মুক্তিযুদ্ধকালে সরকারের আদেশে বহু সিভিল অফিসার (আমাদের আলােচ্যক্ষেত্রে সিএসপি-ইপিসিএস) এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি হয়েছিলেন। বদলিটা হতাে প্রায়শ চাকুরির প্রচল নিয়মে, সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত চেষ্টায়-তদ্বিরে বা স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের কোপানলে পড়ে। তবে তখনকার বৈরী পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বদলির আদেশ পেয়ে অনেক কর্মকর্তা তা বাতিল করার চেষ্টা করতেন। অনেকে সফলকাম হতেন, আর যারা ব্যর্থ হতেন শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে বদলিকৃত কর্মস্থলে যােগ দিতেন। এপর্যায়ে এরকম দু-একজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরব। এখানে এটাও জানিয়ে রাখি, সেই অবস্থায়ও অনেক কর্মকর্তা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ বিবেচনায় অবরুদ্ধ স্বদেশে না থেকে বা কোনােপ্রকার মুক্তিযুদ্ধে যােগ না দিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণের নামে।৪৭ এদের কেউ কেউ আবার সপরিবারে দেশান্তরী হয়েছিলেন। অন্যদিকে যারা আগে থেকেই বিদেশে প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নিয়ােজিত ছিলেন, গােটা মুক্তিযুদ্ধপর্বেই সেখানে অতিবাহিত করেছেন তারা। এই তালিকায় বেশ কয়েকজন বাঙালি সিএসপির নাম আসতে পারে। আবার এদের কারাে কারাে সম্বন্ধে এটাও জানা যায়, প্রবাসে থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সংগঠনে কাজ করেছিলেন।
যাই হােক, প্রশিক্ষণে থাকাদের দু-একজনের বক্তব্য জানা যাক। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কিছুকাল পূর্বপাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ বিভাগের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৫৮ সাল-ব্যাচের বাঙালি সিএসপি কাজী আজহার আলি। পরে তিনি পূর্ব-আদেশের অনুবর্তনে বহু দেন-দরবার করে শেষতক বিদেশে চলে যেতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আরেক ফ্রন্ট শীর্ষক তার আত্মকথাসদৃশ রচনায় কাজী আহজার আলি লিখেছেন: “১৯৭১ জানুয়ারিতে হার্ভার্ডে আমার ভর্তি সম্পন্ন হয়েছে এবং পাকিস্তান সরকার ও ঢাকা প্রাদেশিক সরকার আমাকে উচ্চশিক্ষার জন্য এক বছরের ছুটি মঞ্জুর করেছে ।.. জুন মাসে এজন্য আমাদের যুক্তরাষ্ট্র যেতে হবে। মার্চ মাসে এত অত্যাচার সত্ত্বেও অপেক্ষা করেছিলাম জুন মাসে পড়তে যাবার আশায়। মে মাসে আমাকে লাহােরে বদলি করায় আমি বুঝতে পারি যে পাকিস্তান সরকার আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যেতে দেবে না।….. / ইতিপর্বে আমার স্ত্রী সকিনা (গ্রন্থে ‘সাকিনা’ বানানও লভ্য) আজহার উচ্চশিক্ষার জন্য ‘টাফট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এই স্কলারশিপে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেয়ার ব্যবস্থা আছে। অতএব সপরিবারে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্র যাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। ভেবেছিলাম এভাবে ঢাকার অসহ্য পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারব। কিন্তু বিধি বাম হলেন ।.. পাকিস্তান সরকার আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার এই প্রােগ্রামে যেতে দেবার প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানায়। বহু চেষ্টার পরে ছেলে শান্তনু ও মেয়ে ইলােরাকে ঢাকায় (‘আমার শ্বশুর অতিরিক্ত চিফ সেক্রেটারি আব্দুল কাদের আনসারীর হেফাজতে’) হােস্টেজ রেখে স্ত্রী সাকিনাকে নিয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বােস্টন বিমানবন্দরে পৌছালাম।… ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালে আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা করছিলাম।”৪৮
অন্যদিকে যারা কর্তৃপক্ষীয় বদলি-আদেশ স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে তামিল করেছিলেন, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তাে নতুন কর্মস্থলে যােগ না দিয়ে মাঝপথে পাকিস্তান সরকারপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে পারতেন, যেটা করেছেন তাদেরই কোনাে কোনাে সহকর্মী। যারা সেটা করেননি, তারা কেন করেননি- তা তারাই ভালাে জানেন। হয়তাে তাদের সেজন্য সঙ্গত কারণ ছিল, যেমনটা শওকত ওসমান তার এক রচনায় লিখেছেন (পরে বর্ণিত)। আর যারা স্বদেশে থেকে কোনাে রকমে প্রাণ হাতে নিয়ে চাকুরি করেছেন, তাদেরও অনেকে তখন নিয়মিত অফিস করেননি।
এপ্রসঙ্গে খােদ ঢাকা সচিবালয়ে যারা চাকুরি করেছেন, তাদের কারাে কারাে কথা বলা যায়। যেমন, কাজী আজহার আলি লিখেছেন: “আমি তখন স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ বিভাগের সচিব ছিলাম। আমি নিয়মিত অফিসে যাই না। ব্যক্তিগত কাজ থাকলে এবং চিঠিপত্র আনার জাঝেমধ্যে সচিবালয়ে যেতে হয়।”৫০
অন্যদিকে পথের নানা ঝক্কি-ঝামেলা সত্ত্বেও বদলিকৃত কর্মস্থলে যারা যােগ দিয়েছিলেন, এবার তাদের দু-একজনের অভিজ্ঞতা জানা যাক।
প্রথমেই জানব ১৯৬৫ সাল-ব্যাচের সিএসপি (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সচিব) এ, এইচ, এম, আবদুল হাই-এর অভিজ্ঞতা। একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও ট্রাভেলগ’ রচয়িতা হিশেবে ‘হাসনাত আব্দুল হাই’ নামে তিনি সমধিক পরিচিত। জনাব আবদুল হাই মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে কিছুকাল ছিলেন পটুয়াখালীতে এবং পরে সেখান থেকে স্থানান্তরিত হন ঢাকা সচিবালয়ে। ঢাকায় ২৫ শে মার্চ রাতে আর্মি ক্র্যাকডাউন শুরু হলে তিনি সপরিবারে প্রথমে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে এপ্রিল মাসে নৌপথে ‘অস্ট্রিচ স্টীমারে ও লঞ্চে বদলিকৃত কর্মস্থল পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে যােগ দেন। জানা যায়, বদলির আদেশ তামিলে তিন- মাস কালক্ষেপণ করছিলেন। পরে সামরিক সরকারের তরফে প্রবল চাপের কারণে সেখানে যেতে বাধ্য হন। যাই হােক, ঢাকায় তিনি হানাদারদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার যে চিত্র দেখেছিলেন, তার নিজের ভাষায় তা এরকম: “For two nights and one full day Dacca was under curfew when the Pakistan army carried out their barbaric acts of death and destruction. After one day when the curfew was lifted I along with other people came out to make some urgent purchases. The city looked devastated and was beyond recognition. No shop was open and those which were had nothing inside, having been torched and looted. Dead bodies were found lying before shopfronts, in streets, roadsides, at the entrance of houses and all around the burnt slums. Several rickshaws were seen with their passengers and pullers shot and killed.”৫১ ঢাকা থেকে পটুয়াখালী যাওয়ার পথে যে দৃশ্যাবলি প্রত্যক্ষ করেন, বলাবাহুল্য, তার কিছু কিছু নবীন এ কথাসাহিত্যিক-আধিকারিকের কাছে বিশ্বখ্যাত কোনাে কোনাে সাহিত্যকর্মের সঙ্গে প্রতিতুলনীয় মনে হয়েছিল। বােঝাই যায়, তখন তার মানসিক স্থৈর্য ও দার্ঢ্য কী অটুট ছিল, সঙ্গে সাহিত্যিক বােধি ও কল্পনাও । তার ভাষায়: “As in Sophocles’ Antigone the dead bodies were not allowed to be buried but were left to rot, making a feast for vultures, dogs, crows and other scavengers.”৫২
পথিমধ্যে নদীবক্ষে এবং নদীতীরের গ্রামগুলাের যেসব দৃশ্য তার চোখে পড়েছিল, তারও কিছু কিছু বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন: “On my way to Patuakhali in April I saw groups of dead bodies floating in Buriganga and Shitalakhya rivers with their hands tied behind them. The carcasses were being fed on by vultures and crows and the rotten smell wafted to the middle of the river where the steamer Ostrich was pedaling forward. The same scene was visible at various places near the river side all along the way to Patuakhali. Rivers that were usually a lively place swarming with boats and noisy with frolicking little boys wore a deserted look. There was no sign of life in the river or on the riverside villages, I felt like Marlowe going through Congo river in the novel. Heart of Darkness, the difference being there was no renegade at Patuakhali lording it over his territory.”৫৩
পটুয়াখালীতে পৌছানাের পরে জেলা প্রশাসক তাকে দেখে যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হন এবং তিনি সেই মহাদুর্যোগের মধ্যে কীভাবে সশরীরে পৌছলেন সে প্রশ্ন করলে দুজনের মধ্যে যে কথোপকথন হয়, তা এরকম৫৪: “As I reached the house of the deputy commissioner Mr. A was surprised to see me as if I was an apparition and asked me how did I come. I told him that I took a near empty launch from Barisal and walked from the launch chat of Patuakhali to his house. Still surprised, and gawking, he took me inside and made me sit beside him. Pulling down his dirty underwear and lungi he showed a bandaged wound just below the navel and said when army occupied Patuakhali they came to his house and shot him point blank even though he had introduced himself as the DC.* Then he looked at me and asked, “Why have you come at a time like this? There is no safety for anyone. If they could shoot to kill me they can kill anyone they like. Taking a pause he said. They have license to kill any Bengali.’ Then correcting himself he said, ‘No. I am wrong. They don’t need any license to kill?’ I told him that the army authorities in Dacca were making a list of officers who had not joined their place of posting. Having postponed my joining for three months I had no choice but to come to Patuakhali.”
তার কোনাে ‘choice’ বা পছন্দ ছিল না!- মন্তব্য নিষ্প্রয়ােজন।
এভাবে তিনি নতুন কর্মস্থলে গিয়ে যােগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে ক’মাস কাটিয়ে ঢাকায় এসে ‘এসঅ্যান্ডজিএ’ দপ্তরে যােগ দেন (জুলাইয়ের দিকে) এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সেখানে উপসচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। পটুয়াখালী কর্মকালে তিনি মূলত ১৯৭০ সালের বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ এবং ঢাকায় আসার পর প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের সভায় উপস্থিত থেকে প্রয়ােজনীয় নােট্স নিতেন।
তার ভাষ্য থেকে আরও জানা যায়, ঢাকায় থাকাকালীন অবসর সময়ে তিনি ও তার সহকর্মীরা (স্বদেশি-পাকিস্তানি) মিলে তাস খেলতেন (মাঠপ্রশাসনেও তখন এটা অনেকে করতেন, তাস বা লন টেনিস খেলতেন, অনেকে পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ শিকার করতেন। স্মর্তব্য, শহীদ আখন্দের পূর্বোদ্ধত ভাষ্য)। উল্লেখ্য, ওরা ডিসেম্বর ১৯৭১-এ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে তিনি জনৈক বন্ধুর উদ্দেশে মন্তব্য করেছিলেন “On 3 December, in the afternoon, I saw a number of Pakistani fighter jets flying in a storie to the West. It was just before evening, not the usual time for exercise in the sky. I told my card partner, Abu Hena, ‘Something is going to happen. Most probably a war is going to start. My sixth sense tells me this.”৫৫
সূত্র- মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা কাবেদুল ইসলাম