You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জী
শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীর জন্ম ১৯১৫ সালের ৫ জ্যৈষ্ঠ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা শহরে। তাঁর বাবা ছিলেন ডাক্তার, তিনি কাজের সুবাদে এক সময় রংপুরে এসে আবাস গাড়েন। শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীও রংপুরে বেড়ে ওঠেন। স্কুল জীবনেই ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংস্পর্শে আসেন শিবেন্দ্রনাথ । শােনা যায়, তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ বীরকিশাের ক্ষুদিরাম বসুর সাথে কাজ করার সুযােগ পেয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে রংপুর জিলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র মামলায় শিবেন্দ্রনাথ দুই বছর কারাভােগ করেন। পরের এক বছর তিনি বাড়িতে নজরবন্দি থাকেন। ১৯৩৭ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৮ সালে নবগঠিত ছাত্র ফেডারেশনের রংপুর শাখার প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন শিবেন্দ্রনাথ। রংপুর কলেজ থেকে বি. এ. পাস করার পর শিবেন কলকাতায় যান এম. এ. পড়তে। সেখানেও তিনি ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় আইন কলেজে তাঁর সহপাঠী ও সহকর্মী ছিলেন। কলকাতায় আইন পড়ার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতা বিষয়েও প্রশিক্ষণ নেন।
রংপুর ফিরে এসে শিবেন্দ্রনাথ সেই সময়ের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বিজয়চন্দ্র মৈত্রের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করত, তিনি তাদের পক্ষ নিয়ে সে সব মামলা লড়তেন। এর ফলে এক সময় তাঁকেও কারাবরণ করতে হয়েছে। প্রায় এক বছর কারাবাস শেষে মুক্তি পেয়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপে’ যােগ দেন। রংপুরে ন্যাপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শিবেন্দ্রনাথ। | ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ কারণে তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি মুক্তি পান। ১৯৫৩ সালে রংপুর পৌরসভার নির্বাচনে জনগণের ভােটে তিনি কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে তার পাসপাের্ট বাতিল করা হয় এবং তাকে বিনাবিচারে দুই বছর কারাবন্দি রাখা হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির সময় তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এবার তিনি ছয় বছর দুই মাস জেলে কাটান। এ সময় প্রখ্যাত সাহিত্যিক সত্যেন সেনের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। সত্যেন সেনও তখন কারাবন্দি। কারাবন্দি থাকা অবস্থাতেই শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জী বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ ও উপন্যাস লেখেন যা পরে রংপুরের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ছয় মাস তিনি অসুস্থ ছিলেন। সুস্থ হয়ে শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জী পাকিস্তানের পেশােয়ারে অনুষ্ঠিত ন্যাপের জাতীয় সম্মেলনে অংশ নেন। সম্মেলনে তিনি রংপুরের প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৬৯, ১৯৭০ সালের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শিবেন্দ্রনাথ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের ৬ দফার পক্ষেও সােচ্চার ছিলেন। এছাড়াও শিবেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন নিরলস সংস্কৃতিকর্মী। তিনি রংপুরের শিখা সংসদ নাট্যদলের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ বিজয়চন্দ্র মৈত্রের গুপ্তপাড়ার বাড়ি থেকে শিবেন্দ্রনাথকে ধরে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার ওপর চালানাে হয় অমানবিক নির্যাতন। তাকে যখন আদালতে হাজির করা হয়, তখন তিনি সােজা হয়ে দাড়াতে পারছিলেন না। দুজন পুলিশ তাকে ধরে রেখেছিল। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীকে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর থেকে দিনাজপুর কারাগারে নিয়ে যায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই তাঁর জীবনের শেষবারের মতাে রংপুর ছেড়ে যাওয়া।  ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বিকাল ৪টায় শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জীকে দিনাজপুর কারাগার থেকে বের করে চোখ-হাত বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় দিনাজপুর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে আরও অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালির সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শহীদ শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জী অকৃতদার ছিলেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!