শামসুদ্দীন আহমেদ
শামসুদ্দীন আহমেদ জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১ আগস্ট আসামের করিমগঞ্জের বদরপুরে। (কয়েকটি সূত্রে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা ১ সেপ্টেম্বর এবং গ্রামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বৃন্দাশীল ।) তার বাবার নাম ইমানউদ্দিন আহমদ। এবং মায়ের নাম রাশেদা বেগম। ইমানউদ্দিন ছিলেন। রেলওয়ে কর্মকর্তা। তিন বােন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শামসুদ্দীন ছিলেন তৃতীয়। শামসুদ্দীন ১৯৩৯ সালে সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি ও লেটার নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪১ সালে সিলেট মুরারী চাঁদ (এম. সি.)। কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই, এসসি. পাস করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ১৯৪৬ সালে তিনি এম. বি. বি. এস. পাস করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন থেকে এফ, আর, সি, এস, করেন। ডা. শামসুদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা মেডিকেল। কলেজে হাউজ সার্জন হিসাবে। শামসুদ্দীন ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন সমাজমনস্ক। স্কাউট সদস্য হিসাবে তিনি দাঙ্গা-পীড়িতদের সাহায্য করেছেন। তিনি আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ডা. শামসুদ্দীন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসােসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং “সিলেট অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যখন প্রবল বন্যায় এদেশ বিপর্যস্ত, তিনি গঠন করলেন পাকিস্তান। অ্যাম্বুলেন্স কোর’ যা এদেশের প্রথম মেডিকেল রিলিফ সংস্থা। এ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে সংগঠনকে সাথে নিয়ে তিনি বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৫৪। সালে গঠিত ‘জালালাবাদ অন্ধকল্যাণ সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। সিলেটের যক্ষ্মা হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়ও তার ভূমিকা রয়েছে। আম্বরখানা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ডা. শামসুদ্দীন।
ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ ছিলেন সুদর্শন, মিষ্টভাষী কিন্তু কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পেশার প্রতি অসম্ভব সৎ এবং আন্তরিক ছিলেন। তিনি। নিজের বিশ্বাসের প্রতি অনমনীয় ও দৃঢ় স্বভাবের ছিলেন শামসুদ্দীন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন চলাকালে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কর্মরত। ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এ হামলা প্রতিরােধ করতে গিয়ে শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের সহযােগী অধ্যাপক মােহাম্মদ শামসুজ্জোহা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ডা, শামসুদ্দীন আহমেদকে একটি মিথ্যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কিন্তু প্রবল চাপের মুখেও তিনি মাথা নত করেননি।
১৯৭১ সালে তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (বর্তমানে তার নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে- “শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ সদর হাসপাতাল) শল্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। ২৫ মার্চ সিলেটের নিম্বার্ক আশ্রমের সামনে পাকবাহিনীর সদস্যরা গুলি চালালে লাতু সেন শহীদ হন ও আরও কয়েকজন আহত হন। আহতরা অনেকেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভিড় করে। সে সময় শুধু হাসপাতালে আসা রােগীদেরই নয়, রাস্তাঘাট থেকে রােগী সংগ্রহ করে তাদেরও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন ডা. শামসুদ্দীন। ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের গণহত্যার খবর শুনে ডা. শামসুদ্দীন তার ছাত্রদের বলেছিলেন, “এই রকম হিংসাত্মক কার্যক্রম ও গণহত্যার একমাত্র সমাধান বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং তার জন্য প্রয়ােজন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।” তার ছেলে জিয়াউদ্দীন আহমদ ছিলেন মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্র। জিয়াউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিলে ডা. শামসুদ্দীন শঙ্কিত না হয়ে তার স্ত্রীকে সান্তনা দেন। তিনি তাঁর ছাত্রদেরও মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তা নেই বলে মেডিকেল কলেজের অনেক অধ্যাপক, ছাত্র হােস্টেল ও হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। এ সময় বয়ােকনিষ্ঠ চিকিত্সক, নার্স ও প্যারামেডিকেল কর্মীদের তিনি অনুরােধ করেন আহত ব্যক্তিদের সেবা করতে। যারা চলে যাচ্ছেন তাদের প্রায় সবার হাতে ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম তুলে দিয়ে ডা. শামসুদ্দীন বলেছিলেন, “বাইরে গিয়ে মানবতার সেবা করাে।” তাঁকে অনেকেই বলেছিলেন হাসপাতাল থেকে চলে যেতে। তখন সহকর্মী চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে ডা. শামসুদ্দীন বলেছিলেন, “কোথায় যাবেন আপনারা? আমরা ডাক্তার। আহত মানুষ ফেলে আমরা তাে কোথাও যেতে পারি না।” তিনি আরও বলেছিলেন, “আমরা যদি চলে যাই তবে মুক্তিবাহিনীর লােকদের সাহায্য করবে কারা?”
৮ এপ্রিল ইতালীয় সাংবাদিক ও সাহায্যকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল ভারত থেকে তামাবিল দিয়ে সিলেট শহরে আসে। শামসুদ্দীন আহমেদ তাদের গােটা হাসপাতাল ঘুরিয়ে নিরীহ নাগরিকের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তুলে ধরেন। পাকিস্তানি হানাদারদের ঘৃণ্য আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বক্তব্যও দেন। তাঁর বক্তব্যটি রেকর্ড করা হয় এবং পরে ইতালির গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ডা. শামসুদ্দীন হাসপাতালে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটকে আশ্রয় দেওয়াসহ নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। ৩ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট শহর ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। সিলেট শহর পুনর্দখলের জন্য ঢাকা থেকে অতিরিক্ত সেনা এনে ৭ ও ৮ এপ্রিল বিমান ও সেনাবাহিনী দিয়ে আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী। অবশেষে ৯ এপ্রিল পাকবাহিনী সিলেট শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আর সেদিনই হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকারে পরিণত হন এ মহান চিকিৎসক।
শহর ছেড়ে সবাই যখন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে, ডা. শামসুদ্দীনও নিজের পরিবার-পরিজনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। ছুটি দিয়ে দেন হাসপাতালের মহিলা নার্সদেরও। কিন্তু নিজে একের পর এক আহত মুক্তিযােদ্ধার চিকিৎসা করে গেছেন। তাকে সাহায্য করার জন্য থেকে যান হাতে গােনা কয়েকজন। তিনি গঠন করেছিলেন ব্লাড ব্যাংক ও ইমার্জেন্সি স্কোয়াড়। পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ সব যখন শেষ, তখনও চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ করেননি ডা. শামসুদ্দীন। শহরে তখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। হাসপাতালের দিকে যাওয়ার সময় ডা. শামসুদ্দীনের চাচা মৌলভী মঈনউদ্দিন হােসেন তার হাত ধরে অনুরােধ করেছিলেন হাসপাতালে না যেতে। শান্ত হাসি হেসে তিনি বলেছিলেন, “এখনই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়ােজন। তাছাড়া জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়।”
৯ এপ্রিল ১৯৭১। হাসপাতালের পূর্ব দিকে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে পাকবাহিনীর ক্যাম্প। উত্তর পাশে টিলার উপর সিভিল সার্জনের বাংলা আর টিলার নিচে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা। সকাল ৯টায় মুক্তিবাহিনী সেই বাংলাে ও মাদ্রাসা থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কনভয়ের উপর। এতে একটি জিপ উল্টে যায় এবং তিন পাকসেনা মারা যায়। বেপরােয়া পাকবাহিনী তখন পুরাে এলাকা ঘিরে ফেলে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে মুক্তিযােদ্ধাদের। এদিকে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর ছােড়া গুলিতে সিলেটের শত শত মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে আসে চিকিৎসার জন্য। সেদিন বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত রােগী এসেছিল যাদের অপারেশন করা দরকার। কিন্তু রক্তের অভাবে অপারেশন করতে পারছিলেন না ডা. শামসুদ্দীন। এমন সময় মুক্তিযােদ্ধাদের খােজে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয় মেজর রিয়াজসহ সশস্ত্র কয়েকজন পাকসেনা। মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. শ্যামল কান্তি লালা, ওয়ার্ড বয় মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী, পিয়ন মাে. মহিবুর রহমান, মকলিসুর রহমানসহ সাতজনকে টেনেহিঁচড়ে সীমানা প্রাচীরের কাছে এনে দাঁড় করায়। আন্তর্জাতিক আইনে চিকিৎসক ও নার্স হত্যা অমার্জনীয় অপরাধ । শামসুদ্দীন আহমেদ নিজের পরিচয় দিয়ে পাকসেনাদের বােঝানাের চেষ্টা করেন।
ওই সময় তাঁর এবং তাঁর প্রিয় ছাত্র ডা. শ্যামল কান্তি লালার বাহুতে ছিল রেডক্রস ব্যাজ। ঘাতক সেনারা তাঁদের কোনাে কথাই শােনেনি, রেডক্রসের ব্যাজ দেখেও তাদের রেহাই দেয়নি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিজের ব্যক্তিত্বে তখনাে অনড় ডা. শামসুদ্দীন। নিজের জীবন ভিক্ষা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন অপারেশন থিয়েটারে রেখে আসা মুমূর্ষ রােগীদের অপারেশন শেষ করে আসতে। কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি সেনারা প্রথম গুলি। তাঁকেই করে। প্রথম গুলিটি লেগেছিল তার বাম উরুতে, দ্বিতীয়টি পেটের বাম পাশে। তিনি তখনও দাড়িয়ে। তৃতীয় গুলিটি লাগে তার বুকের বাম পাশে, হৃৎপিণ্ডে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ডা. শামসুদ্দীন। এরপর একে একে হত্যা করা হয় ডা. শ্যামল কান্তিসহ বাকি পাঁচজনকে। শহরে এরপর থেকে টানা কারফিউ। ১৩ এপ্রিল মাত্র এক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলে তার চাচা মঈনউদ্দিন হােসেন এসে ডা. শামসুদ্দীনের পায়ের জুতা দেখে তাকে শনাক্ত করেন। হাসপাতালের ভিতর এক ফুট গর্ত করে দ্রুত তাকে সমাহিত করা হয়। অন্যদের মরদেহও পাশে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ডা. শামসুদ্দীন আহমেদের স্ত্রী হােসনে আরা আহমেদ ছিলেন সিলেট মহিলা কলেজের শিক্ষক। পরে তিনি ওই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই তিনি মারা যান। শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ ও হােসনে আরার দুই ছেলে- সালাহউদ্দীন আহমেদ ও জিয়াউদ্দীন আহমেদ এবং তিন মেয়ে- ফরহাত জামান, রাহাত হােসেইন ও মালেকা আহমদ। ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা, শ্যামল কান্তি লালাসহ সাত শহীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে সিলেটের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর ৯ এপ্রিল বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। সিলেট মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নাম ডা. শামসুদ্দীনের নামে রাখা হয়েছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা