শামসুল হক খান
একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (ডি. সি.) হিসাবে কাজে যােগ দিয়েছিলেন শামসুল হক খান। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি আর ফিরে আসেননি, তাঁর কোনাে খোজও আর পাওয়া যায়নি। শামসুল হক খানের পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর। তার পুরাে নাম এ. কে. এম, শামসুল হক খান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন শামসুল হক খান। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেন। কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন ভূগােল শাস্ত্রে অধ্যাপনা করার পর তিনি সিভিল সার্ভিসে যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু বাঙালি হওয়ার কারণে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তাকে মেডিকেলে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। মেডিকেল পরীক্ষার বিরুদ্ধে আপিল করে তিনি জয়ী হন এবং সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন। সত্তরের নির্বাচনের সময় তিনি চট্টগ্রামে ডেপুটি ইলেকশন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তখনই আভাস পেয়েছিলেন যে দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ শুরু হলে সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের দেশমাতৃকার জন্য সংগ্রাম করার সময় এসেছে। যদিও আমরা এই চরম ত্যাগের ফল ভােগ করতে পারব না। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্বর্ণদ্বার খুলে দেবে।”
শামসুল হক খান প্রশাসনে চাকরির প্রলােভন, সরকারি নীতি ও আদেশকে তুচ্ছ করে দেশপ্রেম এবং কর্তব্যবােধের শাণিত চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাঙালির মহত্তম সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তখন প্রশাসকের ভূমিকা ছেড়ে তিনি রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি কুমিল্লার পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমদ, ড. আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক খােরশেদ আলম এম. সি. এ., আলী আহমেদ এম. সি. এ. প্রমুখকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধের পরিকল্পনা নেন। তাঁর নেতৃত্বে কুমিল্লায় গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী প্রতিরােধ আন্দোলন। শামসুল হক খানের নির্দেশে ক্যান্টনমেন্টে রেশন ও তাদের গাড়িগুলােকে পেট্রোলপাম্প থেকে পেট্রোল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৫ মার্চের আগে কুমিল্লার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা পুলিশের অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করতে গেলে পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন জেলা প্রশাসকের আদেশ ছাড়া স্টোরের চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনার জন্য স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক ডেকে পাঠালে বেসামরিক প্রশাসনের জেলা প্রধান শামসুল হক খান তাতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর এ আচরণে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
তাদের বাসস্থান কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি হওয়ায় অনেকেই অনুরােধ করেছিলেন কুমিল্লা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে শামসুল হক খানের খালাতাে ভাই মুক্তিযােদ্ধা শিক্ষাবিদ ড. এ. আর. মল্লিক (সে সময়ের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) টেলিফোনে তাকে বলেছিলেন, “আর্মিদের পেট্রোল ও রেশন বন্ধ করার পর তােমার ও এসপির কোনাে অবস্থাতেই ওখানে থাকা উচিত নয়। গ্রামের দিকে চলে যাও, পরে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে।” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “মিয়া ভাই, কুমিল্লাতে একটি শক্ত অবরােধ ঘাঁটি তৈরি করেই আমি আসব।” তাঁর গাড়িচালকও তাকে বলেছিল, “স্যার, চলুন আমরা বর্ডার পার হয়ে যাই।” তখনও তার উত্তর ছিল, “যদি চলে যাই তবে হানাদারদের বিরুদ্ধে কারা প্রতিরােধ গড়ে তুলবে?” ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বােখারীর নেতৃত্বে জেলা প্রশাসক শামসুল হক খানকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন সকালে গ্রেফতার করা হয় পুলিশ সুপার কবির উদ্দিনকে। জানা গেছে, তাদের দুজনকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। তাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শহীদ শামসুল হক খান বিবেকের টানে দাসত্ব বরণ না করে স্বাধীনতার বেদীতে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রথম জেলা প্রশাসক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলায় থাকাকালীন ড. মল্লিক শামসুল হক খান সম্পর্কে মেজর খালেদ মােশাররফের (শামসুল হক খানের স্ত্রীর খালাতাে ভাই) কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান যে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় কুমিল্লার গণহত্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশ সফরে এলে শামসুল হক খানের পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করেন। তখন ম্যাসকারেনহাস জানিয়েছিলেন, “ডিসি ওয়াজ কট অ্যান্ড লেটার অন শট।” যদিও স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত শামসুল হক খানের মা মাসুদা খানম বিশ্বাস করতেন যে তার আদরের সন্তান বেঁচে আছেন, তাঁর কাছে। ফিরে আসবেন।
শহীদ শামসুল হক খানের নামে কুমিল্লায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসাবে পরিচিত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়। শহীদ শামসুল হক খান স্মরণে বিয়াম ফাউন্ডেশনের মিলনায়তনটির নামকরণ হলেও দেশের গণমাধ্যমগুলােতে শুধু বিয়াম মিলনায়তন’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। নামফলকটিও এত ছােট আকারে লাগানাে হয়েছে যে সহজে চোখে পড়ে না। (প্রথম আলাে, ১৯ ডিসেম্বর ২০১১) তার স্মরণে স্থাপিত হয়েছে নাগরপুর শহীদ শামসুল হক পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’। কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের বাসভবন প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে ‘শহীদ জেলা প্রশাসক শামসুল হক মঞ্চ।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা