শাহ আব্দুল মজিদ
শাহ আব্দুল মজিদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি গাইবান্ধায়। তাঁর বাবার নাম শাহ ইউনুস আলী, মায়ের নাম মেহের আফজুন বেগম। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। মজিদ ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম. এ. পাস করেন। এরপর তিনি সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন। পরে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি তর্কালীন। জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সে সময় তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে যােগ দেন। সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালে প্রথমে চট্টগ্রামে সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে প্রবেশনারি অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি নারায়ণগঞ্জের এস, ডি. পি, ও, (মহকুমা পুলিশ প্রশাসক) নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি পুলিশ সদর দফতরে স্পেশাল ব্রাঞ্চে যােগ দেন। ১৯৬৫ সালে শাহ আব্দুল মজিদ ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীকালে বগুড়া ও ফরিদপুর জেলার এস, পি., সারদা পুলিশ একাডেমির উপাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার হন। | শাহ আব্দুল মজিদ ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ । ইতিহাস ও সঙ্গীতের প্রতি। ছিল তার গভীর আগ্রহ। উনসত্তর ও সত্তরের গণআন্দোলন চলাকালে তিনি আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। মিছিল-সমাবেশে যাতে কোনাে হামলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য অধীনস্থদের না পাঠিয়ে তিনি নিজেই এসব স্থানে দায়িত্ব পালন করতেন। অসহযােগ আন্দোলনকালে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। এসব ভূমিকার জন্য পাকিস্তানি শাসকদের চোখে তিনি সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন ।
১৯৭১ সালে শাহ আব্দুল মজিদ রাজশাহীর পুলিশ সুপার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ২৬ মার্চ থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী পুলিশ লাইন্স দখল করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যদের সশস্ত্র প্রতিরােধে সেনাবাহিনী পুলিশ লাইন্সে ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ২৯ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রসহ পুনরায় আক্রমণ করলে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং অনেকে শহীদ হন। পুলিশ সুপার শাহ আব্দুল মজিদের ভূমিকায় পাক সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসকের বাসভবন থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া। যায়নি। ধারণা করা হয়, ৩১ মার্চ পাকবাহিনী পুলিশ সুপার শাহ আব্দুল মজিদকে তাঁর অফিস প্রাঙ্গণেই গুলি করে হত্যা করে। তার লাশেরও কোনাে খোঁজ আর মেলেনি। এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তার বড় মেয়ে ফারজানা শাহনাজ মজিদের কাছ থেকে। এক সাক্ষাৎকারে শাহনাজ জানিয়েছেন : ২৫ মার্চ রাত ১১টার পর আমাদের বাসার টেলিফোন, বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া হয়। বাসা পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে। সেই রাতে সমগ্র রাজশাহী শহর পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় দখলে চলে যায়। রাজশাহীর ডি. সি. রাশিদুল হাসানের (পরে বাংলাদেশ সরকারের সচিব) আহ্বানে বাবা আমাদের নিয়ে তাঁর বাসায় আশ্রয় নেন।
৩১ মার্চ ডিসির বাংলাে থেকে পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে গ্রেফতার করে। তখন মাগরিবের সময়, আমার মা নামাজে বসেছিলেন। এমন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সােলেমান মাহমুদ নামের এক ক্যাপ্টেন একদল সেনাসহ ডিসির বাসায় জিপ নিয়ে আসে। মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবাকে জোরপূর্বক জিপে তােলা হয়। সেনারা বাবার চারদিকে অস্ত্র তাক করে দাড়িয়েছিল। ক্যাপ্টেন সােলেমান মাহমুদকে ২৬ থেকে ৩১ মার্চ প্রতিদিনই ডিসির বাংলােতে দেখা যেত।” (প্রথম আলাে, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪) শাহ আব্দুল মজিদের স্ত্রীর নাম নাজমা মজিদ। স্বাধীনতার পর সরকারের আহ্বানে তিনি সরকারি চাকরিতে যােগ দেন এবং মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের উপপরিচালক হিসাবে অবসর নেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে- মামুন মাহমুদ শাহ, বখতিয়ার রসুল শাহ, ফারজানা শাহনাজ মজিদ এবং সাগুফতা ফারাহ্ মজিদ। স্বাধীনতার পর রাজশাহী শহরের গির্জার পশ্চিমে ও পার্কের পূর্ব দিকের যে রাস্তাটি টেনিস কমপ্লেক্স হয়ে পদ্মার পাড় দিয়ে গেছে, সেই রাস্তাটি শাহ আব্দুল মজিদ সড়ক’ নামে নামকরণ করা হয়। এছাড়া রাজশাহী পুলিশ লাইন্স স্কুলের একাডেমিক ভবন তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল শইদি শাহ আব্দুল মজিদ স্মরণে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা