You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.23 | সংগ্রামীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিন্তু সংগঠনের অভাব- অমিয় তরফদার | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

সংগ্রামীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিন্তু সংগঠনের অভাব
অমিয় তরফদার

আবার যে পাকিস্তান যেতে পারবাে কল্পনাতেও আনতে পারিনি। কথাটা অবশ্য ঠিক হলাে না। সত্যিই যেতে পারিনি পাকিস্তান কোনােদিনই গিয়েছিলাম বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে দেখা হয়েছে বহু পুরনাে সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বয়স্কদের সঙ্গে। অনেক খোঁজ-খবরও নিয়েছি, অনেকের সঙ্গে আবার নতুন করে পরিচয়ও হয়েছে। তবে এই পরিচয়ের দ যেমন সুখের আবার খুব দুঃখেরও, কেননা শুনলাম প্রত্যেকেই কেউ না কেউ স্বাধীন বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছে আর না হয় পাক সৈন্যরা অকথ্য অত্যাচার করেছে তাদের উপরে।
দিনাজপুরের দিকেই অবশ্য আমি বেশি ঘুরেছি। এই জেলাতেই ঘােড়াঘাট যেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল। সেটা এখন দখলে আছে মুক্তিফৌজের। এদের অফিসার সবাই ছিল ‘খান সাহেব’। তাদের এই বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালিরা খতম করে। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় যে, ঐসব বাঙালি সৈন্যরা তাদের পরবর্তী কর্মধারা সম্পর্কে জানে না। সত্যি কথা বলতে তাদের পরিচালনা করবার মতাে নেতার অভাব। সেইজন্য বহু বিদ্রোহী সৈন্য অকেজো হয়ে এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করছে। আবার সাধারণ লােক অনেকেই এই স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু কোনাে সংগঠন না থাকার জন্য সবাই দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেখলাম। হাজার হাজার যুবকের চোখে দেখেছি আগুন, কিন্তু সেই আগুন পাকহানাদারদের ওপর ছড়িয়ে দেবার কেউ নেই। দিনাজপুর শহরে দেখেছি যারা এই স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম দিকে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরাই শহর থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানাের জন্য ব্যস্ত। তাই মনে হয়েছে যে, অপরের ঘাড়ের ওপর দিয়ে যদি স্বাধীনতা পাওয়া যায় তাহলে আর কেন প্রাণ দিই— এই ভেবেই অনেক বুদ্ধিমান লােকেরা শহর ছেড়ে চলে যায়।
ওদিকে যখন সৈয়দপুরের রাস্তা দিয়ে দিনাজপুরের দিকে এগিয়ে আসছি পাক হানাদারদের আক্রমণে সমস্ত শহর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে পাক ফৌজ কতদূর এল আর মুক্তিফৌজেরই বা অবস্থা কী কেউই বলতে পারে না। নামেমাত্র কন্ট্রোল রুম। কেউ নেই। সব পালিয়ে ভারতের সীমান্তের দিকে। নেই কোনাে যােগাযােগ, না আছে বেতার, না আছে অন্য ব্যবস্থা যার জন্যে হাজার হাজার যুবক মুক্তিযােদ্ধা বুঝতে পারছে না কোন মুহূর্তে তাদের যেতে হবে রণাঙ্গনে। দেখেছি রসদ গেছে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রাকে করে, ফিরে এসেছে ঠিক সেই অবস্থায়, কেননা সেই মুহূর্তে মুক্তিফৌজ আগের পজিশন ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বা যুদ্ধের সুবিধার জন্য অন্য জায়গায় সরে গেছে। আর যােগাযােগ না থাকায় সমস্তটাই যেন এলােমেলাে। শক্তি প্রচুর, কিন্তু পরিচালনার অভাবে সবটাই প্রায় নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন লক্ষ লক্ষ মুজিব কিন্তু ডাক দেবার কেউই নেই- এগিয়ে যাবার রাস্তা কেউ দেখিয়ে দেবার নেই।
মানবিকতার দিক দিয়ে দেখেছি মুক্তিযােদ্ধারা অবাঙালি ছেলেমেয়েদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের উপর কোনাে রকম অত্যাচার যেন না হয় একজন মুক্তিযােদ্ধা আর কয়জন যােদ্ধাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। আর সবচেয়ে বিস্মিত হলাম যখন জানলাম ঐ মুক্তিযােদ্ধার ছােট ছােট দুই ভাই-বোেনকে কুয়াের মধ্যে ফেলে দিয়ে মেরেছে পাক হানাদাররা। বাঙালি জাতির সংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সেজন্য কংসের মতাে তাদের বিনাশ করতে চায় ইয়াহিয়ার সৈনরা।

সূত্র: দর্পণ
২৩.০৪.১৯৭১