শেখ হাবিবুর রহমান
শেখ হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯১৯ সালের ২১ জুলাই, বাগেরহাট জেলার মােরেলগঞ্জ উপজেলার বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে। কি এখানেই তার পৈতৃক নিবাস। তার বাবার নাম শেখ আবদুল খালেক, মায়ের নাম লুৎফুননেছা খাতুন। তিন ভাই ও এক বােনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শেখ হাবিবুর রহমান বাগেরহাটের যদুনাথ ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ভর্তি হন বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে। কিন্তু আর্থিক কারণে তাঁর লেখাপড়া আর এগােয়নি। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল। এ সময় তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শেখ হাবিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ঝিনাইদহের সাব ডিভিশনাল অ্যাডজুট্যান্ট অব আনসার নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সরকারি চাকরিতে থেকেও তিনি আন্দোলনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঝিনাইদহে ভাষা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত তেজস্বী ও স্বাধীনচেতা। ফলে কারামুক্ত হওয়ার পর তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন।
এ সময় তিনি ঝিনাইদহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি আইন পেশায় যােগ দেন এবং একই সময় সাংবাদিকতাও শুরু করেন। ১৯৫২ সালে ঝিনাইদহের প্রথম সাংবাদিক হিসাবে তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর তিনি সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। শেখ হাবিবুর রহমান ছিলেন তৎকালীন মফস্বল সাংবাদিকতার প্রাণপুরুষ। ঝিনাইদহ তথা ওই অঞ্চলের স্থানীয় সমস্যাকে জাতীয় দৈনিকের পাতায় নিয়ে এসে তিনি অনেক সমস্যার সমাধান করেছিলেন। সাংবাদিকতা পেশায় প্রতিবাদী কণ্ঠের কারণে বিভিন্ন সময় তাকে পাকিস্তানি শাসকদের রােষানলে পড়তে হয়েছে, নির্যাতনও ভােগ করতে হয়েছে। ওই সময়ে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ চেয়ারম্যান, আমলা, কর্মচারীদের বিভিন্ন দুর্নীতির খবর ছাপা হলে তাঁকে বহু হুমকির মােকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু সমস্ত ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নিজের নীতিতে সব সময় অটল ছিলেন। শেখ হাবিবুর রহমান।
সত্যভাষী হিসাবে ঝিনাইদহ শহরে তাঁর সুনাম ছিল। ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাংবাদিক সমিতির অফিস ও প্রেসক্লাব ছিল যশােরের দড়াটানা। সেখানে সাংবাদিকদের সব সভা-সমাবেশে তিনি ঝিনাইদহ থেকে এসে সঠিক সময়ে যােগ দিতেন। হাবিবুর ছিলেন খুবই সহজ-সরল, সদালাপী, হাসিখুশি, দরাজ দিলের অধিকারী। মক্কেলদের সাথেও তিনি সবসময় অমায়িক আচরণ করতেন। অনেক ক্ষেত্রে গরিব মক্কেলদের তিনি বিনা পয়সায় আইনি সহায়তাও দিয়েছেন। ১৯৬০ সালে ঝিনাইদহ সরকারি কেশব চন্দ্র কলেজ (কে. সি. কলেজ) প্রতিষ্ঠার সময় তিনি দশ বিঘা জমি দান করেন। একাত্তরে অসহযােগ আন্দোলন ও প্রতিরােধ যুদ্ধকালেও তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঝিনাইদহের প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে। এ সময় তিনি যশাের রােডের (বর্তমানে শেরে বাংলা রােড) নিজ বাসা ছেড়ে কয়েক মাইল দূরে হলিধানি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। শেখ হাবিবুর রহমান সেখানে গিয়েও বেশি দিন চুপ করে থাকতে পারেননি। তিনি ১ অথবা ২ মে ঝিনাইদহ শহরে ফিরে আসেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা তাকে আটক করে। এরপর পাকসেনারা তার ওপর কয়েক দিন পৈশাচিক অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালায়। অবশেষে ৯ মে পাক হানাদাররা শেখ হাবিবুর রহমানকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঝিনাইদহ শহর থেকে সাত কিলােমিটার দূরে যশাের-ঝিনাইদহ সড়কের তেঁতুলতলা নামক স্থানে তার মরদেহ ফেলে রাখা হয়।
শেখ হাবিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ মিজানুর রহমান এক সাক্ষাত্তারে জানিয়েছেন : পঁচিশ মার্চের পর ঝিনাইদহের সংগ্রামী জনগণ সংগঠিত হয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। এর সঙ্গে আমার বাবাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের পক্ষে সুসংগঠিত ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশি দিন প্রতিরােধ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ১৬ এপ্রিল সেনাবাহিনী ঝিনাইদহে প্রবেশ করে। এর আগেই বাবা শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে হলিধানি গ্রামে আশ্রয় নেন। দুই সপ্তাহ পর পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে তিনি শহরে আসেন। এ সময় পাকিস্তানিরা তাঁকে আটক করে। কয়েক দিন অকথ্য নির্যাতনের পর ৯ মে তাঁকে হত্যা করে তেঁতুলতলায় তার লাশ ফেলে রাখে। পাকিস্তানি সেনাদের হুমকির কারণে স্থানীয় গ্রামবাসী তার লাশ কবর দিতে পারেননি। তাঁর লাশ আমরা পাইনি। (প্রথম আলাে, ৮ জানুয়ারি ২০১৪) শেখ হাবিবুর রহমানের স্ত্রীর নাম জোবতাতুননেছা। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি মারা গেছেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ছিল। দুই মেয়ে ইতােমধ্যে মারা গেছে। শেখ হাবিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ মিজানুর রহমান সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। স্বাধীনতার পর তেতুলতলায় শেখ হাবিবুর রহমানের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদানের জন্য ঝিনাইদহ জেলা শিল্পকলা একাডেমি ১৯৭৮ সালে তাকে মরণােত্তর সম্মাননা জানিয়েছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা