শামশাদ আলী
শামশাদ আলী ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ ভারতের বিহারের এলাহাবাদে নানার বাড়িতে জন্ম নেন। তাদের পৈতৃক বাড়ি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মােজাফফর নগরে। তার বাবার নাম আবুল হােসেন, মায়ের নাম আনওয়ারী বেগম। আবুল হােসেন ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এবং পেশায় চিকিৎসক। ছয় ভাই ও তিন বােনের মধ্যে মাে. শামশাদ আলী ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ডাকনাম ছিল “আচ্ছা সাহেব’। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় প্রতিবাদী স্বভাবের শামশাদ আলীকে সেখানকার পড়াশােনা ছেড়ে চলে আসতে হয়। পরে তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ থেকে আনুমানিক ১৯৬৩ সালে এম. বি. বি. এস. পাস করেন। এরপর তিনি কুমিল্লা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই বছর চাকরি করেন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে মন বসাতে না পেরে তিনি নিজের এলাকায় চলে আসেন এবং স্বাধীনভাবে চিকিৎসা পেশার চর্চা করতে থাকেন।
সঙ্গীতের কোনাে প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও ডা. মাে. শামশাদ চমকার গান গাইতেন। বিশেষত রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল তাঁর খুবই পছন্দের। শামশাদ আলী খেলাধুলা খুব পছন্দ করতেন। ফুটবলের জাদুকর হিসাবে খ্যাত আবদুস সামাদের চেয়ে বয়সে তিনি অনেক ছােট হলেও দুজনের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। পার্বতীপুরের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া সংগঠন ‘প্রগতি সংঘ’ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল। পার্বতীপুর ছিল অবাঙালি অধ্যুষিত। তাঁদের বাড়ির চারপাশেই ছিল অবাঙালিদের বাস। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝতে পেরে তারা সবাই বগুড়ায় চলে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি সেনারা অবাঙালিদের সাথে নিয়ে তাদের বাড়িতে হানা দেয়। শামশাদের তিন ভাই কোনােমতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। হানাদাররা শামশাদ আলী ও তার এক ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। পাকসেনারা তাদের বাড়িতে রাখা সােনাদানা ও নগদ টাকা, ব্যাংকের চেক লুট করে নেয়। ডা. শামশাদের ছােটভাই মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেলে পাক হানাদাররা তাকে ওই অবস্থায় ফেলে যায়।
জানা যায়, ডা. শামশাদকে মির্জা খান নামের একজন অবাঙালি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে একদম কাছে থেকে গুলি করে। ডা, শামশাদ ছিলেন দীর্ঘদেহী এবং বলিষ্ঠ প্রকৃতির। তিনি বন্দুকের নল ধরে ফেলেন এবং কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। কিন্তু কয়েকটি গুলি তার দেহ ভেদ করে গেলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে। পড়েন। তার বিশাল শরীর রেলের ইঞ্জিনে ঢােকানাে সম্ভব হয়নি বলে ঘাতকেরা তার দুই বাহু কাধ থেকে কেটে এবং শরীর কয়েক টুকরাে করে রেল ইঞ্জিনের কয়লার চেম্বারের গনগনে আগুনে ছুড়ে দেয়। তার দেহ সেখানেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মিটফোর্ড মেডিকেলে পড়ার সময় শামশাদ আলী নির্মলা গােমেজ নামের একজন খ্রিস্টান নার্সকে বিয়ে করেন। নির্মলা পরে নাম পাল্টে হন শামসুন্নাহার বেগম। তাদের সংসারে চার ছেলের জন্ম হয়। এলাকাবাসী পার্বতীপুরে নতুন বাজারের সিনেমা হলের সামনের রাস্তাটি শহীদ ডা. মাে. শামশাদ আলীর স্মরণে নামকরণ করেছে। তার পরিবার কোনাে রাষ্ট্রীয় সহযােগিতা পায়নি বলে জানা গেছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা