You dont have javascript enabled! Please enable it! হাসিময় হাজরা - সংগ্রামের নোটবুক
হাসিময় হাজরা
হাসিময় হাজরার জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ জানুয়ারি। তার বাবার নাম অনন্ত হাজরা। অনন্ত হাজরা ছিলেন তখনকার বিখ্যাত ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিসে’র ডাক্তার। ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাদের পরিবার যুক্ত ছিল। হাসিময় হাজরার পূর্বসূরি অমৃতলাল হাজরার নামে কলকাতায় একটা রাস্তা আছে। ১৯৬২ সালে ঢাকেশ্বরী কটন মিলস হাই স্কুল থেকে হাসিময় হাজরা ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ তােলারাম কলেজ থেকে আই. এসসি, পাস করে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে হাসিময় এম, বি. বি. এস. পাস করেন। ১৯৭০ সালেই তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ কোর্সে যােগ দেন। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হাসিময়ের মা তার ছােট ছােট চার। সন্তানকে নিয়ে প্রাণভয়ে রাস্তার ভূগর্ভস্থ ম্যানহােলে আশ্রয় নেন এবং প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সেখানে অবরুদ্ধ ছিলেন। দাঙ্গা থামার পর হাসিময়ের গােটা পরিবার এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু হাসিময়কে কোনােক্রমেই তারা দেশ ছেড়ে যেতে রাজি করাতে পারেনি। তিনি আর তার বাবা এ দেশের মাটি আঁকড়ে থেকে যান।
নামের সাথে মানানসই একটা হাসি সবসময় লেগে থাকত তার মুখে। মেডিকেলের ওয়ার্ড কিংবা হলের মাঠ সবখানেই ছিল তার প্রাণােচ্ছল উপস্থিতি। মানুষের প্রয়ােজনে নিজেকে উজাড় করে দিতে কখনও দ্বিধা করেননি তিনি। ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে হাসিময় হাজরাকে পাওয়া যেত মিছিলের সামনের সারিতে। ঊনসত্তরের গণভ্যুত্থানের সময় একদিন খবর আসে, নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলে শ্রমিকদের উপর গুলি চালানাে হয়েছে। এর পরপরই সেখানে কারফিউ জারি করা
হয়েছে। খবর শােনামাত্র কারফিউয়ের ভয়কে উপেক্ষা করে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বেরিয়ে যান হাসিময়। তিন-চার দিন সেখানে থেকে আহতদের চিকিৎসা করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে ডেমরায় ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকায়ও তিনি কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি একটি দলের সদস্য হিসাবে সেখানে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে উদ্ধার কাজ চালান ও আহতদের চিকিৎসা সেবা দেন।
১৯৭১ সালের মার্চের অসহযােগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন হাসিময়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই তাকে অনুরােধ করেছেন দেশের বাইরে। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে। কিন্তু শত অনুরােধ সত্ত্বেও তিনি ভারতে যাননি। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল, তিনি দেশের ভেতরে থেকেই কাজ করবেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হাসিময়। দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে মায়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে সে কথা দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন হাসিময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হােস্টেলে অবস্থানকারী তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মাঝেমধ্যে সেখানে যেতেন হাসিময়। ১৯৭১ সালের ২ মে বেলা ২টায় হাসিময় গােপীবাগের বাসা থেকে একটি ভেসপায় চড়ে ইন্টারন্যাশনাল হােস্টেলের উদ্দেশ্যে যান। ওইদিন সন্ধ্যায় শহরে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু হাসিময় তখনও গােপীবাগের বাসায় ফিরে আসেননি। পরদিনও তার কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় যে ইন্টারন্যাশনাল হােস্টেলের জর্ডানের দুজন ছাত্র তাকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। তৎকালীন পি. জি. হাসপাতালের সামনে থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ঘাতকের দল ওই দিনই তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে তার আর কোনাে খোঁজ মেলেনি। এমনকি তার মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদ হাসিময় হাজরা অবিবাহিত ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ ১৯৯৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে হাসিময় হাজরার নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা