। এই আসে, এই চলে যায়। কিছুক্ষণ আগেই টিনের চালে ঝমকামিয়ে বৃষ্টি ঝরছিল। আকাশ ভেঙে যেন বালতিতে পানি ঢেলে দিচ্ছিল। কেউ। এখন তা নেই। ধরে এসেছে বৃষ্টি। এর মধ্যে মেঝের বিছানায় বসে দুলুর সুরেলা কষ্ঠে গান।

দুলু থামে, পিন্টু ধরে আগুন জ্বলো, আগুন জ্বলো। ওটা শেষ হলে দু’জনে একসঙ্গে ধরে, ও আমার দেশের মাটি … । মতিয়ার উসখুস করতে করতে ভেতরগড় অপারেশন দাখিলকৃত ভাঙা হারমোনিয়ামটা নিয়ে এসে যোগ দেয়। মিনহাজ পরিবেশন করে গরম চা আর পিঁয়াজি। জমে ওঠে মধুপাড়া হাইড-আউটের পরিবেশ। বাঁধনছাড়া উদ্দাম জীবন। হাস্যরস-কৌতুক আর আনন্দের হুল্লোড় তুলে তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ।

এখন যুদ্ধ নেই। অবসরের নিজস্ব সময় এটা। ইচ্ছা-খুশিমতো ছেলেরা এই সময়টা উপভোগ করে। শুধু একটাই বিধিনিষেধ। হাইড-আউটের বাইরে যাবে না কেউ।

-কি দুলু ভাই, আপনার নাকি জ্বর এসেছে?

-নাহ্। খানের দল আসার খবর পেয়ে জ্বরটা পালান দিছে।

‘পালান দিছে।’ কথাটা হচ্ছে দুলুর মুদ্রোদোষের মতো। প্রতিটা প্রসঙ্গে এবং আলোচনার শেষে তার এই ‘পালান দিছে’ শব্দ দুটো থাকবেই। যেমন খানের দল আজ টিকতে না পেরে পালান দিছে। শান্তি কমিটির আনাজ চেয়ারম্যান জানের ভয়ে পালান দিছে। গাইড মতিন কইলকার যুদ্ধে ভয় পাইছে আর পালান দিছে। এমনিভাবে বারবার তার পালান দেয়ার কথাটা এসে যায়। প্রথম দু’দিন ব্যাপারটা বোঝা যায়নি। তৃতীয় দিনে পিন্টু ব্যাপারটা ধরে ফেলে। আর হঠাৎ করেই তাকে বলে বসে, আপনিও কি পালান দেবেন?

-কী কহিলেন?

-এই যে পালান দেয়ার ব্যাপারটা আর কি!

-মানে?

দুলু আমার মুখের দিকে চায়। পিন্টুকে দেখিয়ে দিই আমি ইশারায়।

পিন্টু বলে, আপনার কথামতো সবাই তো পালান দিছে, আপনি কবে দেবেন। সেটা আগেভাগে জানলে ভালো হতো না? এবার বুঝে ফেলে দুলু। রসিকতা। কিন্তু মুখ গম্ভীর করে বলে,

-আমি যাচ্ছি না।

-থেকেই যাবেন?

-হ্যাঁ।

-কিন্তু পিছুটান? মা-ভাইবোনরা? ওপারে শরণার্থী তারা। গার্জেন বলতে শুধু আপনি। ওদের কি হবে?

-ওরাও থাকবে। লক্ষ কোটি শরণার্থী। তাদের মাঝে ওরাও থাকবে। কিন্তু এই যুদ্ধ, দেশের জন্য এই কাজ করার সুযোগ আর তো পাব না।

—খারাপ কিছু হতে পারে। দুদিন আগে আক্কাস মারা গেল। গোলাম গউস মারা গেছে। আমি পরিস্থিতির গভীরতা বোঝাতে চাই।

দুলু বলে, তা হোক। কপালে থাকলে হবে। যুদ্ধের মাঝে থাকব। আর মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকবে না। এটা কি হয়?

আমি বলি, জানেন তো চান্স ফিফটি ফিফটি । বাঁচা-মরার সম্ভাবনা সমান সমান। আপনার দিকে তাকিয়ে আছে ওপারে শরণার্থী মা-ভাইবোন-আত্মীয়রা। কীভাবে তারা বাধা দিচ্ছিল্প, কাঁদছিল, যখন আসেন!

–রাখেন তো মেয়ে মানুষের প্যানপ্যাননি। ওরা অমন করবেই।

-তাহলে পালান দেবেন না?

-দূর!

-তবে তাই হোক। এখন তাহলে গান ধরেন।

ছোট একটা খাল। হাঁটু সমান স্রোতস্বিনী জলরাশি। দু’ধারে উঁচু অসমতল। কাশবন, নলখাগড়া, জঙ্গুলে গাছ, বুনো ঘাসের ঝোপঝাড়। বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। খালটা মাঝখানে রেখে দু’পাশের অবস্থান থেকে সারাদিন চলেছে যুদ্ধ। শক্ররা একেবারে স্থির প্রতিজ্ঞ ছিল এপার আসবেই। দখলে নেবে আমাদের মধুপাড়ার হাইড-আউট। অন্তত তাদের মতিগতি তাই বলছিল। কিন্তু তা হয়নি বাস্তবে। দুলু গাইড করে এনেছে আমাদের এই কৌশলগত অবস্থানে। এখান দিয়েই তারা এগুতে চাইছিল। দুলুর সাহায্যে ঠিক সময়ে এই অবস্থানে না আসতে পারলে আজ হয়ত আর একটা ম্যাসাকার হতো। হয়নি। সারাদিন সমানতালে গুলিবিনিময় যুদ্ধের পর তারা হাল ছেড়ে পিছিয়ে গেছে। আজ আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। ওদের হয়েছে কি না জানা যায়নি।

শক্র রণেভঙ্গ দিয়ে চলে যাওয়া মানে যুদ্ধ শেষ। অল ক্লিয়ার সিগন্যাল পেয়ে সবাই উঠে আসে। কাঁদা-বালিতে মাখামাখি। শরীরজুড়ে শ্ৰান্তি-ক্লান্তি। কাঁধে অস্ত্ৰ ঝুলিয়ে তারা আসে। পরিত্যক্ত ছনের বাড়িটার সামনের উঠানে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। তৃষ্ণার্তা এবং ক্ষুধার্তা তারা। জঙ্গলযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধাদের সহজে পানি বা খাবার পাওয়ার উপায় নেই। তারা টলতে টলতে আসে। ক্লান্তিতে-অবসাদে বসে পড়ে এদিক-সেদিক শুয়ে পড়ে। দুপুরের না-খাওয়ার খিদে এই শেষ বিকেলে এসে মরে গেছে। তবে তৃষ্ণার্তা সবাই। দুটো ৭.৬২ এমএম গুলির বাক্স খালি করা হয়। স্রোতস্বিনী পাহাড়ি খালের পানির মোটামুটি পরিষ্কার। তাই তুলে আনে ছেলেরা। বাক্সে মুখ লাগিয়ে খায়। হাইড-আউটের দূরত্ব প্রায় ৩-৪ মাইল। পেটে দানাপানি কিছু না দিয়ে এতদূর হেঁটে যাওয়া! যেতে তো হবেই। দুলুকে বলি,

-পারবেন কিছু খাবার জোগাড় করতে?

-পারিল যাবে।

-মানে?

-পারা যাবে।

—কিন্তু আশপাশে তো কিছুই দেখছি না। সব পরিত্যক্ত বাড়িঘর। মানুষজন সব চলে গেছে ওপারে।

—আমার নাম দুলু। মাহবুবার রহমান প্রধান। চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রধানের ছেলে আমি। এটা আমাদের জোতদারি এস্টেট। দেখেন না পারি কিনা। শুধু হুকুম করে দেখেন ।

-হুকুম তো করা হলো। সেটা তামিল করতে গিয়ে পালান দেবেন না তো?

দুলু হাসে। রিচার্ড হ্যারিসনের অবয়ব ফুটে ওঠে সেই হাসিতে। বলে, একটুখানি অপেক্ষা করেন ।

–মোর নাম মহেন্দ্র সর্দার। দুলু ভাইয়া এইগুলান দিয়া পাঠাইছে।

সের তিনের চাল ভাজা। লবণ আর কাঁচা লঙ্কা। মোতালেব আর একরামুল মিলে সেই শুকনো খাবার পরিমাণমতো মুঠি করে বিলি করে। ক্ষুধার পেটা। আউস চাল ভাজার মোটা দানা। লবণ-কাঁচা লঙ্কা, অমৃতসম মনে হয়।

-আপনি কিসের সর্দার?

—আমাদের জাতির। সাঁওতাল আমরা। ভাইয়াদের প্রজা। তাদের জমি-জিরাত চাষ করি ।

–তাহলে এই এলাকার সাঁওতাল সর্দার আপনি? বেশ তা! দেশ ছেড়ে ওপারে যাননি?

-গেইছে। কেউ কেউ। আমরা যাই নাই। গেইলে কিছুই থাকিবে না।

কালো কুচকুচে শরীর, শক্ত বাঁধন, লোহা পেটানো যেন। মহেন্দ্র সর্দারের চেহারা সর্দারের মতোই। প্রথম দেখাতেই মনে হয়, না ঠিকই আছে নামকরণ পদবি।

-ভাইয়া সন্ধ্যার পর আপনাদের নিয়া যাইতে কহিছেন।

-কোথায়?

-আমাদের পাড়ায় নালাগঞ্জে। সেখানে তো খাসি মারা হয়েছে। সবার জন্য রান্না হচ্ছে।

-বাহ! বিউটিফুল! কতদূর এখান থেকে?

-আধ মাইল হইবে।

-ঠিক আছে। আমরা যাব।

-চলেন আজ রাতে হাড়িভাসা। ওদের তাড়িয়ে দিয়ে আসি।

ভূরিভোজ হয়েছে। এখন মেঘমুক্ত আকাশের নিচে খড়ের গাদার ওপর সবাই শুয়ে-বসে আছি। রাতের অন্ধকারের কালোছায়া চারদিকে। আকাশজুড়ে তারকারাজি। তারই সঙ্গে মিল রেখে যেন চারপাশে খেলে বেড়ায় জোনাকির দল। আকাশের দিকে মুখ রেখে সপ্তর্ষিমন্ডলের দিকে চেয়ে থাকি। শুক্রগ্রহ খুঁজি। দুলু তখন প্রস্তাবটা দেয়। দূরবতী জগদ্দলহাট কিংবা মীরগড় ফ্রন্ট থেকে একটানা মেশিনগানের শব্দরাজি ভেসে আসে। কামান যুদ্ধ আপাতত বন্ধ। কখন আবার শুরু হয়ে যায় ঠিক নেই। এদিকে হাড়িভাসা থেকে প্রতিদিনই পাকসেনারা হামলা করতে আসছে। চাচ্ছে কম্বিং অপারেশন করে তাদের সমূলে উৎপাটন।

আজ ১৪ আগস্ট । পরপর তিন দিন তারা এলো। এভাবে দিনের পর দিন তাদের ক্ৰমাগত আক্রমণ আমাদের সমূহক্ষতি করে ছাড়বে। এর একটা কিছু বিহিত করা দরকার। দুলুর প্রস্তাবটা এ অবস্থায় মনঃপূত হয়। পিন্টু, মুসা, শামসুল চৌধুরী ও একরামুল এদের সবাইকে ডাকি। দুলুও থাকে। রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আঘাত করে হাড়িভাসা থেকে স্থায়ীভাবে তাদের বিতরণের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হয়। মুসা বলে,

–ডেইলি ডেইলি মার খাওয়ার চেয়ে চলেন। ওদেরই আমরা মেরে আসি ।

-মারা কি যাবে? ওরা দারুণ শক্তিশালী। একরামুল বলে।

-দুলু ভাই ঠিকভাবে নিয়ে যেতে পারলে আমরা সফলকাম হতেও পারি।

পিন্টুর জবাব।-আমাদের তরফে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তবুও রিস্ক নিতেই হবে। প্ৰতিদিন এভাবে মার খাওয়া যায় না। আমি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিই।

-ওকে বস্, তাহলে দল রেডি করি। দুলু মিয়া আপনিও রাইফেল নিয়া ফল-ইন হন। পিন্টু এই বলে দুলুকে নিয়ে উঠে যায়।

৩৭

তিনটি দল। কাট-আপ পার্টি, কভার এবং অ্যাসোল্ট পার্টি। পিন্টুর সঙ্গে কভার পার্টিতে থাকে একরামুল। মুসার সঙ্গে কাট-আপ পার্টিতে থাকে শামসুল চৌধুরী। অ্যাসোল্ট পার্টিতে আমার সঙ্গে থাকে মোতালেব ও থাকে দুলু। গাইড এবং ফাইটার দুটি দায়িত্বই সে পালন করবে। সর্বমোট বত্ৰিশজনকে নিয়ে দল তিনটি সাজানো হয়। এলএমজিটা থাকে মোতালেবের কাছে। আর পিন্টুর কাছে থাকে দুই ইঞ্চি” মর্টার। অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন, এম-১৪ বা অ্যান্টি পারসোনাল মাইন থাকে যথেষ্ট পরিমাণে মুসার সঙ্গে ।

যুদ্ধক্লান্ত সবাই। দিনভর নাওয়া-খাওয়া হয়নি। রাতে দুলু মিয়ার চেষ্টায় মহেন্দ্র সর্দারের বাড়িতে হয়ে গেল ভূরিভেজ। ছেলেরা ক্ষুগ্নিবৃত্তি শেষ করে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে খড়ের গাদায় শুয়ে-বসে থাকে। অবসাদে-ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর। আজ রাতেই যে আবার যুদ্ধযাত্রা হবে তা কেউ আঁচ করতে পারে না। বিড়ি-সিগারেট খায়। মৃদু স্বরের কথাবার্তা, হালকা হাসি-মশকরার শব্দ। বাইরে সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির রাস্তার প্রবেশমুখে। জোনাকিরা আলো জেলে আলো নিভিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অন্ধকারে তাদের পথকে আলোকিত করে। আপাত শান্তিময় নিরূপদ্রব রাত। শুধু দূরের শব্দধ্বনি জানান দিয়ে যায়, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। এখন যুদ্ধের সময়। নিজ দেশ বাসভূমি গাওগ্রাম থেকে বিতাড়িত। অচেনা-অজানা সীমান্ত এলাকায় ঝোপঝাড়-জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একটা সাঁওতাল বসতি। মহেন্দ্র সর্দারের বাড়ির দরজায় আমরা বসে আছি। অদ্ভুত লাগে ব্যাপারটা ভাবতে! দুলু আর তার প্রজা মহেন্দ্র সর্দার এখন আমাদের আপনজন, পরম আত্মীয়তুল্য। অথচ সেইসব আপনজন, আত্মীয়জনরা কোথায় এখন? পরাধীন দেশে বন্দি তারা। ভাবতেও পারছে না। আমরা কোথায় আছি। আমরাও জানতে পারছি না। তাদের এখনকার অবস্থা, হাল-চাল, কেমন আছে সবাই, কে জানে?

মহেন্দ্র সর্দার মাঝে-মাঝে মৈলী-মাঈ মৈলী-মাঈ বলে ডাকে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে সদ্য কৈশোর পার হয়ে আসা একটি তরুণী বয়সের মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সর্দার তাকে এটা-ওটা নির্দেশ দেয়। লঘু পায়ে চঞ্চল ভঙ্গিতে মেয়েটি তা পালনের জন্য নিমিষেই হারিয়ে যায়। কালোবরণ কন্যারে তোর কুচবরণ কেশ-মৈলী মেয়েটিকে দেখার পরই প্ৰথমে এই লাইনটি মনের মধ্যে গুঞ্জন দিয়ে ওঠে। বসতবাটির পরিবারগুলো রয়ে গেছে মহেন্দ্র সর্দারকে কেন্দ্র করে। তকতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়িঘর। মেঝে-উঠোন চমৎকারভাবে লেপানো, ময়লা-অপরিষ্কার কিছুই নেই। মাটির ঘরগুলো দেখতে একইরকম। উপরে ছন, কিন্তু দেয়ালগুলোতে হাতে আঁকা নানা ধরনের ছবি। শিল্পী তার মনে থেকে মানুষ, পশু, দেবতা। এগুলোর অবয়ব-আনার চেষ্টা করেছে। কাঁচা হাতের তুলিতে। এটাই তাদের ঐতিহ্য, কালচার। এখনো আদিম স্বভাবের মানুষগুলো কি সুন্দর তাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে!

অন্ধকারে কুপি হাতে বউঝিরা চলাফেরা করে। দু’তিনটা হারিকেন অন্ধকার তাড়ানোর চেষ্টা করে চলে। তাতে দেখা যায় নিখাদ কালো গ্রানাইট পাথরের তৈরি দেহের বাধুনি এক একজনের। বিশেষত মেয়েদের শরীরের গড়ন চোখে পড়ার মতো। কালো রঙ কিন্তু স্বাস্থ্যে-সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কি এমন আহার পায় এরা? অথচ

ভরপুর স্বাস্থ্যু! রীতিমতো বিপজ্জনক শরীরের বাঁক। এরা থাকবে কীভাবে এখানে, খানদের থাবার নাগালের আওতায়? এতদিন ধরে আমরা না হয় ঠেকিয়ে রেখেছি। এরপর শক্ৰদের ব্যাপক প্ৰস্তুতির মুখে তাদের ঠেকানো নাও যেতে পারে। তখন কী হবে এদের? কোথায় যাবে?

মৈলী এসে সর্দারের সামনে দাঁড়ায়। হাতে পান আর বিড়ির প্যাকেট। বলে, বাবা এই নে পান আর বিড়ি। বিড়ি কিন্তু শ্যাষাগে। চাহিলে আর পাবোনি।

সর্দার মাথা নাড়ে। হাত বাড়িয়ে নেয়। বিড়ি এগিয়ে দেয়। আমার পিন্টুর দুলুর উদ্দেশ্যে। মেয়েটির চোখে-মুখে উৎসুক ভাব। ছটফট। চলে যায় না। বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গে ওর চেয়ে কম বয়সী আরো দু’তিনটি মেয়ে, বাচ্চা ক’জন। কাছে ডাকি মৈলীকে। আসে। তাকে বলি,

-ঘরের দেয়ালের ওই ছবিগুলো কে একেছে?

হাসে মৈলী। অন্ধকারে চকচক করে ওঠে সাদা দাঁতের সারি। এদের সবার দাঁত এত সাদা আর সুগঠিত, কেন যে কে জানে? মৈলী বলে

–মোর মা, মহাে অর্থাৎ সে আর তার মা এঁকেছে।

-লেখাপড়া শিখেছে?

-অল্প। নাম লিখতে পারি।

-আজকে যে খাসিটা খাওয়ালে ওটা কার?

-মোর ।

-তোমার দিতে কষ্ট হয়নি?

— বাপ কহিলে। তুমরা খাবেন। সারাদিন কিছু খান নাই। যুদ্ধ করেছেন হামার জইন্যে। জয়বাংলা আনিবেন তুমরা।

অদ্ভুত! এই মেয়েটারও বিশ্বাস, জয়বাংলা আনার দায়িত্ব আমাদেরই! যেহেতু যুদ্ধের মাঠে-ময়দানে আছি এবং আমরা তা আনিবই। আর তখুনি মৈলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের গহিনে যেন কাপন জাগে। সর্দারকে বলি, মৈলী আর অন্যদের এখানে রাখা চলবে না সর্দার। চারপাশে বিপদ।। ওদের সরিয়ে দাও ।

দুলুও বলে, আমিও সেই কথা এদের বলেছি। কিন্তু দেশের মায়া কাটিয়ে যেতে চায় না।

-যাবে। সাকতি শরণাধী ক্যাম্পে রংপুর-দিনাজপুর থেকে বহু সাঁওতাল চলে এসেছে। সেখানে এরাও জেতে পারবে।

সর্দার বলে,

-কেমন করি দ্যাশ ছাড়ি যাই কহেন দেখি?

কঠিন প্রশ্ন। তার কথার জবাব, একমাত্র জয়বাংলা এলেই দেয়া যাবে। কবে হবে সেটা আমাদের জানা নেই।

দুলু তাগিদ দেয়, উঠেন। হাঁটতে হবে অন্তত সাত-আট মাইল ।

বৃষ্টিভেজা পথ-অপথ, খেতবাড়ি, খালের পানির পার হয়ে আমরা এগুতে থাকি। রাত একটা হচ্ছে “এইচ আওয়ার” । সে সময় হবে সম্মিলিত আক্রমণ। রাত ন’টায়

আমরা মহেন্দ্র সর্দারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। ওরা সবাই ছিল বিদায়ক্ষণে । তাদের মধ্যে চোখে-লাগা অপরূপ ভঙ্গিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মৈলী। সর্দারকে বলি, যাই সর্দার।

সর্দার কাপড়ের খুঁটে চোখের পানি মোছে। অবাক ব্যাপার!! লোকটা কাঁদছে? মৈলীকে বলি, যাই।

-আর আসিবেন না?

-আসব।

কুনদিন?

-দেখি, যাদি বেঁচে থাকি। যুদ্ধ শেষ হলে।

সেই থেকে হাঁটছি। মৈলীর সঙ্গে আর দেখা হবে না জানি। মনে মনে বলি, যেখানেই থাক, এই নির্দোষ, উচ্ছল্যপ্ৰাণ মায়াময় মেয়েটি বেঁচে থাক ।

হাড়িভাসা খালের কাছে এসে দলটি তিনভাগে ভাগ হয়ে যায়। এখন সবার ষোলআনা দায়িত্ব পালনের মধ্যেই রয়েছে দলের চূড়ান্ত সাফল্য।

বাজার থেকে শ’তিনেক গজে দূরে রাস্তার ঢালে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছি। কাট-আপ পার্টি প্রথমে মাইন পুঁতবে রাস্তায়। তারপর ফায়ার ওপেন করবে। পিন্টুর পাটি সঙ্গে সঙ্গে শুরু করবে। কভার ফায়ার। তারই আচ্ছাদনে আমরা পৌছে যাব হাড়িভাসা। দুলু ঘুরপথে আমাদের নিয়ে তুলবে। ইউনিয়ন অফিসের কাছাকাছি। তারপর অ্যাসোল্ট, চার্জ গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঝাঁপিয়ে পড়া। ভয়ানক বিপজ্জনক পরিকল্পনা। কী হবে কিছুই আগাম বলা যায় না।

সময় কাটে দ্রুত। দ্রিমি-দ্রিামি বুকের ভেতর ঢাক বাজে। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশিরে শীতল ঠান্ডা অনুভূতি প্রবাহ। অপেক্ষায় দুরূহ ক্ষণ। হঠাৎ করেই এ সময় গুলি শুরু হয়। পিন্টুর মর্টার উড়ে আসে। দুলু বলে, আসেন আমার সঙ্গে। আজ শালদের খতম করে দেয়া হবে ।

দ্রুত দুলুকে অনুসরণ। ‘চার্জ’ শব্দে সতেরজনের যোদ্ধা দল নিয়ে বাজারে প্রবেশ। প্রচন্ড গোলাগুলি। চারদিকে যুদ্ধের ডামাডোল। পিছিয়ে যায় খানেরা-রাজাকারেরা পঞ্চগড় রাস্তা ধরে। অন্ধকারে ধাওয়া করা কঠিন। তবে বটগাছের গুড়ির আড়ালে অবস্থান নিয়ে তাদের উদ্দেশে গুলির তুবড়ি ছুটিয়ে চলে ছেলেরা। আমার কাছে দুলু। উত্তেজনায় কাঁপছে। তাকে শক্ত করে ধরে রাখি। ফিসফিসিয়ে বলি,

-দেশটা স্বাধীন হলে, আপনাকে আমরা এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানাব। চমৎকার মানাবে।

—কি যে কহোন!

কহেনটহেন না। জা বললাম তাই ঠিক।

–সেটা দেখা যাবে। কিন্তু খানেরা যে পালান দিচ্ছে!

আবার সেই পালান দেয়ার কথা। অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে হেসে ফেলি, বলি,

-পালন দিছে, দেউক। সামনেই ধরা খাবে। একরামুল আর শামসুল চৌধুরী আছে ওঁৎ পেতে ।

কথা শেষ হয় না। বুম শব্দধ্বনি দিয়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণ। বোঝা যায় অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন। তাহলে তো খানেরা সত্যিকারভাবেই ধরা খেয়েছে।

একজন সুবেদার মারা গেছে। আহত বেশ ক’জন। পঞ্চগজ থেকে রিইনফোর্সমেন্ট এসেছে নতুন সৈনিকের একটা দল। তারা এলাকা চষে বেড়াচ্ছে। কম্বিং অপারেশনে নেমেছে। মুক্তিদের খুঁজে বের করে অবস্থান দখল করবে। একেবারে বিনাশ করে দেবে তাদের।

কিন্তু পাবে কই? আমরা এখন ভেতরগড়ের মতিনদের বাড়ির দহলিজে শুয়ে আছি। পাশে পিন্টু-দুলু। তারা গান ধরেছে, এই বাংলা, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি …। চমৎকার সুরেলা গলায় দেশের গান ভেসে বেড়ায় ভেতরগড় নামে মুক্ত বাংলার এই অংশে। এখন এই এলাকা পুরোটাই শক্রমুক্ত। মনের গহনে গভীর আনন্দচ্ছটা। সাফল্যের। শক্রকে আমরা ঠেকিয়ে দিচ্ছি। হটে যাচ্ছে তারা এলাকা ছেড়ে। মুক্ত হচ্ছে দেশ। এই হারে চলত থাকলে সব দেশটা একদিন মুক্তাঞ্চল হয়ে যাবে। বুকের মধ্যে গভীর আশার বিলিক। সামান্য করে হলেও কিন্তু হচ্ছে। এগুচ্ছি। আমরা। স্বাধীনতার পানে, জয় বাংলার দিকে। খুব সময় কি লাগবে? দেখা যাক!

পিন্টু গান ধরেছে। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ ভেঙে পড়ছে যেন। বিকেলের আলো সবটুকু শুষে নিয়ে সন্ধ্যার আধার ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। তখন পিন্টুকে গানের নেশায় পেয়েছে। সুরেলা আর দরাজ কণ্ঠ ওর। উত্তরের খােলা জানালাটা দিয়ে বৃষ্টির ছিট আসছে। টিনের ছাদে একনাগাড়ে ঝমঝমানো শব্দ। সব প্রকৃতি ভিজে চলেছে নীরবে-নিশ্চিন্তে । পিন্টুর গলায় সন্ধ্যার মেঘমালার গান। পরিবেশটা যেন কেমন হয়ে ওঠে। স্যাতেসেঁতে ভিজে আর মন খারাপ করে। পুরো বর্ষাকাল চলছে এখন। বৃষ্টির অঝোর ধারা তাই জানান দিয়ে যাচ্ছে এর প্রকৃত রূপ। বৃষ্টিভেজা রাতে আমাদের তখন প্রতি নিশির যুদ্ধযাত্রা।

আজ রাতে আমরা জগদ্দলহাট অপারেশনে যাব।

পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের ওপর পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি, জগদ্দলহাট। বর্ষা-বাদলের আড় নিয়ে আমরা সেই ঘাঁটিতে আজ আঘাত হানব। প্রায় ১৩ মাইল দূরত্ব পার হতে হবে সেখানে পৌঁছতে। ভাঙা পথঘাট, স্রোতস্বিনী খাল, নদী, ফসলের মাঠের আলপথ ধরে যেতে হবে। আমাদের। সাথে হাতিয়ার থাকবে রাইফেল, এসএলআর, স্টেনগান, দুই ইঞ্চি মর্টার। থাকবে কোমরে জড়ানো গোলাগুলি আর গ্রেনেড। শক্রির বাঙ্কার অবস্থান ওড়ানোর জন্য এক্সপ্লোসিভের পুঁটলি। বাছাইকৃত ছেলেদের নিয়ে দল তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যার পর গোলাগুলি ইসু, আর ব্রিফিং। এরপর খাবার বিরতি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম। রাত আটটা নাগাদ যাত্রা শুরু।

যুদ্ধে এসে বিশেষত গেরিলা যুদ্ধে আমরা দু’টো আপ্তবাক্য শিখেছি। তা হচ্ছে ‘জঙ্গল মানেই মঙ্গল’ আর ‘বৃষ্টি মানেই যুদ্ধে-যাওয়া’। জঙ্গলের মধ্যে সহজেই নিজেদের লুকিয়ে ফেলা যায়, আশ্রয় নেয়া যায়। বৃষ্টি হলেই শত্রসেনারা নিজেদের বাঙ্কার-ট্রেঞ্চের মধ্যে গুটিয়ে নেয়। খোলা জায়গায় তাদের পাহারাদারি থাকে না। টহলদারি থাকে না রাস্তাঘাটে। সুতরাং ধুম বর্ষা মাথায় নিয়ে দিব্যি হেঁটে হেঁটে চলে যাওয়া যায় তাদের অবস্থানের কাছাকাছি। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটি সেরে নির্বিয়ে ফিরে আসা যায় নিজেদের হাইড-আউটে। বৃষ্টির দিনে শত্রুর অভিযান প্রায়

থাকেই না। শুধু একতরফাভাবে থাকে তাদের ওপর আমাদের অপারেশন। সেটা ছোট বাঁ বড় যাই-ই হোক।

আজো বৃষ্টি ঝরিছে অঝোরে। বর্ষামঙ্গলের গান নিয়ে। সেই সঙ্গে গলা মিলিয়েছে পিন্টু। নালাগঞ্জের পোড়ো এই টিনের বাড়িটিতে আমাদের হাইড-আউট। বাড়ির বাইরে জঙ্গল-ঝোপ-ঝাড়। বুনো ঘাসে প্রায় মুছে যাওয়া পথ। ভেতরবাড়ির আঙিনাটি কিন্তু অদ্ভুত রকমের সুন্দর। পরিষ্কার তকতকে আর প্রশস্ত। সেখানে ছেলেদের ফল-ইন করানোর জায়গা। এখন সেই আঙিনা বাড়িটি একেবারে সয়লাব পানিতে পানিতে। ছেলেরা নিজ নিজ মেঝের বিছানায় শুয়ে-বসে বিশ্রামরত। রাতের না-হওয়া ঘুম পুষিয়ে নেয়ার জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ গভীরভাবে। জেগে আছে যারা, তারা উৎকীর্ণ হয়ে শোনে পিন্টুর গান। সন্ধ্যার মেঘমালার সঙ্গে পিন্টুর সুরেলা গলা ভেসে বেড়ায় হাইডআউটজুড়ে। দু’চারজন এসে ভিড় জমায়।

আমার পাশে পিন্টু শোয়া। জানালার পাশে মুখ। মাটির মেঝেতে বিছানো শতরঞ্চি। মাথার নিচে ইট দুটো করে বালিশ। সামান্য কিছু খড়টড় দিয়ে নরম করার প্ৰচেষ্টা। সেই ইটের বালিশে মাথা রেখে, এক হাত মাথার নিচে দিয়ে উদাসী পিন্টু হারিয়ে গেছে তার সুরেলা জগতে। তার পাশে একইভাবে শুয়ে থাকি আমি। অন্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকে। কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর, কোথায় এই সীমান্ত-ঘেষা নালাগঞ্জ হাইড-আউট। বৃষ্টিভেজা এমন দিনক্ষণ। সামনে ওঁৎ পেতে থাকা শক্ৰ ভয়ঙ্কর। তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ স্বাধীনতার। জয় বাংলার। হঠাৎ করেই আমরা যুদ্ধের মাঝে এসে পড়েছি। যুদ্ধ মানেই বিভীষিকা। ধ্বংশ আর মৃত্যু। এখন তার মাঝেই আমাদের দিনরাতের বসবাস।

মাথায় দু’টো কলপাতার আড় নিয়ে নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর ব্যর্থ প্ৰয়াস। সেভাবে একজনকে দ্রুত পদচারণায় আসতে দেখা যায়। বুনো ঘাসে ছাওয়া পথটি মাড়িয়ে ঘরে ঢোকার মুখে কলাপাতা দু’টো ফেলে দেয়। তারপর সোজা এসে দাঁড়ায় ঘরের মেঝেতে। সারা শরীর কাক-ভেজা। দরদরিয়ে পানি পড়ে মেঝে ভিজে যায়। সজিম উদ্দিন রেকি মিশনে বের হয়েছিল। সেই সকালে । ফিরছে এখন। কিন্তু ওর চোখ-মুখের অবস্থা দেখে চমকে যেতে হয়। থমকে যেতে হয় ওর হতবিহ্বল ভাব দেখে। মনের ভেতর ‘কু’ ডেকে ওঠে। কোনো বিপদ কি?

সজিমউদ্দিন তখন একেবারে ভেঙে পড়ে। মেঝেতে বসে কেঁদে ওঠে শব্দ করে। হাহাকারের মতো শোনায় সে কান্না। জেগে ওঠে সব হাইড-আউট। দুটে আসে। ছেলেরা, সেন্ট্রিরা শক্ত হয়ে বসে তাদের অবস্থানে। যন্ত্রচালিতের মতো উঠে আসে হাতিয়ার সবার হাতে হাতে। শত্রু আসছে কি? কোথায়, কত দূরে? না অন্য কোনো বিপদ? একটা গোলমাল, এলোমেলো শোরগোল পড়ে যায় হাইড-আউটজুড়ে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ছেলেদের মধ্যে।

পিন্টুর গান থেমে গেছে। সজিমউদ্দিনকে ধরে ঝাঁকুনি দিই। আর জিজ্ঞাস করি, কী হয়েছে বল! সে কিছুই বলে না। শুধুই কেঁদে চলে হু-হু’ শব্দ তুলে। এই সজিমউদ্দিন জুলাইয়ের শেষ ভাগের এক গভীর রাতে পথহারা আমাদের পুরো দলটিকে নিয়ে গিয়ে

তুলেছিল তার নিজ বাড়িতে। সীমান্ত এলাকায় নয়। যতদূর সম্ভব ভেতরে ঢুকে, অধিকৃত বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধ চালানাের জন্য নির্দেশিত ছিলাম আমরা। কিছুতেই আমাদের সম্ভাব্য হাইড-আউট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পঞ্চাশজন যোদ্ধা। সঙ্গে অস্ত্ৰগোলাবারুদ আর পুরো সপ্তাহের রেশনের বিরাট বোঝা। দিকহারা দিশেহারা। প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে বসে পড়েছিলাম বিরাট বাহিনীটা নিয়ে। রাত শেষ হওয়ার আগেই একটা আশ্রয় চাই। নিরাপদ এবং নিরূপদ্রব। কোথায় পাওয়া যাবে তেমন আশ্ৰয়? তখন এগিয়ে এসেছিল সজিমউদ্দিন। চলেন। আমাদের বাড়িতে। কাছেই বদলুপাড়া গ্রামে। তার সম্ভাব্য বিপদ-আপদ এগুলো নিয়ে সে কিছুই ভাবেনি। আমাদেরও ভাবার মতো তেমন অবকাশ ছিল না। শেষ রাতে, সবার অগোচরে অলক্ষে আমরা গিয়ে চুপচাপ উঠেছিলাম তার বাড়িতে। মাত্র আধা মাইলের দূরত্বে, সেখান থেকে শক্ৰ বাহিনীর ঘাঁটি বিসমনি ব্রিজের ওপর।

সে যাত্রায় শামসুল অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার শয্যাপাশে নিয়ত সেবারত এক নারী। নরম-কোমল। দীপ্ত কমনীয় মুখ। দুদিন পর ফেরার রাতে সেই নারী কাদছিল অঝোরে। সজিমউদিনের তরুণী স্ত্রী। সজিমউদ্দিন আসতে পারছিল না। তাকে ছেড়ে । মায়াবতী এই মেয়েটি দুদিন দৌড়-ঝাঁপ করে আমাদের যত্ন-আত্তি করেছে। আমরা সজিমউদ্দিনকে তার কাছে রেখে যেতে মেয়েটিকে আমরা কিছুই বলতে পারছিলাম না। যুদ্ধ এদের শান্তিময় নিরিবিলি জীবনকে তছনছ করে দিয়ে গেছে।

তার ওপর আমরা থেকে গেলাম। এখানে দুদিন। ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে শত্রুর কাছে পৌছবেই। নেমে আসবে হয়তো এদের গোটা পরিবারটার ওপর শক্রর ক্রুব্ধ রোষা। ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকা। সেই রকম সম্ভাব্য বিপদ তাদের সামনে বুলিয়ে রেখে এসেছিলাম। সে রাতে ।

তার ওপর আমরা থেকে গেলাম। এখানে দুদিন। ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে শক্রর কাছে পৌঁছবেই। নেমে আসবে হয়ত এদের গোটা পরিবারের ওপর শত্রুর ক্রুদ্ধ রোষ। ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকা। সেই রকম সম্ভাব্য বিপদ তাদের সামনে বুলিয়ে রেখে এসেছিলাম। আমরা সে রাতে ।

ঘটেছে কি তেমন কোনো বিপদ? বুকের গহিনে উকি দেয়া শঙ্কাবোধ থেকে সজিমউদিনের সামনে থির হয়ে বসি। ইশারায় পিন্টুকে পাশে ডাকি। সরে যেতে বলি অন্যদের। ঘর খালি হয়ে গেলে জিজ্ঞাস করি, বল কী হয়েছে? উত্ৰান্ত দৃষ্টি চোখেমুখে। কেমন ঘোরলাগা ভাব। সে অবস্থায় সে বলে, খানসেনারা এসেছিল আমাদের বাড়িতে।

-কবে?

-কাল

-কী করেছে তারা?

—লুটপাট করছে, ধরেছে, মেরেছে, আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে পুরো গ্রাম।

-আর?

-ধরে নিয়ে গেছে বাবা-চাচাদের।

-তোর বউ?

এবার শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় সজিমউদ্দিন। তারপর গামছা দিযে মুখ চেপে ধরে কাদতে থাকে। ফুলে ফুলে।

-বল তোর বউ কোথায়?

মাথা নাড়ে সে, জানে না। তার মানে? তাহলে কি মায়াবতী সেই মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেছে। খান আর রাজাকার বাহিনী? বুকের ভেতর অনাগত আতঙ্ক হাতুড়ি প্রচণ্ড আঘাত করতে থাকে। সেই সঙ্গে বিরাট একটা অপরাধবোধ । তাদের বাড়িতে দুরাতের হাউড-আউটে না থাকলে হতো না কোনো অঘটন। থাকতো ঠিক সবকিছুই । সেই বোধ থেকে জিজ্ঞাস করি,

-খোজ করিস নাই? কি জেনেছিস?

—সাতজন মেয়ে মানুষকে তারা নিয়ে গেছে সঙ্গে।

-কার কাছে জানিলি?

—একজন গ্রামের মানুষ।

-তাদের মধ্যে তোর বউ ছিল?

-জানি না। মাথা নেড়ে জবাব দেয় সজিমউদ্দিন ভেঙে-পড়া মানুষের মতো। সেদিকপানে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করি,

-খানসেনার দলটি এখন কোথায়?

-পানিমাছ হাটে ডিফেন্স তৈরি করে অবস্থান নিয়ে আছে তারা।

-ফিরে যায়নি?

-না।

এর বেশি আর কিছু এখন পাওয়া যাবে না। সজিমউদ্দিনের কাছ থেকে। তাকে ছেড়ে দিই। লঙ্গর কমান্ডার মমতাজকে ডেকে তাকে গরম খাবার দিতে বলি। বলি তাকে কাপড়-জামা বদলে রেস্ট নিতে।

হঠাৎ করেই সামনে এক কঠিন মিশন এসে গেল। নির্ধারিত জগদ্দলহাট মিশন আজ বাদ যাবে। যেতে হবে আজ পানিমাছহাটে সদ্য তৈরিকৃত পাক ডিফেন্সে। ধূত সাত মহিলার মধ্যে অবশ্যই মায়াবতী সেই বধূট রয়েছে। সজিমউদ্দিনের বউসহ অন্যান্য মহিলাকে উদ্ধার এবং পাকসেনাদের সেখান থেকে উৎখাত। কাজটি বড়ই কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। নিতেই হবে ঝুঁকি, উপায় কি? দুরাতের আশ্রয় এবং অন্নের ঋণ শোধ তো দিতেই হবে। নইলে নিজেদের ক্ষমা করা যাবে না।

সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিই পিন্টুকে । তৈরি হয়ে নিতে বলি মুসা, একরামুল ও শামসুল চৌধুরীকে। বাইরে বর্ষামঙ্গলের গান চলতেই থাকে, সেই সঙ্গে চলতে থাকে হাইডআউটের ভেতরে ছেলেদের ঝটপট প্ৰস্তুতি ।

রাত বারোটার দিকে শুরু হয় আক্রমণ। প্ৰথমে ২ ইঞ্চি মর্টার। অতঃপর মেশিনগান, এসএলআর, রাইফেল। তিনদিক থেকে এগিয়েছি। আমরা। হাড়িভাসার দিকে থেকে শামসুল চৌধুরী, বদলুপাড়ার দিক থেকে একরামুল, মুসা। আর সোজাসুজি আমি আর পিন্টু। ৪৫ জনের শক্তিশালী সম্মিলিত দল। সঙ্গে সব ধরনের হাতিয়ার আর গােলাবারুদ। বৃষ্টি মাঝখানে ধরে এসেছিল। আবার শুরু হয়েছে প্রবল বেগে। সেই বৃষ্টির আড়াল নিয়ে আমরা আসতে পেরেছি শক্র অবস্থানের অতি কাছাকাছি।

২ ইঞ্চি মর্টারের প্রথম গোলা বিস্ফোরিত হয় শক্ৰ অবস্থানের কাছাকাছি, প্রচন্ড ধ্বনি আর বিজলি ছটার বিচ্ছরণ নিয়ে। আরো কটা শেল ছুটে যায়। পরপর পড়তে থাকে সেগুলো শত্রুঘাঁটির ওপর। জেগে ওঠে শক্র । শুরু হয় তাদের প্রতিরোধ। তিনদিক থেকে আক্রান্ত তারা। প্রথমে কিছুটা এলোমেলো বিশৃঙ্খলা। কিন্তু জাত সৈনিক তারা। সামলে ওঠে। শুরু করে মহাবিক্রমে প্রতিরোধ। পাঠাতে থাকে শতসহস্র গুলির তুবড়ি। স্রোতের মতো ভেসে যেতে থাকে সেগুলো মাথার ওপর দিয়ে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাওয়া ফসলের মাঠ, খেতবাড়ি, আলোর উঁচু পাড়ে আড়াল নিয়ে শরীর কাদা-পানিতে ডুবিয়ে আমরা শত্রুর গুলির জবাব দিতে থাকি আর সেই সঙ্গে চেষ্টা করি একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। ডানে-বায়ে অবস্থান নেয়া শামসুল চৌধুরী-একরামুল-মুসারাও একইভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ত্রিমুখী আক্রমণের মোকাবিলা করতে গিয়ে খানসেনাদের হিমশিম খাওয়া অবস্থা। কিন্তু মাটি কামড়ে লড়ে চলে তারা। হাল ছেড়ে দিলেই নিৰ্ঘাত পরাজয়, মানে অবধারিত মৃত্যু। সেই মৃত্যুভয় থেকে অস্তিত্বের লড়াই তাদের মরিয়া হয়ে ওঠে।

সামনে একটা ঝিলের মতো নিচু জলাভূমি। তার ওপারেই কালোমতো উঁচু জায়গাটি হচ্ছে পানিমাছ বাজার। হাড়িভাসা-পঞ্চগড় জেলা বোর্ডের রাস্তার ওপর। সেখানে পৌঁছতে হলে জলাভূমিটি পার হয়ে যেতে হবে। প্রথমে মনে হয়েছিল সেটা পাড়ি দেয়া যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তা প্ৰায় অসম্ভব। মালেক, খলিল ওরা নেমে গিয়েছিল। কচুরিপানা, বুনো ঘাস এগুলো ছেয়ে আছে জলাভূমিটা। কিছুদূর এগুতেই অথৈ পানি। পুরো জয়গাটি সাঁতরে যেতে হবে কচুরিপানার জঙ্গল সরাতে সরাতে। সেটা সম্ভব নয়। অগ্রাভিযান থেমে যায়। তাই জলাভূমির পাড়ে এসে। মোতালেবের এলএমজি এবং এসএলআরধারী ছেলেরা তাদের শক্রমুখী গুলিবর্ষণ চালিয়ে যেতে থাকে একনাগাড়ে। তাদের সে কাজে রেখে আমি চেষ্টা করি কিছু একটা উপায় খোঁজার।

কিছুটা ঘুরপথে হলেও শত্রুঘাঁটি পর্যন্ত চড়াও হতেই হবে। বুকের ভেতর একটি ছবি বসে থাকে। ক্ৰন্দনরতা একটি ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা মেয়ে। কেরোসিনের ডিবোয় আলোকিত একটি মায়াবতী মুখ। তার প্রিয় মানুষ চলে যাচ্ছে যুদ্ধ, তার জন্য ব্যাকুল কান্না। যুদ্ধ তার সাজানো সংসার এলোমেলো করে দিয়েছে। জয়বাংলা না হলে সেই সংসার সে আর সাজাতে পারবে না কিছুতেই। সেই ঘাটি ভাঙতে না পারলে তাকে উদ্ধার করা যাবে না। তাকে না পাওয়া গেলে সজিমউদ্দিনের যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। পাগল হয়ে যাবে সে।

মধ্যরাতের পর মনে হয় খানসেনারা হাল ছেড়ে দিচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে তারা। নবউদ্যমে জেগে ওঠে সবাই। পেছনের অবস্থানের রাখা পিন্টুকে খবর পাঠাই ধমাধ্যম মর্টার শেল পাঠাতে। মনে হয়, এই ধারা বজায় থাকলে খানেরা পিছুটান দেবে। জলাভূমির ডান দিক ধরে আমরা পৌছে যেতে পারব জেলা বোর্ডের সড়কে এবং তারপর তাদের ঘাটিতে। ভোর হওয়ার আগেই আমরা দখলে নিতে পারব তাদের ঘাটি ।

কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। বাঁয়ের দিকে হঠাৎ করে থেমে যায়। শামসুল চৌধুরী। মুসা-একরামুলও থেমে যায় কিছুক্ষণের মধ্যে, শুধু যুদ্ধের ফ্রন্টকে একাই জিইয়ে রাখে। মোতালেব আর তার বাহিনী ।

রাত শেষ হয়ে আসতে থাকে। বৃষ্টিও ধরে আসে। ছেলেদের কাছ থেকে খবর আসতে থাকে গুলি শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। আর বেশিক্ষণ কুলিয়ে ওঠা যাবে না। এ অবস্থায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিছুতেই। এই বাস্তববোধ থেকে মোতালেবকে নির্দেশ দেই গুলি চালিয়ে যেতে। অন্যদেরও সেই গুলির কভার নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে পিছু চলে যেতে নির্দেশ দেই। ছেলেরা কাদায়-পানিতে মাখামাখি হয়ে ফিরতে থাকে। সবশেষে মোতালেবকে তুলে নিয়ে আমি ফিরে চলি, হামাগুড়ির ভঙ্গিতে পানি-কাদার ভেতর দিয়ে অনেকটা সরীসৃপ প্রাণীর মতো। মাথার ওপর দিয়ে তখনো ছুটে চলে শক্রির অবিরাম গুলির প্রবাহ হুইসেল বাজানোর শব্দধ্বনি নিয়ে। আমরা আর পেছনে তাকাই না। শক্রির ওপর আমাদের আঘাতটা ভালোই হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু ওদের পরাস্ত করা গেল না। আর গেল না বলেই সেখানে থেকে গেল সেই মায়াবতী মেয়েটি। মনের গভীরে এই দুঃখ বোধটা চেপে রেখেই ফিরে চলি আমাদের নিরাপদ আশ্রয় নালাগঞ্জ হাইড-আউটের দিকে ।

মেঘ-ভাঙা রোদ উঠছে। চমৎকার! সারা সপ্তাহ গোমড়ামুখো আকাশ। একটানা বর্ষণ, সব প্রকৃতিকেই ভিজে সঁ্যাতসেঁতে করে দিয়েছে। এর মাঝ দিয়েই চলেছে রাতের বেলায় যুদ্ধাভিযান। রাতভর কর্দমাক্ত পথঘাট, ফসলের মাঠ, খাল-বিল-নদী এগুলোর মধ্যে পদচারণা। পথ ছেড়ে অপথ দিয়ে শক্রির কাছাকাছি পৌছানোর চেষ্টা। ক্লান্তিময় কষ্টকর জীবন। সামনে অনিশ্চিত দিনক্ষণ। স্বাধীনতা। জয়বাংলা । সে তো ধরাছোয়ার বাইরে। যেন কষ্টকর দুঃস্বপ্ন একটা। সেখানে পৌছানো কবে যাবে? কিংবা আদৌ যাবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। একটা দানবতুল্য শক্তি দেশটা করে রেখেছে জোর করে বেদখল। ছিড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে তারা সবকিছু। বিষফোঁড়ার মতো গজিয়ে সহযোগী শক্তি। লুটপাট, অত্যাচার, হত্যা, মৃত্যু, রক্ত বিভীষিকাময় জীবন। মৃত মানুষের লাশের সারি। বাতাসে পচনযুক্ত মাংসের দুৰ্গন্ধ অসহনীয়। শেয়াল-কুকুরের কামড়াকামড়ি। মহাভেজ। সেই সঙ্গে বাতাসে পোড়া বারুদের ভারি গন্ধ। নিজ দেশে পরবাসী ভীত-বিহবল মানুষ। মৃত্যু তাদের পিছু ছুটছে। সদা পলায়নপর তারা মুক্তঞ্চলের খোজে। প্রতিদিন শত-সহস্র মানুষের কাফেলা। শরণার্থী তারা। সীমান্ত পেরিয়ে যায় প্রতিদিন। নিজ বাসভূমি, সহায়-সম্পদ ফেলে।

আমরা তাদের যাওয়া ঠেকাতে পারি না। বলতে পারি না দেশে থেকে যেতে। করতে পারি না তাদের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা। সীমিত শক্তি আমাদের। স্বল্পসংখ্যক অস্ত্ৰগোলাবারুদ। অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, লজিস্টক সাপোর্ট। চারদিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা। যুদ্ধের কমান্ড-কৌশল ইত্যাদি গড়ে ওঠেনি এখনো সঠিকভাবে। সন্দেহ আর অবিশ্বাস সবখানে। এ রকম অবস্থায় আমাদের গেরিলা যুদ্ধ শত্রু বাহিনীর সাথে। অসম এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে টিকে থাকা মুশকিল। শুধু অদম্য মানসিক শক্তি আর সাহস এ দু’টো দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেই আমরা এতো সব প্রতিকূল অবস্থায় টিকে আছি। যুদ্ধ করছি। কখনো সফলতা, কখনো ব্যর্থতা। সতীর্থ সহযোদ্ধা গোলাম গউস, আক্কাস ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। আহত অবস্থায় যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে পেছনে চলে গেছে অনেকে চিকিৎসার জন্য। নিজ দেশে যেন

অপরিচিতজন। দিনে-দুপুরে বের হওয়ার উপায় নেই। শক্রির চর চারদিকে। যে কোনো সময় ধরিয়ে দিতে পারে তারা। তাদের চোখ বাঁচিয়ে সবার অলক্ষে রাতের বেলায় লুকিয়েছাপিয়ে আমাদের প্রতিদিনের অপারেশন যাত্রা। এ যাত্রা কবে শেষ হবে তার নিশ্চয়তা নেই। আমাদের ফেরার কোনো উপায় নেই। শুধু এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। এই এগিয়ে যাওয়া চলবেই অক্লান্ত, জয়বাংলার সোনালি সূৰ্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত।

এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি আর পিন্টু-একরামুলদের নিয়ে গত রাতের যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ নিয়ে বসেছি। প্রতিটি অপারেশন তথা যুদ্ধের পর হাইড-আউটে ফিরে এসে যে কাজটি করতে হয় তা হচ্ছে, হিসাব-নিকাশ মেলানো। কী পরিমাণ গোলাবারুদ খরচ হলো তা হিসাব করে বের করতে হয়। সেই সঙ্গে মেলাতে হয় ব্যালেন্স কী রইল, তা। নোট বইয়ে সেটা টুকে রাখতে হয় এবং উল্লেখ করতে হয় যুদ্ধের বিবরণ, তার ফলাফল, নিজেদের এবং শক্ৰদের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান।

বাইরে ঝলমলে দিন। গত রাতের যুদ্ধফেরত ছেলেরা ঘুমে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে যার যার জায়গায়। শরীরের কাদা-মাটি পরিষ্কার করারও সময় পায়নি। আমার নিজের চোখের পাতাও ভারি হয়ে আছে। মাথায় ভো ধরা ভাব।

সামান্যক্ষণের জন্য শরীর এলিয়ে দেয়ার প্রচন্ড তাগিদ। কিন্তু তা করতে গেলেই অসীম ক্লান্তি নিয়ে ঝাপ করে নেমে আসবে গভীর ঘুম। না, এখন তা হতে দেয়া যাবে। না। চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করে গত রাতের যুদ্ধের রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। তা আগামীকাল পেশ করতে হবে কমান্ডিং অফিসারের কাছে।

সবার রেস্ট থাকলেও কমান্ডারের রেস্ট নেই। যুদ্ধ শেষের হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলে অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্ৰদান। আদেশ-নির্দেশের মধ্যে বড় অংশজুড়ে থাকে লঙ্গরখানার রেশনসামগ্ৰী। তিনবেলা আহারের নিশ্চয়তা ‘বিধানের দায়িত্ব কোয়াটার মাস্টার মিনহাজ আর লিঙ্গরখানার কমান্ডার মমতাজের। তারা আসে সিদ্ধান্ত নিতে। সারাদিনের মেনু কি হবে। রেশনের মজুদ অবস্থা নিয়ে হিসাব-নিকাশ হয় এবং তার ওপর নির্ভর করে চাহিদাপত্র ঠিক করতে হয়। যুদ্ধ একটা কষ্টের ব্যাপার। এর জন্য চাই দু’টো সাপোর্ট। রেশন আর গোলাবারুদ সরবরাহের নিয়মিত নিশ্চয়তা। না। খেয়ে যেমন যুদ্ধ করা যায় না, তেমনি গোলাবারুদের ঘাটতি নিয়েও যুদ্ধে যাওয়া যায় না। দু’টোর মজুদ যাতে ঠিক থাকে, এ নিয়ে তাই থাকতে হয় সদা সতর্ক।

গত রাত তথা ১৮ আগস্ট পানিমাছের যুদ্ধের খতিয়ান নোট বইয়ে তুলে নিই এভাবে-

18.8.71

Attacked the Panimash defence from 3 directions. 2″ mortar shelling on the bunker of their defence. Fight continued upto late night. No perfect news of casualties. Total expenditure of ammns.

.303-                  175+14=           289 Rds.

7.62-                  50+21=           71 Rds.

9mm-             15+132=               283 Rds.

2″ Mortar-              5                 bombs

ঘুমে ঘুমে কেটে যায় দুপুর। বিকেলে কখন আকাশজুড়ে মেঘ করেছে। টের পাওয়া যায় নি। বর্ষার মেঘ। মাথার ওপর ঘনায়মান হলো তো নামল ঝমকামিয়ে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির একটানা শব্দের ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে যেন কেউ জাগিয়ে দেয়। দেখি, পাশে পিন্টু মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে। জানালা পথে বাইরে, বিমোহিত চোখমুখ। কেমন একটা ভালোলাগা অনুভূতি আমার নিজের মধ্যে ভর করে। আর সেই বাধে থেকে আমিও পিন্টুর মতাে বাইরে একটানা ঝরে-যাওয়া বৃষ্টির রূপ দেখতে থাকি। কিন্তু বেশিক্ষণ এই ঘোরের মধ্যে থাকা হয় না। একটা হৈচৈ শব্দ ওঠে। গতকালের মতোই কাকা-ভেজা হয়ে ঢুকতে দেখা যায় সজিমউদ্দিনকে। আজ তার চোখেমুখে অন্যরকম ভাব। সেই বিহ্বলতা নেই। তার বদলে সজীব হাসি আর ফুল্ল গলায় সে বলতে থাকে, তাকে পাওয়া গেছে!

-কাকে?

-আমার বউকে ।

-বলিস কি! কোথায়?

-ভেতরগড় ওখানে গেল?

-কীভাবে ওখানে গেল?

-কাল রাতে যখন পানিমাছ আক্রমণ করা হয়, তখন ওরা শত্রু ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যায়। গিয়ে ওঠে আমার মামার বাড়িতে। খোজ পেয়ে সেখানে যাই এবং তাদের দেখা পাই। এইসব বলে সজিমউদ্দিন কেঁদে ওঠে। থামে। হাসে, আবার কাদে। তার হাসি-কান্নার ভেতর বর্ণনা পাওয়া যায় কীভাবে অন্যান্য বন্দির সঙ্গে সজিমউদিনের বউ পালাতে পেরেছে। আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শক্রিরা বিচলিত হয়ে দৌড়-ঝাঁপ করে অস্ত্ৰ হাতে যুদ্ধে নেমে যায়। বন্দিদের দিকে তাদের আর দৃকপাত থাকে না। সেই সুযোগে দ্রুত তারা বের হয়ে আসে শত্রুঘাটি থেকে। তারপর কর্দমাক্ত পথঘাট ভেঙে শুধুই ছুটে চলা। ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে পৌছে যায়। ভেতরগড়। রেকি মিশন থেকে এই খবরটা সজিমউদ্দিন পেয়ে যায়। অতঃপর তারও ছুটে চলা ভেতরগড় পানে।

সেই ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা মেয়েটি। মায়াবতী চেহারা। গ্রামবাংলার রূপলাবণ্যে ভরপুর এক গৃহবধূ, তরুণী নারী। আমাদের সজিমউদ্দিনের বউ। ক’দিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া, সে তো নিদারুণ কষ্ট আর হীনম্মন্যতার ব্যাপার!

কেমন আছে মেয়েটি?

এই কথাটি জানার জন্য বুকের ভেতর গভীর আকুলিবিকুলি। তা জিজ্ঞাস করার সাহস পাই না। কিন্তু সজিমউদ্দিনের ঝলমলে মুখভাব, তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দারুণভাবে আলোড়িত করে। সেই ভাবের মধ্য থেকে পিন্টু গতকালের সাধা গানটিই গেয়ে ওঠে, “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা ”। তার গান ভেসে বেড়ায় আমাদের চারধারে অপূর্ব সুরের মায়াজাল তুলে। বিমুগ্ধচিত্তে বসে থাকি আমরা তার পাশে চুপচাপ।

রচনাকাল ১৯৯৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!