সিরাজুদ্দীন হােসেন
প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হােসেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে মাগুরা জেলা শালিখা থানার শরুশুনা গ্রামে জন্ম নেন। তার বাবার নাম মৌলভী মােজাহারুল হক, মায়ের নাম আশরাফুন্নেছা। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে সিরাজুদ্দীনের বাবা মারা
যান। এরপর থেকে অভাব মােকাবেলা করেই তাকে বড় হতে হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর তার চাচা মৌলভী মােহাম্মদ ইসহাক ভাইয়ের সন্তানদের দায়িত্ব নেন। চাচার কাছে থাকাকালে সিরাজুদ্দীন হােসেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর স্কুল ও যশাের জেলা স্কুলে পড়াশােনা করেছেন। কিন্তু পারিবারিক ভুল বােঝাবুঝির কারণে তিনি এক সময় চাচার কাছ থেকে সরে আসেন। এরপর তিনি যশােরের ঝিকরগাছার কাছে মিছরিদিয়াড়া গ্রামের এক বৃদ্ধ বিধবার বাড়িতে জায়গির থেকে ঝিকরগাছা স্কুলে পড়াশুনা করতে থাকেন। বিধবা নারী তাকে নিজের ছেলের মতাে স্নেহ করতেন। পড়াশােনার ফাকে ফাকে তিনি বৃদ্ধার ছেলেদের চাষাবাদের কাজেও সাহায্য করতেন। তাদের জন্য মাঠে ভাত নিয়ে যেতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় দেখা গেল, তিনি পরীক্ষার ফির পুরাে টাকা জোগাড় করতে পারছেন না। এটা জানতে পেরে সেই উদারপ্রাণ বৃদ্ধা তার বাড়ির একটি মােরগ বিক্রি করে পরীক্ষার ফির বাকি টাকার সংস্থান করে দেন। জায়গির থাকা অবস্থায় তিনি ঝিকরগাছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।
এরপর সিরাজুদ্দীন ভর্তি হন যশাের মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে। ওই কলেজ থেকে আই. এ. পাস করে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি. এ. পড়তে যান। এ কলেজে পড়ার সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুদ্দীন মােল্লা, আসফউদ্দৌলা রেজা, খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। কলেজ জীবনে বই কেনার মতাে আর্থিক সচ্ছলতা তার ছিল না। অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নােট তৈরি করেই তিনি পড়াশােনা করতেন। বেঁচে থাকার তাড়নায় তিনি এ সময় সংবাদপত্রে কাজ নিতে বাধ্য হন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি ‘আজাদ’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হন। ওই সময়ে এত অল্প বয়সে। বার্তা সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারও হয়নি।
দেশবিভাগের পর ‘আজাদ পত্রিকা ঢাকায় চলে আসে। আজাদ পত্রিকার মালিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের সময় আকরম খাঁ হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট-বিরােধী একটি সংবাদ ছাপার পরিকল্পনা করেন। এমন একটি সংবাদ তৈরি করা হয় যা পড়লে মনে হবে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সিরাজুদ্দীন হােসেন তখন পত্রিকার যুগ্ম বার্তা সম্পাদক এবং নাইট শিফটের দায়িত্বে। তিনি ওই সংবাদটি না ছেপে যুক্তফ্রন্টের পক্ষের একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। এ কারণে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর কিছুদিন তিনি ঢাকার ইউ, এস, আই. এস. অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসাবে কাজ করেন। এক বছর পর তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন।
এ অঞ্চলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জনক বলা হয় সিরাজুদ্দীন হােসেনকে। পুলিশের অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি সে সময় এক অসাধারণ কাজ করেছিলেন। তখন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে আশঙ্কাজনকভাবে শিশু অপহরণ হচ্ছিল। ইত্তেফাক পত্রিকায় এ সম্পর্কিত খবর ছাপা হয়েছে, পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্কবাণী ছাপা হয়েছে। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারী দলের কারসাজির ফলেই যে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ ছিল। কিন্তু পুলিশের তল্কালীন আই, জি, এক সংবাদ সম্মেলন করে মন্তব্য করলেন, শিশু অপহরণের এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এর পিছনে কোনাে সংঘবদ্ধ সংগঠিত দল নেই। এ সংবাদ সম্মেলনের কথাও ছাপা হলাে ‘ইত্তেফাকে’।
সিরাজুদ্দীন হােসেন পুলিশের এই মন্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ নিলেন। অনুসন্ধানে নামলেন তিনি। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও, ত্রিশাল ও ভালুকা- এই তিন থানার বিরাট সীমান্ত অঞ্চল ছিল সে সময় গােচারণ ভূমি। লম্বা লম্বা ঘাস মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যেত। ফলে বাইরে থেকে বােঝা যেত না, সেখানে কারা আছে। গােচারণ ভূমির মাঝে মাঝে ছিল চালাঘর। সংঘবদ্ধ শিশু অপহরণকারীরা ছােট ছােট ছেলেদের চুরি করে এই গােচারণভূমিতে নিয়ে আসত। সেখানে শিশুদের দেওয়া হতাে অসামাজিক কাজের প্রশিক্ষণ। কোনাে কোনাে শিশুর হাত-পা কেটে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষার কাজে লাগানাে হতাে। বহু দিন ধরে এই অপকর্ম চলছিল। সিরাজুদ্দীনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ফলে শিশু অপহরণের এক । বিরাট চক্র উদ্ঘাটিত হয়। সত্তরেরও বেশি শিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় । ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের ক্রোড়পত্রে সিরাজুদ্দীন হােসেন ও উদ্ধারকৃত শিশুদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য তিনি ‘ম্যাগসেসে’ মনােনয়ন পেয়েছিলেন। | সিরাজুদ্দীন হােসেন ছিলেন বিনয়ী, সদালাপী, পরােপকারী এবং সজ্জন ব্যক্তিত্ব। তিনি কাজের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছে সবকিছুর উপরে ছিল মানবিকতা। একবার বার্তা বিভাগের এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আরেক সহকর্মী আসাফউদ্দৌলাকে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শেষে নিজেই বিচলিত হয়ে পড়লেন। আসাফউদ্দৌলাকে ডেকে বললেন, “ওর চাকরি গেলে বউ ছেলেপেলে নিয়ে দাঁড়াবে কোথায়?” অন্যায়কারীকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত এবং কারও কাছ থেকে পাওয়া আঘাত মন থেকে মুছে না ফেলা পর্যন্ত তিনি শান্তি পেতেন না।
ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে সিরাজুদ্দীনের সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্ত। এই পুরাে সময়ে এ দেশের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর ছিল সরাসরি যােগাযােগ। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাট দশকের সব আন্দোলন, জিন্নাহর নির্বাচন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালিদের অব্যক্ত কথা ইত্তেফাকের। পাতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন তিনি এমনই মমতা আর দক্ষতার সাথে, যা এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
| পাকিস্তান আমলে যে কজন সাংবাদিক নেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সিরাজুদ্দীন হােসেন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর আইয়ুবের শাসনামলে তিনি কিছুদিন ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। এছাড়া তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনের প্রধান সম্পাদক হিসাবেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্মলগ্নে তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি। পরবর্তীকালে দুইবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটি রেডিওতে সম্প্রচারের পেছনে তার ছিল অসাধারণ ভূমিকা। ২ মার্চ রাতে সিরাজুদ্দীন হােসেন সহকর্মী সাংবাদিক আমির হােসেনকে দায়িত্ব দেন রেডিওতে শেখ মুজিবের বক্তব্য সম্প্রচারের দাবিতে কোনাে একজন আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্য জোগাড় করার জন্য। কিন্তু ওই গভীর রাতে আমির হােসেন কাউকেই টেলিফোনে পাননি। তখন সিরাজুদ্দীন হােসেন নিজের উদ্যোগে যুবনেতা তােফায়েল আহমদের নামে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি সংবলিত একটি বিবৃতি ছাপিয়ে দেন, যা পরদিন ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে তাজউদ্দীনসহ আরও অনেক নেতার বিবৃতি পত্রিকায় আসতে থাকে। এভাবে ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি ক্রমশ এমনই জোরালাে হয়ে ওঠে যে। কর্তৃপক্ষ এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। যদিও সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর শেষ মুহূর্তে সরকারি উচ্চ মহলের নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে পারেন, এই আশঙ্কা করে বেতারে তার ভাষণ সরাসরি প্রচারের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। পরদিন ৮ মার্চ সকালে ওই ভাষণ রেডিওতে প্রচার করা হয় যা সারা দেশের মানুষ শুনতে পায়। সেই রাতে সিরাজুদ্দীন হােসেন সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে ‘ইত্তেফাকে তােফায়েল আহমদের নামে বিবৃতিটি প্রকাশের ব্যবস্থা না করলে ৭ মার্চের ভাষণটি আদৌ রেডিওতে প্রচারিত হতাে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে।
২৫ মার্চের কালরাতেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ইত্তেফাক অফিস। পরে তা আবার চালু হয়। বড় পরিবার নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার কথা ভাবতে পারলেন না সিরাজুদ্দীন হােসেন। এখানে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় ইত্তেফাকে’র সাংবাদিক শফিকুল কবির যখন সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, তখন সিরাজুদ্দীন হােসেন কোনাে আপত্তি জানাননি। তবে বললেন, এখানে থেকেও কিছু কাজ করার আছে। তিনি বােঝালেন, “আজ হােক, কাল হােক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসবেই। আর এ স্বাধীনতার ইতিহাস রচিত হবে দুই ধারায়। যারা ভারতে চলে যাচ্ছে, তারা দেখবে একটি দিক, আর এখানে যারা শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে, পাকবাহিনীর প্রতিটি দুষ্কর্ম লক্ষ করে তারা বিচার করবে অন্যদিক।” কোনাে জরুরি তথ্য ওপারে পাঠাতে হলে শফিকুল কবিরকেই খবর দিতেন সিরাজুদ্দীন হােসেন। আগরতলার কংগ্রেস ভবন পর্যন্ত তা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল। তাঁর। সিরাজুদ্দীন প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গােপন একটি রিপাের্ট পাঠিয়েছিলেন যাতে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের বর্বরতার প্রমাণ ছিল। এই রিপাের্টটি পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার প্রচারিত হয় এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা করলেও এসব কাজের গােপনীয়তার ব্যাপারে তিনি ছিলেন।
সতর্ক কয়েকজন সাংবাদিক মুজিবনগর যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে সাংবাদিক শফিকুল কবিরের মাধ্যমে তাঁর কাছে আসেন। তখন তিনি শফিকুলকে বলেছিলেন : “না, এক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকেই সহজ দৃষ্টিতে বিশ্বাস করা যাবে না। ভাই হয়ে ভাইকে ধরিয়ে দিচ্ছে, খুন করছে এমন ঘটনা এ পরিস্থিতিতে বিরল নয়।” শফিকুল কবির তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন : সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ৩০ নভেম্বর, মঙ্গলবার। ‘ইত্তেফাক’এ তাঁর জন্য বসে অপেক্ষা করছি। বাইরের কি কাজ সেরে তিনি অফিস এলেন। সাড়ে ১২টার দিকে। অফিস কক্ষে প্রথমেই রাইটিং প্যাড টেনে নিয়ে খুব দ্রুত কিছু লিখতে লাগলেন। মাত্র একটি স্লিপ লেখার পরই অফিস কক্ষে অন্যান্য লােকজন ঢুকে গেল। তিনি লেখা বন্ধ করলেন। লেখা স্লিপটি সতর্কভাবে খুঁজে দিলেন আমার হাতে। কিছুক্ষণ পর লােকজনের ভিড় কমলে তিনি বললেন, “অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে এই তথ্যগুলাে আমি পেয়েছি। তােকে আরও কিছু জোগাড় করে দেব। এগুলাে ওপারে পাচার করার ব্যবস্থা করতে হবে।” সিরাজ ভাইয়ের লেখা সেই স্লিপটি এখনও সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছি। তার হুবহু অনুলিপি তুলে ধরছি : ঈমানের বরকতে ১, মন্ত্রী আবুল কাশেম- ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক, বর্তমান নাম কাশেম টেক্সটাইল মিলস। ২. মওলানা আমিনুল ইসলাম- সদরঘাটের বিখ্যাত ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরি ও । যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। এপ্রিলের প্রথমভাগে লাইব্রেরি লুট করিয়ে ১০ টাকা মণ দরে বই বিক্রি করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও ওই একই দরে বিক্রি হয়। সম্প্রতি নিজ নামে অ্যালট করিয়ে দখলীদার। ৩. মওলানা আবদুল মান্নান- মদন মােহন মন্দির ভবনের বর্তমান মালিক।
সংক্ষেপে সিরাজ ভাই লিখলেও এখানে অস্পষ্ট কিছু নেই। পাক সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ফন্দি-ফিকির করে দালাল কোম্পানি কীভাবে মানুষের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন ও আত্মসাৎ করত, এইটি তার একটি নমুনা মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হােসেন ইত্তেফাকের পাতায় সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। সে সময় এ কাজ ছিল রীতিমতাে দুঃসাহসের ব্যাপার। যুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হােসেন ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “যে দোষে শেখ মুজিবকে দোষী বলা হচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকরা সেই একই দোষে দুষ্ট।” এ সময় জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখে সিরাজুদ্দীন হােসেনকে পরােক্ষভাবে হুমকি দেয়। কিন্তু এসব হুমকি তার কলমকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। তাঁর লেখা মৌলিক বইগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে : A Look Into The Mirror’, ‘ইতিহাস কথা কও’, ছােট থেকে বড়’, ‘মহীয়সী নারী’ ইত্যাদি। তিনি চল্লিশেরও বেশি বিদেশি বই অনুবাদ করেছেন। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে : ‘Man Against Nature’, Sun’, ‘Democracy’, ‘Gone is Gone’, ‘জার্মান রূপকথা’, ‘পারমাণবিক শক্তির রহস্য”, “আমার জীবন দর্শন’, ‘মানব জীবন’, ‘অগ্নি পরীক্ষা ইত্যাদি। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বছর আগে তিনি ‘Days Decisive’ নামে একটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন। এই বইয়ের ভূমিকায় আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছিলেন : His presentation of facts and documents and their analysis have been quite correct and objective but not without subjective outpouring of patriotic heart and tormented soul representative of suffering millions.
সিরাজুদ্দীন হােসেনকে অপহরণের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল পাকিস্তানিদের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ । ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাকে তার শান্তিনগরের ৫ নম্বর চামেলীবাগের ভাড়া বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। ১০ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে দরজা খুলতে এগিয়ে যান সিরাজুদ্দীনের বড় ছেলে শাহীন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন“কে?” বাইরে থেকে তাদের বাড়িওয়ালা ডাক্তারের কণ্ঠ শােনা যায়- “শাহীন দরজা খােলাে।” এত রাতে হয়তাে কোনাে বিপদে পড়েছেন ভেবে দরজা খুলে দিতেই কয়েকটি উদ্যত রাইফেলের সামনে হতবাক হয়ে যান শাহীন।
এরা এসেছে সিরাজুদ্দীন হােসেনকে ধরে নিয়ে যেতে। বাড়িওয়ালাকে বন্দুকের নলের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। ঘাতকদের সবার মুখে কাপড় বাধা। এ সময় । ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সিরাজুদ্দীন। সঠিক লােককে পাওয়া গেছে এটা |নিশ্চিত হওয়ার তারা বলে, “আমাদের সাথে যেতে হবে।” সিরাজুদ্দীন পাঞ্জাবি গায়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ঘাতকেরা তাঁকে পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়ারও সময় দেয়নি। গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তােলা হয় সিরাজুদ্দীন হােসেনকে। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। রায়েরবাজার-কাটাসুরের অসংখ্য গলিত লাশের মধ্যে খুঁজেও তার লাশেরও কোনাে সন্ধান পাওয়া যায়নি।
শহীদ সিরাজুদ্দীন হােসেনের স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী। আট ছেলে নিয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে স্বামীহারা হন নূরজাহান। স্বাধীন দেশে এই শহীদ পরিবারটিকে শেখ মুজিব সরকার একটি বাড়ি বরাদ্দ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯ নম্বর নিউ ইস্কাটনের ওই বাড়ি থেকে পরিবারটিকে উচ্ছেদ করা হয়। সিরাজুদ্দীন হােসেনের ছেলেদের মধ্যে শামীম, ফাহিমা ও সেলিম বিদেশে বাস করেন; শাহীন ও জাহীদ যুক্ত সাংবাদিকতায়; নাসিম ও শাহীদ প্রকৌশলী এবং তৌহীদ সহকারী অধ্যাপক। _ সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে শহীদ সিরাজুদ্দীন হােসেনকে একুশে পদক (মরণােত্তর)’ এবং ২০১০ সালে ‘মানিক মিয়া স্বর্ণপদক (মরণােত্তর)’ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে যশােরের বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরাতে। শহীদ সিরাজুদ্দীন হােসেনের নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা