সায়ীদুল হাসান
সায়ীদুল হাসানের জন্ম ১৯১২ সালে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার হাসান মঞ্জিলে। খান বাহাদুর রফিকুল হাসানের পাঁচ ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছােট। এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম হিসাবে পরিচিত বানিয়াচং। বড় গ্রামে জন্ম নেওয়া সায়ীদুল হাসানও শৈশব থেকেই বড় মনের অধিকারী ছিলেন। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গরিব নিপীড়িত মানুষের প্রতি ছিল তার গভীর মমতা। সিলেট থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে তিনি ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে বি, এ, পাস করার পর তিনি আইন বিষয়ে ভর্তি হন। ছাত্রজীবন থেকেই সায়ীদুল হাসান বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। তকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পাটির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার সভাপতি কমরেড আবদুল হকের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। মানবতাবাদী সায়ীদুল আমৃত্যু একটি শােষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত সায়ীদুল হাসান ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ও তিনি একই ভূমিকা পালন করেছেন।
স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তিনি চাকরি না করে ব্যবসাকে বেছে। নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিশেষ অনুরােধে তিনি পাকিস্তান। হাইকমিশনে যােগ দেন। একজন প্রাজ্ঞ কুটনীতিক হিসাবে তিনি পাকিস্তান হাই কমিশনের লন্ডন ও কলম্বাে শাখায় ট্রেড কমিশনার হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীলঙ্কায় অবস্থানকালে পূর্ব বাংলার দুর্ভিক্ষের সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়েন মানবদরদি সায়ীদুল হাসান। তিনি এক মুহূর্ত দেরি না করে টেলিগ্রামযােগে করাচিতে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। বিদেশ মন্ত্রকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি। ঢাকায় চলে আসেন এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাড়ান। ১৯৫৮ সালে সায়ীদুল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপে যােগ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। সে সময় ন্যাপের রাজনীতি ছিল বহুলাংশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত। দলের অনেকেই কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সায়ীদুল হাসানও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কমিউনিস্ট শিবিরের আন্তর্জাতিক বিতর্কের কারণে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)’। জানা যায়, ১৯৬৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)’-এর ৪র্থ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সায়ীদুল হাসানের পারিবারিক মালিকানাধীন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় অবস্থিত হিঙ্গাজিয়া চা বাগানে। একটি প্রতিকূল পরিবেশে জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠানের স্থান করে দিতে তিনি মােটেই পিছপা হননি। সৌম্য, শান্ত, অমায়িক অথচ দৃঢ়চেতা সায়ীদুল হাসানের অনুরাগ ছিল সংস্কৃতিতেও। তাঁর বাড়িতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের আনাগােনা থাকত সর্বদা। দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা হাসান ছায়ানটের সাথে যুক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে সায়ীদুল হাসান মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বিশ্বস্ত সহচর হিসাবে কাজ করেছেন।
সায়ীদুল হাসানের নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে জানা যায় : নন্দরানী ও শ্রী গােবিন্দপুর চা বাগানের মালিক এবং সিলেটের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নির্মল চৌধুরী ১৯৭১ সালে তার দুই নাবালিকা কন্যাসহ গােপনে ঢাকায় সায়ীদুল হাসানের বাড়িতে ওঠেন। নির্মল চৌধুরীর চা বাগানের এক অবাঙালি কর্মচারী জামাল তাঁকে অনুসরণ করে সায়ীদুল হাসানের বাসা পর্যন্ত আসে ও কৌশলে নির্মল চৌধুরীকে সেখান থেকে গুম করে। সায়ীদুল হাসান তখন অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি নির্মল চৌধুরীর খোঁজে পাগলের মতাে এখানে সেখানে ছুটে বেড়ান। এ রকমই একটি অবস্থায় নির্মল চৌধুরীকে ফিরে পাওয়ার এক মিথ্যা আশ্বাসে ১৮ মে সন্ধ্যায় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। সায়ীদুল হাসান। সেই যাওয়াই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া, তিনি আর ফিরে আসেননি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ফরিদা হাসান এক ভারতীয় জেনারেলের সহায়তায় বন্দি পাকিস্তানি লে. জেনারেল নিয়াজীর সাথে দেখা করে তাঁর স্বামী ও নির্মল চৌধুরী সম্পর্কে তথ্য জানতে চান। তখন ফরিদা জানতে পারেন যে পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের কর্নেল মাকসুদ ওই সময়ই লালমাটিয়া ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে সায়ীদুল হাসান, নির্মল চৌধুরী ও রণদাপ্রসাদ সাহাকে হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডটি ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাগুলাের মধ্যে সামরিক গােয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পিত একটি অপারেশন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গােয়েন্দা সংস্থা মনে করত, পাকিস্তানে রাষ্ট্রবিরােধী অনেক কর্মকাণ্ডের আশ্রয়স্থল সিলেটের চা বাগানগুলাে। বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্রের সময় ত্রিপুরা সীমান্তঘেঁষা চা বাগানগুলাে যােগাযােগ ও যাতায়াতের পথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে তারা মনে করত। এসব কারণে সায়ীদুল হাসান ও নির্মল চৌধুরীর ওপর পাকিস্তানিদের বিশেষ ক্ষোভ ছিল । বানিয়াচংয়ে শহীদ সায়ীদুল হাসানের নামে একটি গণ পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা