You dont have javascript enabled! Please enable it!
হরিনাথ দে
১৯১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর হরিনাথ দে’র জন্ম। তার বাবার নাম। যদুনাথ দে। পুরান ঢাকার মালাকারটোলা লেনেই তাঁদের পরিবারের আদি নিবাস। যদিও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ভারতে চলে যায়। হরিনাথ ১৯৩১ সালে ঢাকার পােগােজ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৩৩ সালে তখনকার জগন্নাথ কলেজ থেকে  আই. এসসি. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৬ সালে রসায়নশাস্ত্রে বি, এসসি, অনার্স ও ১৯৩৭ সালে এম, এসসি পাস করেন হরিনাথ। সব পরীক্ষাতেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। হরিনাথ দে ১৯৪২ সালে পুষ্টি রসায়নে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। হরিনাথ দে ১৯৩৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তিনি সহযােগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এরপর তিনি ভারতে যান এবং ১৯৫০ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ইন্দোরে অবস্থিত ‘মহাত্মা গান্ধী মেমােরিয়াল ইনস্টিটিউটে পুষ্টি কর্মকর্তা হিসাবে চাকরি করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে যােগ দেন। শহীদ হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন। হরিনাথ দে এককভাবে এবং তার সহকর্মী ড. কুদরাত-ই-খুদার সাথে যৌথভাবে কাজ করে প্রাণরসায়ন ও পুষ্টি সম্পর্কে বেশ কিছু মৌলিক উদ্ভাবন করেছেন।  হরিনাথ দে ছিলেন শান্ত ও আত্মনিমগ্ন মানুষ। সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল বিশেষ অনুরাগ। চাকরিজীবনের শেষ দিকে তিনি পারিবারিক ব্যবসার প্রতি মনােযােগী হয়েছিলেন। হােমিওপ্যাথি চিকিৎসাতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। হরিনাথ দে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে কিছু তথ্যগত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তিনি ‘ঈক্ষণ’ নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করতেন। নাট্যদল প্রতিষ্ঠা ও অভিনয়ের সাথেও হরিনাথ যুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকার সূত্রাপুরের লােহারপুলসংলগ্ন ৪৩, মালাকারটোলা লেনের বাড়ি থেকে বিজ্ঞানসাধক ড. হরিনাথকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর লােহারপুলের পাশে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করে। সেনারা ওই এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিচিছল। ভয়ে এলাকার নারী-পুরুষ সবাই পালিয়ে যায়। হরিনাথ দে-সহ অন্যদের মরদেহ সেখানেই পড়ে থাকে। এক দিন পর তার মরদেহ সকার করা হয়। এ সম্পর্কে হরিনাথ দের ছেলে সঙ্কৰ্ষণ দে লিখেছেন : ৪৩ মালাকারটোলা লেন থেকে লােহারপুলের ঢাল, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দূরত্ব। অথচ কী আশ্চর্য, আমি ১৬ বছরের তরুণ অতিক্রম করতে পারলাম না মাত্র ওইটুকু পথ। সেখানে পরম নির্ভাবনায় শুয়ে আছেন আমার প্রাণপ্রিয় পিতা হরিনাথ দে। শুয়ে আছেন আমারই আশৈশব দেখা আরও নয়টি মুখ। কিন্তু আমি । যেতে পারলাম না। কথাটা মনে হলে এখনাে আমার বুকের ভেতরে কালবৈশাখীর তাণ্ডবের ভয়ংকর ধ্বনি শুনি। সে সময় আমাদের এলাকায় বশির ও অতুল। নামে দুটো পাগল ছিল। বশির ও অতুল বাবা ও মাকে বাবা-মা বলে ডাকত। এই পাগল দুজন বাবার চিকিৎসা ও স্নেহ ও ভালােবাসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। বাবার মৃত্যুর পর আমরা যখন পালিয়ে নদীর ওপারে, তখন মা বশিরকে বললেন, তাের বাবাকে লােহারপুলে ফেলে এলাম, ওনার কোনাে সত্ত্বার হলাে না, তুই তাের বাবার মুখাগ্নি করে আয়। সেই বশিরই বাবার মুখে দিয়াশলাইয়ের আগুন দিয়ে মুখাগ্নি করে। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড)

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!