You dont have javascript enabled! Please enable it! পিরোজপুরের গণহত্যা | দুইজন দুই দিক থেকে একটা লোককে পা টেনে ধরত আর একজন কুঠার বা দা  দিয়ে দুই ভাগ করে ফেলতো । - সংগ্রামের নোটবুক

“আমি নিজ চোখে দেখেছি যে দুইজন দুই দিক থেকে একটা লোককে পা টেনে ধরত আর একজন কুঠার বা দা  দিয়ে দুই ভাগ করে ফেলতো ।“

৪ঠা মে, পাক বাহিনী পিরোজপুর আসে। খান সেনারা শহরে প্রবেশ করে দালাল শ্রেণীর কতকগুলি লোককে শহর থেকে লুট করতে বলে । এই সময় তাদের নির্দেশ দেয় যে তোমরা লুট করো কিন্তু ঘর দুয়ার নষ্ট করো না । পাক বাহিনী রাস্তায় যে সব লোকদের পায় তাদেরই সবাইকে গুলি করে হত্যা করে । প্রথম অবস্থায় হিন্দু, মুসলমান কোন কিছু তারা নির্ণয় না করে একাধারে সবাইকে গুলি করে মেরেছে ।

একজন দালালের কাছে আমি এই সময় বলি যে ভাই আমার দোকানে পায় লাখ টাকার মাল আছে , তুমি এগুলো রক্ষা কর । প্রয়োজন হলে তোমার হেফাযত নিয়ে নাও । তার উত্তরে সে আমাকে জানায় যে, আপনার কোন চিন্তা নাই । আপনার কোন ক্ষতি আমরা করবো না । আমি আমার সমস্ত কিছু তার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নদীর অপর পারে চলে গেলাম ।

আমি সারাদিন নদীর অপর পারে পালিয়ে বেড়াতাম । বিকালের দিকে যখন খান সেনারা তাদের ব্যারাকে ফিরে যেত তখন আমি নদী পার হয়ে টাউনের ভিতর চলে আসতাম । এবং যতদূর সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে শহরের ভিতর ঘুরে ঘুরে অবস্থা দেখতাম ।

পাক বাহিনী আসার পর পাক বাহিনীদের সহযোগী একটা দল সৃষ্টি হয় । পরবর্তী কালে এই দলই বিভিন্ন অত্যাচারের ক্ষেত্রে পাক বাহিনীকে পরিচালনা করেছে । প্রথম দিকে পিরোজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে লুট করেছে , পরবর্তী পর্যায়ে বাড়ী ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যায় এবং জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় ।

মে মাসের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন জায়গা হতে লোক ধরে এনে পিরোজপুর জেটি ঘাঁটে এনে গুলি করে হত্যা করেছে । এমন দিন  ছিল না যে ৫০/৬০ জন লোক হত্যা না করেছে। পাক বাহিনী গড়ে প্রত্যেক দিন ১০০ করে লোককে হয়া করেছে। প্রথম দিকে যখনই লোক ধরে আনতো তখনই দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছে । ২য় পর্যায়ে পাক বাহিনী যে সব লোককে ধরে আনতো তাদেরকে সন্ধ্যার পরে গুলি করে মেরেছে ।

প্রথম দিকে যে সব লোক মারা হত তাদের বেশির ভাগ গুলি করেই হত্যা করেছে । শেষের দিকে যে সব লোককে ধরে আনতো তাদের প্রথম ভীষণভাবে মারধর করতো তারপর বেয়োনেট দিয়ে চার্জ কোড়ে হত্যা করত । অনেক সময় আমি নিজ চোখে দেখেছি যে দুইজন দুই দিক থেকে একটা লোককে পা টেনে ধরত আর একজন কুঠার বা দা  দিয়ে দুই ভাগ করে ফেলতো ।

ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার থেকে দুই চারজন ধোপা , নাপিত , কামার , কুমার শহরে আসতে শুরু করে । যারা এই সময়ে শহরে আসতো তাদের প্রত্যেককেই শান্তি কমিটির কাছ থেকে পাকিস্তানী ব্যাজ শরীরে লাগিয়ে নিতে হতো।

শহরে রাজাকার গঠিত হবার পর শহরের পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হলেও রাজাকারেরা ব্যাপকভাবে গ্রাম হতে গ্রামে অভিযান চালিয়ে বহু লোককে ধরে আনতো ।

পাকসেনা  আসার ১ মাস ১০ দিন পর্যন্ত আমি বলেশ্বর নদীর অপর পারে আমার বিরাট ফ্যামিলি নিয়ে গ্রাম হতে গ্রামে ঘুরে কাটিয়েছি । এই সময় অধিকাংশ দিন আমাকে এক বেলা কচুর শাক এবং বিভিন্ন শাকসব্জি খেয়ে কাটাতে হয়। পরে অনন্যোপায় হয়ে আমি শান্তি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করি । তারা আমাকে শহরে আসতে বলে ।

জুন মাসে ১৫ তারিখে আমি নদী পার হয়ে শহরে আসি এবং একজন লোকের সহায়তায় শান্তি কমিটির অফিসে যাই । শান্তি কমিটির সেক্রেটারী আবদুস সাত্তার মিয়া আমাকে ঘরের পিছনে দিকে এক জায়গায় বসতে দেয় । ঐ দিন শান্তি কমিটির মেম্বারদের একটা অধিবেশন ছিল । ধীরে ধীরে বহু লোক এসে কমিটির অফিসে যোগ দেয় ।

শান্তি কমিটির লোকেরা যখন সবাই বসে তখন আমি ঘরের অপর একটা রুমে বসে আছি । দালাল মোসলেম খাঁ  এই সময়ে প্রস্তাব করে যে আমরা এখন পর্যন্ত হিন্দুদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছি । তার প্রমাণস্বরুপ আমাকে সে দেখিয়ে দেয় । এই সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেব তার উত্তরে বলেন, যে আজ এ লোকের গায়ে গন্ধ, হযেছে তাই না ? কিন্তু আপনারা কে অস্বীকার করতে পারবেন ইয়ে, সে আপনাদের কাছ থেকে টাকা পাবে না ? তখন সবাই চুপ মেরে যায় ।

সাত্তার মোক্তার সাহেব আমাকে তার নিজের বাড়ীতে ঐ দিন রাত্রিতে লুকিয়ে রাখেন । পরের দি্ন ভোর হবার আগেই আমাকে নদী পার করে দেন এবং বলে দেন যে আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখলেই আপনাকে জানাবো , আপনি তখন আমার বাসায় চলে আসবেন ।

৬ দিন পর শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ডাক্তার মিয়া আমাকে আসার জন্য চিঠি দেন । তার চিঠি পেয়ে আমি শহরে চলে আসি এবং সেক্রেটারী সাহেবের তত্ত্বাবধানে থাকি । এই সময় কতোগুলি লোকের কথার উপির ভরসা করে আমি যে লোকের কাছে আমার সমস্ত কিছু গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলাম সেই লোকের কাছে আমার দুরাবস্থার কথা খুলে বলি এবং তার কাছে কিছু টাকা চাই । তার উত্তরে তিনি আমাকে ভীষণ গালাগালি করেন এবং পাক বাহিনী দিয়ে আমাকে গুলি করাবেন বলে ভয় দেখান ।

২৯ শে শ্রাবণ আমি রাত্রে ৮টার সময় শহরের ভিতর একটা হোটেল থেকে কিছু খেয়ে বাসায় ফিরতেছিলাম এমতাবস্থায় পিরোজপুর জামে মসজিদের কাছে রাজাকাররা আমাকে ধরে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় । এই সময় তারা আমার প্রতি নানা রকম গালাগালি ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে ।

ক্যাম্পে নিয়ে যাবার সময় খান সেনারা আমাকে বলে যে তুমি মুক্তিবাহিনী হ্যায় । তুমি দুশমন হ্যায় । এই বলে তারা আমার উপর অত্যাচার আরম্ভ করে । একটা মোটা বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে প্রহার করে , বুট জুতা দিয়ে লাথি মারে এইভাবে আমার সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে ।

প্রায় দুই ঘন্টা আমার উপর অকথ্য অত্যাচার চালানোর পর আমাকে তাদের হাজত অর্থ্যাৎ সেকেন্ড অফিসার সাহেবের বাসায় একটা রুমে বন্দী করে রাখে । আমাকে বন্দী করার সময় পকেট থেকে ২৪ টা  টাকা তারা নিয়ে নেয় ।

      আমাকে যে ঘরে রাখা হয় ঐ ঘরে আরও ১৮ জন বন্দী ছিল । প্রতি ২ ঘন্টা পর ডিউটিরত সিপাই চেঞ্জ হয়ে যেত । প্রতিবারই আমার উপর সিপাইরা লাথি ঘুষি মারতে থাকে আর জিজ্ঞাসা করে মুক্তিবাহিনী কোথায় ?

এনায়েত মিয়া , ডা: আব্দুল হাই , ডা ক্ষিতিশ মণ্ডলে এই সব আওয়ামী লীগের নেতারা কোথায় আছে ?

রাইফেল কোথায় আছে ?

৩ দিন পর আমার উপর এইভাবে অত্যাচার চালায় । এই সময় আর কোন নতুন আসামী তারা ঢুকায় না । তবে ঘরের বাইরে যে লোক ধরে এনে ভীষণভাবে প্রহার করে এটা আমি হাজতের ভিতর থেকে টের পাই ।

১০ দিন পর বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও ১৪ জন লোককে ধরে আনে এবং তাদের সঙ্গে আমাকে এসডিও সাহেবের বাসার ভিতর একটা পায়খানার মধ্যে বন্দী করে রাখে । এদের মধ্যে আলী আশরাফ নামে একজন ছেলে । ঢাকা থেকে আসার পথে ‘হুলার হাট’ লঞ্চ ঘাটে পাক সেনারা তাকে আটক করে । তাকে আটক করার পর ক্যাপ্টেন একটা হোটেলের চুলার ভিতরকার আধাপোড়া কাঠ এনে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চেপে ধরে । সারা শরীরের চামড়া ও মাংস পুড়ে দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে । এবং ছেলেটার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালান হয় । হাজতে আনার পর আমাদের উপর নিয়মিত অত্যাচার চালাতে থাকে ।

আমাকে হাজির করার পর ক্যাপ্টেন এজাজ আমাকে প্রশ্ন করে যে, তুমি মুক্তিবাহিনী , তুমার কাছে রাইফেল আছে , তোমাদের বাহিনী কোথায় আছে আমার কাছে বল । আমি তার উত্তরে উর্দুতে বলি যে, আমি একজন সাধারন ব্যবসায়ী মানুষ , ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি , কাজেই যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয় তবে ব্যবসা সম্পর্কে করুন । প্রায় আড়াই ঘন্টা ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয় ।

অতঃপর ক্যাপ্টেন আমাকে প্রশ্ন করে যে , তুমি এত উর্দু কথা কেমন করে শিখছো ? তখন আমি কিছুটা ভীতু হয়ে পড়ি । কেননা আমি বৃটিশ আমলে ৭ বছর আর্মিতে চাকুরী করেছি জানতে পারলে আমাকে তখনই গুলি করে হত্যা করবে । তখন আমি বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলতে লাগলাম যে হুজুর আমি ব্যবসায়ী লোক কাজেই আমি খুলনাতে পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করি , তারা আমাকে খুব পেয়ার করে এবং প্রতি ৭ দিন অন্তর আমি তাদের কাছে ১ দিন থাকি- এই সব সত্য মিথ্যা বলি । এবং সেই সঙ্গে কতকগুলি পাঞ্জাবী লোকের নামে একাধারে বলে যাই ।

আমার কথা ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করে এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে যে , তোম মেরা দোস্ত হ্যায়। আরও বলে যে তুমি মুক্ত । আজ শহরে কারফিউ কাজেই সকাল বেলা তুমি তোমার ঘরে ফিরে যেও ।
এখন আরাম কর । এই বলে আমাকে পুনরায় সেই হাজত রুমে নিয়ে আসে ।

হাজত রুমে আসার পর আরও যে ১৪ জন ছিল তারা আমার কাছে আকুতি মিনতি করে নানা কথা বলতে লাগলো যে ভাই তুমি ত সকালে বাড়ী যাবে কাজেই আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে তুমি সংবাদ দিবে তারা যেন টাকা পয়সা যা লাগে তাই আমাদের এইখান থেকে বাচিয়ে নিয়ে যায় ।

রাত্রি ১১ টার সময় একটা প্লেটে করে ৪ টা রুটি ও একটু মাংস নিয়ে আসে একটা সিপাই আমার জন্য । তখন আমি জোরে জোরে বলি যে ও রুটি আমি খাব না , তোমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাও । কেননা আজ ১১ দিন হলো শুধু পানি খেয়ে আছি আর আজ শুধু আমার জন্য ৪ টা রুটি এনেছো । কিন্তু এই হাজতের মধ্যে ত মোট আমরা ১৫ জন আছি, সবাই না খাওয়া , কাজেই আমি খাব না । সিপাইটি তখন ফিরে যায় এবং ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে ।

      রাত্রি ১২ টার সময় একটা বড় ঝুড়িতে করে রুটি ও একটা বালতিতে করে আলু ও মাংস নিয়ে আসে এবং আমাকে সবাইকে সঙ্গে করে খেতে বলে ।

রাত্রি ১২ টার সময় ক্যাপ্টেন আমাকে পুনরায় তার চেম্বারে ডেকে পাঠায় । আমার তখন ভয়  হয়ে যায় যে আমি প্রথমে রুটি খেতে চাইনি বলে হয়তো তার রাগ হয়েছে । কাজেই আমাকে মেরে ফেলবে । একজন সিপাই আমাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেবের সম্মুখে হাজির করে আমাকে দেখতে পেয়ে ক্যাপ্টেন পুনরায় জিজ্ঞাসা করে তুমি খেয়েছো । আমি বলি যে হ্যা আমি এইমাত্র রুটি মাংস খেয়েছি । ক্যাপ্টেন পুনরায় হেঁকে ওঠে যে না আবার তোমাকে আমার সম্মুখে খেতে হবে । এই বলে ডাকাডাকি আড়ম্ভ করে। এই বলে একজন সিপাই দুইটা পরাটা ও একটা আস্ত মুরগীর রোস্ট নিয়ে আসে। ক্যাপ্টেনের হুকুমে আমি তা খেয়ে ফেলি । পরে আমাকে পুনরায় আরাম করার জন্য হাজত রুমে নিয়ে আসে ।

পরের দিন সকালে আমাকে পুনরায় ক্যাপ্টেনের রুমে ডেকে নিয়ে আসে এবং আমাকে কিছু খেতে দেয় । এই সময় ক্যাপ্টেন আমাকে বলে যে এখন তুমি বাড়ি যাও এবং ঠিকঠাকমত চলাফেরা করবে । আমি বাড়ীর দিকে চলে আসি এবং বাড়িতে না গিয়ে রাত্রিতে আর সব বন্দী যে সব কথা বলে দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে আমি তা বলে আসি । এই সময় যে ছেলেটিকে হুলার হাট থেকে ক্যাপ্টেন ধরে আনে তার খালুর সঙ্গে দেখা করি এবং বলি যে বন্দী আশরাফ আমার কাছে কাকুতি মিনতি করে বলে দিয়েছে যে তাকে যদি গুলি করে হত্যা করা হয় তবে যেন তার আত্নার সৎগতি করা হয় ।

রাত্রিতে আমার ঘুম আসছিল না কাজেই বসে নানা চিন্তা করছি এমনি সময় জেটিঘাটে দশ রাউন্ড গুলির শব্দ পেলাম ।

পরের দিন সকালে উঠে খবর নিযে জানতে পারি যে যাদের বন্দী করে রেখেছিল তাদের সবাইকে রাত্রিতে গুলি করে হত্যা করেছে । তখন আমার বন্দী আশরাফের করুণ স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে এবং আমি দৌড়িয়ে জেটি ঘাটে চলে আসি । জেটি ঘাটে বেশ কয়েকটি লাশ দেখতে পাই কিন্তু আশরাফের লাশ দেখতে পাই না । একজন নৌকার মাঝির সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি নদীর ভাটিতে কিছুটা দূরে দুইটা লাশ ভেসে আসে । আমি জেটি ঘাটে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং নদীর ভিতর দিয়ে সাতার কেটে লাশের কাছে আসি এবং নিজ হাতে আলী আশরাফের লাশ তুলে নিয়ে তার বাবা-মার কাছে হাজির করি এবং তার শেষ অনুরোধের কথা জানাই । লাশ দেখে তার বাবা-মা ভয় পেয়ে যান যে মিলিটারী  জানতে পারলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলবে । আমি সারাদিন সে লাশ গোপনে লুকিয়ে রেখে রাত্রিতে কয়েকজন লোক ডেকে লাশ মাটির ব্যবস্থা করি । আমি শহরে বাস করতে থাকি এবং মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে শহরের খবরাখবর আদান প্রদান করতে থাকি ।

ক্যাপ্টেন এজাজ ছুটি নিয়ে পাকিস্তান চলে যায় বিবাহ করতে । তখন ক্যাম্পের চার্জে সুবেদার সেলিম থাকে । এই সুবেদার তখন দালাল নিয়ে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল । ব্যাপক হারে মেয়েদের ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টে ধর্ষন করতে লাগলো । হিন্দু মুসলমান বলে কোনো বিচার তখন ছিল না  – যেখানে যাকে পায় তাকেই ধরে আনতে থাকে । দেখতে দেখতে শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল ।

        আশ্বিন মাসের শেষের দিকে আমার বাসার সম্মুখে থেকে দুটি সিপাই আমাকে ডেকে নিয়ে যায় যে তোমাকে সুবেদার সাহেব বোলতা হ্যায় আমাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে গিয়ে সুবেদার বলে যে আমি তোমার জীবন নেব , তুমি আমাদের সঙ্গে বহুত দুশমনী করেছো । এঈ বলে তারা আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে । আমাকে মারতে মারতে সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে এবং এসডিও সাহেবের পায়খানার মধ্যে আটকে রাখে । ৬ দিন আমি সেখানে বন্দী থাকি । এই সময় আমি দেখতে পাই যে খান সেনারা প্রত্যেকদিন ক্যাম্পের সম্মুখে বাঙ্গালীদেরকে মিলে শূন্যে তুলে পাকা রোডের উপর আছড়িয়ে মারতো বা এইভাবে আধা মরা হয়ে গেলে বস্তাবন্দী করে তারপর বেয়োনেট চার্জ করে নদীর ভিতর ফেলে দিত । অনেককে আবার জীপ গাড়ির পিছনের দিকে বেঁধে সারা শহরের মধ্যে টানতো । এর ফলে সমস্ত মাংশ শরীর থেকে পড়ে যেত । আমি এ সব ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি । প্রত্যেক দিন আমাকে হাজত থেকে বার করে ক্যান্টনমেন্টের সম্মুখে একটা  বাদাম গাছের সঙ্গে কপি কল দিয়ে পা উল্টো দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে দিত এবং ভীষণভাবে প্রহার করতো ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি জেট ঘাটে ২,০০০ লাশ নিজের চোখে দেখেছি । প্রত্যেক দিন আমি ভোর বেলা ঘাটে গিয়ে যে সব লাশ পড়ে থাকতো তাদের উলটিয়ে পালটিয়ে দেখতাম এবং চেনা শোনা হলে তার বাড়িতে গিয়ে খবর দিতাম।

আমি নিজের চোখে মানুষকে কুপিয়ে, রাস্তায় টেনে , বস্তাবন্দী করে বেয়োনেট চার্জ করে এবং গুলি করে মারতে দেখেছি । পাক বাহিনীর চেয়ে রাজাকার, শান্তি কমিটির মেম্বার এরা অত্যাচার বেশী চালিয়েছে । পাক বাহিনী যাদেরকে ছেড়ে দিতো দালালরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতো । পিরোজপুর জেটি ঘাটে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩/৪ হাজার লোককে হত্যা করেছে । কত নারীকে যে ধর্ষণ করেছে তার কোন হিসাব নাই ।

স্বাক্ষর/-

উপেন্দ্রনাথ দত্ত
গ্রাম -রাজারহাট
ডাকঘর ও থানা- পিরোজপুর
জেলা -বরিশাল
১৮/৮/৭৩