হবিবুর রহমান
হবিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১ জানুয়ারি নােয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার বালিয়াধার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কলিম উদ্দিন ভূইয়া, মায়ের নাম সিদ্দীকা খাতুন। কলিম উদ্দিন ছিলেন মূলত কৃষক। ছয় ভাইবােনের মধ্যে হবিবুর ছিলেন তৃতীয়। হবিবুর রহমানের তিন-চার বছর বয়সে মা সিদ্দীকা। খাতুন মারা যান। কলিম উদ্দিন ভূইয়া পুনরায় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী আছিয়া খাতুনের নিজের কোনাে সন্তান ছিল না। পরিবারের ছয় সন্তানকে তিনি নিজের ছেলেমেয়ের মতােই আদর-ভালােবাসায় বড় করেন। ছেলেমেয়েরাও মা বলতে আছিয়া খাতুনকেই জানত। হবিবুর রহমানের বড় ভাই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। পরিবারের জমিজমা সংক্রান্ত বিরােধে গ্রামের প্রভাবশালীদের হাতে তিনি খুন হন, যার কোনাে বিচার হয়নি। এ ঘটনা হবিবুরের মনে গভীর দাগ কাটে। ১৯৫৬ সালে বাবা কলিম উদ্দিন মারা যান। বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে বটগ্রামের কাছে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ভর্তি হন হবিবুর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই তার অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সে সময় পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। স্কুল জীবনের বৃত্তির টাকা এবং ছাত্র পড়িয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন তিনি। তাঁর অন্য ভাইবােনেরা বেশিদূর পড়াশােনা করেননি। নিজের অদম্য আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের জোরে হবিবুর রহমান অজপাড়াগাঁ থেকে উচ্চশিক্ষার শিখরে উঠতে পেরেছিলেন।
হবিবুর ১৯৩৮ সালে নােয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার দত্তপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। সেই সময়ে পাঁচ বিষয়ে লেটার পাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। এরপর হবিবুর ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে আই. এসসি. পাস করেন এবং একই বছর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে বি, এসসি, অনার্স শ্রেণিতে। তিনি ১৯৪৩ সালে অনার্স ডিগ্রি পান। এরপর তিনি এম. এসসি. শ্রেণিতে ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি রেকর্ড নম্বরসহ গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম, এসসি, ডিগ্রি পান। হবিবুর রহমানের এই অসাধারণ ফলাফলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তল্কালীন উপাচার্য ও প্রখ্যাত গণিতবিশারদ স্যার জিয়াউদ্দীন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের কাছে হবিবুর রহমানকে স্টেট স্কলারশিপ ও চাকরি দেওয়ার জন্য বিশেষ সুপারিশ করে চিঠি দেন। ১৯৪৬ সালের হবিবুর প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি বদলি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এরপর তিনি বদলি হন ঢাকা কলেজে এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সেখানেই শিক্ষকতা করেন।
১৯৫৪ সালের নভেম্বরে হবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক পদে যােগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে ট্রাইপস ডিগ্রি পান। এরপর ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার (সহযােগী অধ্যাপক) পদে উন্নীত হন। ১৯৬২ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ফলিত গণিতের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ফিরে এসে ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়ােগ পান এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। পরের বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পুনরায় গণিত বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদেই নিয়ােজিত ছিলেন।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন হবিবুর রহমান বিয়ে করেন। ওয়াহিদা রহমানকে। কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির হবিবুর রহমান পারিবারিক জীবনে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্যরকম একজন মানুষ। গল্পগুজবে মাতিয়ে রাখতেন।
ছেলেমেয়েদের, কবিতা শেখাতে গিয়ে নিজেই কবিতা আবৃত্তি করে শােনাতেন, খেলার ছলে অঙ্ক শেখাতেন। সন্তানদের তিনি বলতেন, “জ্ঞান একটি প্রজ্বলিত শক্তি, যা আলােকিত করে নিজেকে এবং সমাজকে।” নিজের ছয় সন্তানের সঙ্গে ভাইদের দুই সন্তানকেও নিজের বাসায় রেখে লেখাপড়া করিয়েছেন হবিবুর রহমান। সততা, আদর্শ, মূল্যবােধ ও নিয়মনিষ্ঠার সমন্বয়ে একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন হবিবুর রহমান। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবােধে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় স্থানীয় হিন্দুদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় হিন্দু-বিরােধী দাঙ্গার সময়ও হবিবুর রহমান বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত হিন্দু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করেছেন। চরম বিপদের মধ্যেও ধীরস্থিরভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এর প্রতিবাদে পরিচালিত বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হবিবুর রহমান। তাঁর সুপরিকল্পিত নির্দেশনাতেই ড. জোহার মৃত্যুর পর পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় আহত-নিহতদের খোঁজখবর নেওয়ার কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছিল।
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতা করার সময় হবিবুর রহমান বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদের উদ্গাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চিন্তাধারায় পরিচালিত ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তিনি অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. মােহাম্মদ তাজুল হােসেন, ড. আলী মােহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর সাথে গঠন করেছিলেন ‘ঢাকা ন্যাশনালিস্ট ক্লাব’। এ সংস্থার পক্ষ থেকে সে সময়ে প্রকাশিত ‘মুক্তি’ নামের মাসিক পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন হবিবুর রহমান, সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি মূল দায়িত্ব পালন করতেন। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাসহ আরও অনেকের সাথেই ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব।
সহকর্মী ও সাধারণের সঙ্গে হবিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল। তিনি ছিলেন সদালাপী এবং মিশুক। সহকর্মী ও পরিচিতজনদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় হাবিব ভাই’। কিন্তু একই সাথে তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ও
স্পষ্টভাষী- কারও কাজ পছন্দ না হলে তার সামনেই স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতেন নিজের অসন্তুষ্টির কথা। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন অত্যন্ত যত্নসহকারে, আবার শ্রেণিকক্ষের বাইরেও ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সচেতন। সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ থাকাকালে গভীর রাতে তিনি হলের বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে ছাত্রদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। কোনাে অসুস্থ ছাত্রকে সুস্থ না দেখা পর্যন্ত তিনি শান্তি পেতেন না। পরিবারের সদস্যদের তিনি বলতেন, “বাবা-মা, ভাই-বােন, আপনজন ছেড়ে ওরা (ছাত্ররা) আসে এখানে পড়াশােনা করবার জন্য; আমরা যদি ওদের না দেখি, ওদের না বুঝি, তবে ওরা যাবে কোথায়?”
গণিত বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন হবিবুর রহমান। গবেষণার প্রতি তার ছিল বিশেষ আগ্রহ। গণিতের ৫০০ বছরের একটি অমীমাংসিত সূত্রের উপর গবেষণা করে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে তিনি সুনাম অর্জন করেন। জাতীয় উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় গণিত এবং বিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয়গুলাের চর্চার প্রয়ােজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন এবং মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে উৎসাহিত করতেন। বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বইগুলাে হলাে : স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য যােগাশ্রয়ী বীজগণিত’, স্নাতক শ্রেণির জন্য কলেজ বীজগণিত, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন বীজগণিত এবং ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ‘পাটীগণিত’। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য রচিত বই দুটি সে সময় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ও নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে : On Pell’s Equation’, ‘On Fermat’s Last Theorem’, ‘On Crisis of Civilization’ (১৯৫০), On Fundamental Human Rights’ (১৯৬৯), নতুন শিক্ষানীতি’ (১৯৬৯) এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক (১৯৭০)। শিক্ষা সংস্কারেও তিনি অত্যন্ত সাহসী ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিলেন।
হবিবুর নিজে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা করতেন এবং ছাত্রছাত্রীদেরও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। নিজের বিষয়ের বাইরে সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতের প্রতিও হবিবুর রহমানের অনুরাগ ছিল। খেলার মাঠে, বক্তৃতা মঞ্চে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও ক্লাবে তার ছিল সরব উপস্থিতি। নিজে টেনিস খেলতেন এবং সন্তানদেরকেও পড়াশােনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সঙ্গীতের প্রতি উৎসাহিত করতেন। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তিনি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহযােগ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার খবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছাতেই শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে চলে যেতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ে। তার সহকর্মী, বন্ধু এবং পরিচিত অনেকে তাকে সে সময় অনুরােধ করেন ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে। কিন্তু সবার অনুরােধ উপেক্ষা করে হবিবুর রহমান ক্যাম্পাসেই থেকে যান। | ২৬ মার্চ ভাের রাতের দিকে পাকসেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। হবিবুর রহমানের ‘প-১৯/বি নম্বর বাসাটিতে তখনও উড়ছিল কালাে পতাকা। এ নিয়ে পাকসেনাদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে সেনারা নিজেরাই জোর করে পতাকা নামায়। পাকসেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খালি। বাসাগুলােতে লুটতরাজ শুরু করে। হবিবুর রহমান তখন তাদের লুটে বাধা দেন এবং এ নিয়েও সেনাদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক-বিতণ্ডা হয়। পাকসেনারা তখন চলে যেতে বাধ্য হয়। ১২ এপ্রিল আরও কয়েকজন শিক্ষকের একটি দল ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার সময় তাকেও সঙ্গে যেতে অনুরােধ করলে হবিবুর রহমানের জবাব ছিল : *Like the captain of a ship I shall be the last to leave.”
২৫ মার্চের পরে ই. পি. আর. বাহিনীর একটা অংশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিল প্রতিরােধ গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে। তাদের জন্য খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসগুলাে সরবরাহ করা হতাে হবিবুর রহমানের বাড়ি থেকেই। ওয়াহিদা রহমান নিজের হাতে শত শত রুটি বানাতেন তাঁদের জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গেও হবিবুর রহমান নিয়মিত যােগাযােগ করতেন এবং তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। | ২৬ মার্চের পরে ই, পি. আর, সদস্যদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিবেশী দুই জন অবাঙালি অধ্যাপক সপরিবারে আশ্রয় চান হবিবুর রহমানের বাসায়। নিজের স্বভাবজাত সরল বিশ্বাসেই সেদিন সহকর্মীদের নিজ বাসায় আশ্রয় দেন হবিবুর। ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বিতীয়বারের মতাে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢােকে। এর পরপরই হবিবুর রহমানের বাসায় আশ্রয় নেওয়া দুই অবাঙালি অধ্যাপক সপরিবারে বের হয়ে চলে যায় এবং পাকবাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডে সাহায্য করে।
১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল বিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে হবিবুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট এবং গলায় চাদর ছিল। অস্থায়ী সামরিক হেড কোয়ার্টার ‘বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি ভবনের ছাদের উপরে সামরিক অফিসারদের সামনে হাজির করা হয় হবিবুর রহমানকে। ঘর থেকে ওয়াহিদা রহমান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, ওরা অনেকক্ষণ ধরে হবিবুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পরে তার দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দেয়। পাকসেনাদের হীন কর্মকাণ্ডকে ভালাে হিসাবে তুলে ধরে একটি চিঠি লিখে দিতে বলা হয়েছিল অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে। কিন্তু তিনি এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে রাজি হননি। এর খানিকক্ষণ পরেই হবিবুর রহমান পাকসেনাদের সাথে নিচে নেমে আসেন। তিনি অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর পাকসেনারা তাকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁর আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেদিনই অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। শহীদ হবিবুর রহমানের স্ত্রীর নাম ওয়াহিদা রহমান। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও চার মেয়ে ছিল। তাঁরা হলেন : মাে. খায়রুল এনাম, আনিসুর রহমান, রােকসানা রাজ্জাক, শারমীন রহমান চৌধুরী, নাসরিন রহমান মােল্লা ও মােনালিসা হাসান। হবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ওয়াহিদা রহমান প্রচণ্ড পরিশ্রম করে ছয় সন্তানকে মানুষ করেছেন। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সামান্য কিছু আর্থিক সহযােগিতা করেছে। ওয়াহিদা রহমান ২০০২ সালে মারা যান। শহীদ হবিবুর রহমানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘শহীদ হবিবুর রহমান হল’। বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণােত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা