শ্যামল কান্তি লালা
শ্যামল কান্তি লালার জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৮ জানুয়ারি, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরণদ্বীপ ইউনিয়নের আকালিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম সুধাংশু বিমল লালা, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। শ্যামল কান্তি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালের জুনে এম, বি. বি. এস. পাস করে হাসপাতালে হাউস সার্জন হিসাবে যােগ দেন শ্যামল কান্তি। সে সময় এখনকার মতাে বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ ছিল না। মেধানুসারে দুজন হাসপাতালে শল্য চিকিৎসক (সার্জন) হিসাবে কাজ করার সুযােগ পেতেন। শান্ত-সৌম্য স্বভাবের লালা পান খেতে অসম্ভব ভালােবাসতেন। ঠোটে সবসময় থাকত একচিলতে স্নিগ্ধ হাসি। তার কাছে চিকিৎসা নেওয়া রােগীরা সবাই একবাক্যে বলতেন, ডা, লালার কাছে এলেই মনে হয় অর্ধেক রােগ ভালাে হয়ে গেছে। তার প্রশংসায় সবাই ছিলেন পঞ্চমুখ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি। হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু যাননি। প্রথম কারণ, মানবতার সেবা তার কাছে ছিল প্রধান। দ্বিতীয়ত, তাঁর শিক্ষাগুরু ডা. শামসুদ্দীন আহমেদকে তিনি একা ফেলে যেতে চাননি। ডা. শামসুদ্দীনের মতাে তিনিও ধারণা করেছিলেন, পাকবাহিনী আর যাই করুক, মানবসেবার একমাত্র স্থান হাসপাতালে কিছু করবে না। কিন্তু তাদের সে ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশের অন্যান্য স্থানের মতাে সিলেটেও চলছিল প্রতিরােধযুদ্ধ। প্রতিদিন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসছিল যুদ্ধে আহত মানুষ । শ্যামল কান্তি লালা ডা. শামসুদ্দীনের সাথে আহতদের চিকিৎসা করছিলেন। সিলেটে প্রতিরােধযুদ্ধ ভেঙে পড়লে ৯ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়। তখন শ্যামল কান্তি লালা ডা. শামসুদ্দীনের সঙ্গে ওয়ার্ডে রােগী দেখছিলেন। সেনারা তাঁদের সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায়। এ সময় শ্যামল কান্তি লালা চিল্কার করে ইংরেজিতে সেনাদের উদ্দেশ করে বলেন, “প্লিজ ডােন্ট হার্ট হিম, হি ইজ মাই প্রফেসর, শুট মি ফার্স্ট, বাট লেট হিম গাে।” কিন্তু তার এ অনুরােধ হানাদারদের কাছে ছিল মূল্যহীন। সেনারা তাদের টেনে বাইরে এনে আরও কয়েকজনসহ লাইনে দাঁড় করায়। তখন শ্যামল কান্তি লালা আবারও কিছু বলতে চাইলে এক পাকসেনা তার মুখে সজোরে লাথি মারে। এরপর তাদের গুলি করা হয়। এখানে একজন ছাড়া সবাই মারা যান। ৯ এপ্রিল এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ১২ এপ্রিলের আগে তাদের কাউকে সমাহিত করা যায়নি। ১২ এপ্রিল কারফিউ শিথিল হলে হাসপাতাল কলােনি থেকে কয়েকজন এসে মরদেহগুলাে মাটিচাপা দেয়।
এ ঘটনা সম্পর্কে আরও জানা যায় ডা, শ্যামল কান্তি লালার সতীর্থ ডা, মৃগেন কুমার দাস চৌধুরীর ‘আমার হােস্টেলমেট’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন : ৯ এপ্রিল মধ্যবেলা। লালাকে নিয়ে শামসুদ্দীন স্যার ওয়ার্ডে রােগী দেখছিলেন। একটু পর জরুরি অপারেশনে ওটিতে ঢুকবেন। এমন সময় পাকিস্তানি সেনারা ওয়ার্ডে ঢুকে তাঁদের দুজনকে পাষণ্ডের মতাে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালের দক্ষিণপূর্ব কোণে আর, এস, কোয়ার্টার-সংলগ্ন খালি মাঠে নিয়ে যায়। সঙ্গে জড়াে করে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী, নার্স মাহমুদুর রহমান, পিয়ন মাে. মহিবুর রহমান, মকলিসুর রহমানসহ মােট সাতজনকে। পেছন থেকে গুলি করে ঝাঝরা করে দেয় সবার শরীর। গুলিতে ডান হাতের হাড় চুরমার হয়ে গেলেও মকলিসুর অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। হানাদারেরা স্থান ত্যাগ করার পর গড়িয়ে গড়িয়ে মকলিসুর সরে পড়ে। সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে মকলিসুর আজও বেঁচে আছে। আমাদের অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কথা আমি স্বাধীনতার পর মকলিসুর ও তৎকালীন আর, এস, ডা. সৈয়দ লােকমান ও অন্যদের কাছ থেকে শুনি। (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ, নভেম্বর ২০০৯)। শহীদ ডা. শ্যামল কান্তি লালা অবিবাহিত ছিলেন। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রীনিবাসটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া কলেজের হাসপাতাল চত্বরে তাঁর নামে স্মৃতিফলক রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে তাঁকে শহীদ হিসাবে কোনাে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা