You dont have javascript enabled! Please enable it!
সুখরঞ্জন সমাদ্দার
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি, বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামে। তার বাবার নাম কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার, মায়ের নাম প্রফুল্লবালা সমাদ্দার। দুই ভাই ও তিন বােনের মধ্যে সুখরঞ্জন ছিলেন সবার বড়। কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ও খ্যাতিমান অধ্যাপক।  ছােটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের খ্যাতি ছিল। স্থানীয় বাইশারী স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি বরিশাল ব্রজমােহন কলেজ (বি. এম. কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আই. এ. পাস করেন। বাবা কার্তিকচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পড়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনার্স কোর্স ছিল দুই বছরের। ১৯৫৮ সালে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ডিগ্রি পান। কিন্তু ততদিনে ভারতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নানা বিধি-নিষেধ আরােপ করা হয়। ফলে সুখরঞ্জন সমাদ্দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিষয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে এম. এ. পূর্বভাগ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণি পান এবং ১৯৬১ সালে এম. এ. চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পান।
অনার্স পাসের পর সুখরঞ্জন প্রথমে কিছুদিন গােপালগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৫৯ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ হিসাবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি সঙ্গীতচর্চা করতেন। একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে বিশ্ববিদ্যালয়। আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাড়ার ৭১/বি নম্বর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের জুবেরী ভবন তখন মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে প্রথমে জুবেরী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেনারা তাকে হত্যা করে বিনােদপুরের এক দিঘির পাড়ে ফেলে রাখে। অসহায় চম্পা সমাদ্দার ছুটে গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তকালীন উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হােসেনের কাছে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে। ড. সাজ্জাদ। হােসেন তার অপারগতার কথা জানিয়ে দেন। নানা জায়গায় ছুটাছুটি করে চম্পা সমাদ্দার স্বামীর প্রকৃত অবস্থান জানার চেষ্টা করেন, কিন্তু খবর মেলেনি। তবুও তিনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন। জুলাইয়ের গােড়ার দিকে চম্পা সমাদ্দারের সমস্ত আশাভরসার করুণ পরিণতি ঘটে। একজন প্রতিবেশী সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্যান্ডেল, ভাঙা চশমা চম্পা সমাদ্দারের হাতে স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে পৌছে দেন। চম্পা সমাদ্দার নিশ্চিত হন, তাঁর স্বামী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তার স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন । ১৩ এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত একজন বাঙালি ই, পি, আর, সেনা (মুক্তিযােদ্ধা) অন্ধকারে চুপি চুপি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার পেছনে এসে পানি চাচ্ছিল। আমার স্বামী তাকে নিজ হাতে পানি খাওয়ান। ওই ই. পি. আর. সেনাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে জেনেও তাকে আশ্রয় দেন। তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার স্বামী নিজ হাতে সে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে সারা রাত তার সেবা করেন। রাত ৪টার পর ওই যােদ্ধা চলে যান। পরদিন ১৪ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে হানাদার সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনােবিজ্ঞান বিভাগের তঙ্কালীন অবাঙালি চেয়ারম্যান সৈয়দ মতিউর রহমানের ইঙ্গিতেই আমার স্বামী গ্রেফতার হন। হানাদার বাহিনীর ঘাতকেরা তাঁকে সেদিনই নির্মমভাবে হত্যা করে বিনােদপুরে ফেলে রেখে যায়। এটা তখন আমি জানতাম না। পরে জেনেছি। আমাদের বাসায় প্রতিদিন দুধ দিতেন এক ঘােষ। তিনি বিনােদপুরে এক দিঘির পাড়ে আমার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি আমার স্বামীর মৃতদেহ তাঁর কাজলার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠোনে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। তিনি সেদিনই পরিবারসহ ভারতে চলে যান। ফলে আমাকে খবর দিতে পারেননি। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে তিনি ঘটনাটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান। তখন কর্তৃপক্ষ তার দেহাবশেষ সেখান থেকে তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। পুনঃসমাহিত করে।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের চাকরির মেয়াদ ১০ বছর পূর্ণ না হওয়ায় চম্পা তাঁর স্বামীর পেনশন বা এককালীন কোনাে ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। এমনকি সরকারি কোনাে অনুদানও তিনি পাননি। চম্পা তখন ম্যাট্রিক পাস ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বালীন উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ চম্পাকে পড়াশােনা করতে অনুপ্রেরণা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ৯০০ টাকা করে ভাতা বরাদ্দ করে। এভাবেই চম্পা সমাদ্দার এম, এ. পর্যন্ত পড়াশােনা করেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রােকেয়া হলে সহকারী হাউস টিউটর হিসাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চাকরি করে অবসর নেন। সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও চম্পা সমাদ্দারের বিয়ে হয় ১৯৬৩ সালে (২৭ ফান্ধুন)। তাদের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়। ছেলে সলিলরঞ্জন সমাদ্দার চিকিৎসক, মেয়ে মল্লিকা সমাদ্দার ও সুস্মিতা সমাদ্দার দুজনই শিক্ষকতা করেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!