You dont have javascript enabled! Please enable it!
সাইফ মিজানুর রহমান
১৯৭১ সালের ৫ মে পিরােজপুর শহরের বলেশ্বর নদের পাড়ে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার হওয়াদের একজন সাইফ মিজানুর রহমান। তিনি সে সময় পিরােজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এছাড়া ওই হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন তকালীন পিরােজপুর মহকুমার প্রশাসক আব্দুর রাজ্জাক এবং মহকুমা পুলিশ অফিসার ফয়জুর রহমান আহমেদ। সাইফ মিজানুর রহমানের জন্ম ১৯৪২ সালের ৩ ডিসেম্বর, নড়াইলে। তার পুরাে নাম এস. বি. এম. মিজানুর রহমান, ডাকনাম দুলু। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক রাজনৈতিক পারিবারিক পরিবেশে। তাঁর নানা সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার স্পিকার ও মন্ত্রী। তার বাবা আফসার উদ্দীন আহমেদ ছিলেন আইনজীবী, ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য এবং পরে নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি। মা মতিয়া আহমেদও ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এই পরিবারের ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। মিজানুর রহমান মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেন। ১৯৫৭ সালে নড়াইল শহরের দুর্গাপুর মাঠে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের উৎসাহে বক্তৃতা করে সকলকে মুগ্ধ করেন কিশাের মিজানুর। মিজানুর রহমান ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সালে অর্থনীতিতে বি. এ. (অনার্স) এবং ১৯৬৪ সালে এম. এ. পাস করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তার বিশেষ ঝোঁক ছিল সাহিত্যের প্রতি। তিনি গল্প, কবিতা ও নাটক লিখতেন; খেলাধুলা পছন্দ করতেন। তিনি যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, তখনই তার একটি বই প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত ‘প্রবাল’, ‘প্রতিবিম্ব’, ‘অনেক তারার ঘর এবং ‘ক্রান্তিকালের অবকাশ’ নাটকগুলাে খুই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এসব নাটকের উপজীব্য ছিল বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের শােষণ-নিপীড়ন।
এম. এ. পাসের পর তিনি কিছুদিন অধ্যাপনা করেছিলেন। পরে ইউনাইটেড ব্যাংকেও কিছুদিন চাকরি করেন। জানা যায়, বাংলায় স্বাক্ষর করার কারণে কর্তৃপক্ষ তাকে অভিযুক্ত। করলে তিনি ঘৃণাভরে ওই চাকরি ছেড়ে দেন। পরে তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার কারণে মিজানুরকে কারাভােগ করতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর মিজান গ্রেফতার হন এবং নড়াইল কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরােধী আন্দোলনে অংশ নিয়েও তিনি কারাবরণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল সংসদের নির্বাচনে তিনি প্রথমে পত্রিকা সম্পাদক এবং পরেরবার সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মিজানুর। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কুখ্যাত গভর্নর মােনায়েম খানের যােগদান প্রতিহত করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের তীব্র রােষানলে পড়েন মিজান। তারই পরিণতিতে সি, এস, পি, (সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করলেও তাকে চাকরিতে যােগ দিতে দেওয়া হয়নি। সেই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (ই. পি. সি, এস.) উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পদে যােগ দেন।
| একাত্তরে তরুণ সাইফ মিজানুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পিরােজপুর মহকুমার। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (ট্রেজারি অফিসার)। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৬ মার্চ দুপুরে পিরােজপুর শহর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৬ মার্চ বিকালে সমস্ত মিছিল এসে জড়াে হয় পিরােজপুর টাউন ক্লাব ময়দানে। সেখানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য। অ্যাডভােকেট এনায়েত হােসেন খান। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে ছুটে যায় মহকুমা অস্ত্রাগারের দিকে। জনতার ঢলের পিছনে পিছনে এনায়েত হােসেন খান, এম. পি. এ. ডা. আব্দুল হাই, এম, পি, এ. ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডলসহ পিরােজপুরের অন্যান্য নেতাও উপস্থিত হন অস্ত্রাগারের কাছে। সেখানে গিয়ে তারা বিস্ময়ের সাথে দেখতে পান যে অস্ত্রাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফ মিজানুর রহমান এক গােছা চাবি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। নেতাদের দেখে সাইফ মিজানুর রহমান বললেন, “আমি আপনাদের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।” এরপর তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা খুলে দেন। তিনি ৮০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর অস্ত্রাগারে রক্ষিত গােলাবারুদ নেতাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “যুদ্ধের জন্য আগামীকাল থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি সব ধরনের সহযােগিতা করব।” পরদিন ২৭ মার্চ থেকে একযােগে সাতটি (কারও মতে আটটি) কেন্দ্রে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । আর সরকারি গােডাউন থেকে চাল সরবরাহ করে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযােদ্ধাদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করেন মিজান।
তার ভাই সাইফ ফাতেউর রহমানের লেখা থেকে জানা যায় :  ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সরকার গঠনের পরই তিনি পিরােজপুরের … স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, অন্যান্য পেশাজীবী ও স্থানীয় জনসাধারণের সহযােগিতায় এক সভার আয়ােজন করেন। তখনও পর্যন্ত সমগ্র পিরােজপুর মহকুমা সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত। ওই সভাতেই পিরােজপুরকে স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ হিসাবে ঘােষণা করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘােষণা দেওয়া হয়।  ৫ মে শুরু হয় যুগপৎ বিমান ও গানবােট আক্রমণ। মরণপণ প্রতিরােধ গড়ে তােলেন মিজান ও তাঁর সাথীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি তাঁরা। মিজান ও আরও অনেকের পরিণতি সম্পর্কে এরপর আর কোনাে প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ বলেন সরাসরি প্রতিরােধযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। কারও কারও মতে, গুরুতর আহত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি, ফয়জুর রহমান ও রাজ্জাক সাহেব। পরে তাদের অত্যন্ত নৃশংস ও যন্ত্রণাদায়কভাবে অত্যাচার করে গুলি করে মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড) শহীদ সাইফ মিজানুর রহমান বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু তার কোনাে ছেলেমেয়ে ছিল না। পিরােজপুর ও নড়াইলে মিজানুর রহমানের নামে দুইটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে সরকার মিজানুর রহমানকে মরণােত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!