শহীদুল্লা কায়সার
কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার সােনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্ম নেন। তাদের বাড়িটি সৈয়দ পরিবার’ নামে পরিচিত। এ বাড়িরই সন্তান দুই শহীদ বুদ্ধিজীবী- শহীদুল্লা কায়সার এবং জহির রায়হান। শহীদুল্লা কায়সারের পারিবারিক নাম ছিল ‘আবু নঈম মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ’। আট ভাই-বােনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর বাবার নাম মওলানা মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতার ‘মাদ্রাসা-ই-আলীয়া’ বা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ও ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। সুফিয়া ১৪-১৫ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলনে অংশ নেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বেগম রােকেয়ার সাথে তিনি দেশীয় কাপড় তৈরির কাজ করেছেন। মায়ের কাছেই শহীদুল্লা কায়সারের লেখাপড়ার হাতেখড়ি, মায়ের কাছ থেকেই তিনি দেশপ্রেম ও সমাজ সচেতনতার হাতেখড়ি নেন। শহীদুল্লা কায়সারের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশােনা শুরু হয় মজুপুরের আমিরাবাদ বিদ্যালয়ে। তারপর লেখাপড়া শেখানাের উদ্দেশ্যে বাবা ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে যান। এখানে তাকে প্রথমে ‘সরকারি মডেল স্কুলে এবং পরে আলীয়া মাদ্রাসার অ্যাংলাে পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি করা হয়। তিনি প্রতি বছরই পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে ১৬ বছর বয়সে শহীদুল্লা এন্ট্রান্স পাস করে ভর্তি হন অবিভক্ত বাংলার বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৬ সালে তিনি এই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বি. এ. পাস করেন। এরপর অর্থনীতিতে এম. এ. পড়ার জন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই সময় তিনি ‘রিপন কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশােনা শুরু করেন।
ওই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল মেধাবী ছাত্র গড়ার ও ছাত্র আন্দোলনের পীঠস্থান। এ কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় শহীদুল্লা কায়সার বামপন্থি ছাত্র রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। যুক্ত হন তল্কালীন ছাত্র ফেডারেশনে’। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ সংগঠনের কর্মী ও সংগঠক হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ধীরে ধীরে তিনি তকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে যান। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর তার বাবা ঢাকায় চলে আসেন। ফলে শহীদুল্লা কায়সার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম. এ. শ্রেণিতে | ভর্তি হন। কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ব বাংলার ছাত্রদের সংগঠিত করার দায়িত্ব তাঁর উপর পড়ে। কিন্তু কাজ শুরু করতে না করতেই তাঁকে আত্মগােপনে যেতে হয়। কারণ পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে এবং কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হওয়ার কারণে শহীদুল্লার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হয়। আত্মগােপনে থেকেই তিনি গােপনে গােপনে ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। কিন্তু পলাতক জীবনে থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত শহীদুল্লার পক্ষে আর এম. এ. পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
নিষিদ্ধ ঘােষিত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হওয়ার কারণে ১৯৫২ সালের ৩ জুন তাকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় তাঁর কারাজীবন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরের মধ্যে আট বছরই তাকে কারাগারে আটক রাখা হয়। ১৯৫৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিচালিত ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালের ১৪ অক্টোবর তাঁকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি থাকেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি নিয়ে পূর্ব বাংলায় প্রবল ছাত্র আন্দোলনের ফলে অন্যান্যদের সাথে শহীদুল্লা কায়সারও কারাগার থেকে মুক্তি পান। এ সময় তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যুক্ত হন। কিছুদিনের মধ্যেই ‘সংবাদ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক পদে উন্নীত হন শহীদুল্লা কায়সার। এক সময় তিনি এ পত্রিকার মধ্যমণিতে পরিণত হন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে যান সবার প্রিয় ‘শহীদ ভাই’। আর সে সময় সংবাদ শুধু একটি পত্রিকা ছিল। না, ‘সংবাদ গণতন্ত্রকামী রাজনীতিবিদ ও বামপন্থিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল।
শহীদুল্লা কায়সারের সাংবাদিক জীবনের সমস্ত কৃতিত্ব ও পরিচিতি ‘সংবাদকে কেন্দ্র করে। ওই সময় সংবাদ পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল লেখক-সাংবাদিকবুদ্ধিজীবীদের মুখপত্র হিসাবে ভূমিকা পালন করত। এখানে তিনি প্রবীণ ও খ্যাতনামা সাংবাদিক-সাহিত্যিক জহুর হােসেন চৌধুরী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখের সাহচর্যে আসেন। এসব ব্যক্তিত্বের প্রভাব শহীদুল্লা কায়সারের জীবনে ও রচনায় পড়েছে। সাংবাদিক জীবনে সাংবাদিকদের দাবি-দাওয়া, সুযােগ-সুবিধা এবং অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি একাধিকবার পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ‘সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের নির্দিষ্ট লেখা ছাড়াও তিনি দেশপ্রেমিক’ ও ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে সমকালীন রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতেন। রাজনৈতিক পরিক্রমা” এবং “বিচিত্র-কথা”।
শীর্ষক দুটি কলামে এ পত্রিকায় তিনি লিখতেন। ১৯৫৬ সালে জহির রায়হানের সম্পাদনায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সাপ্তাহিক ‘প্রবাহ’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার সাথে শহীদুল্লা কায়সার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, কোমলপ্রাণ এবং বন্ধুবৎসল। তার চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ ছিল কৌতুকপ্রিয়তা। তিনি ছিলেন ধীর মেজাজের এবং সংকটময় মুহূর্তে ধৈর্য হারাতেন না। সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত তার ‘অনালােকে আলােকস্তম্ভ” বইতে শহীদুল্লা কায়সার সম্পর্কে লিখেছেন : তার প্রাণবন্ত উচ্ছলতা, গভীর মানবিকতা, বন্ধু বাৎসল্য, সহিষ্ণুতা, সহৃদয়তা আর অফুরন্ত কর্মশক্তি মুগ্ধ করেছে। তার মেজাজ শান্ত, যে কোনাে রকম। উত্তাপের মুখেও নরম গলায় আশ্চর্য দৃঢ়তা নিয়েই স্থির বক্তব্য রাখতেন। জেলখানায় থাকা অবস্থায় শহীদুল্লা কায়সার নাটক লিখতে শুরু করেন। চট্টগ্রাম জেলে বসে ১৯৫২ সালে লেখেন নাম নেই এবং ১৯৫৪ সালে ‘যাদু-ই-হালুয়া’। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে শহীদুল্লা কায়সার স্মরণীয় হয়ে আছেন তার দুটি উপন্যাসের কারণে- ‘সংশপ্তক’ ও ‘সারেং বৌ’। ১৯৫৯-‘৬২ সালের মধ্যে রচিত ‘সংশপ্তক’ ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে খ্যাতিমান নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন উপন্যাসটিকে নাট্যরূপ দেন এবং ১৯৭১ সালে একটি ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ শুরু হয়। নাটকটির চারটি পর্ব টেলিভিশনে প্রচারিতও হয়েছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এর নির্মাণ ও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ‘সংশপ্তক’ নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় যা বাংলাদেশে অন্যতম। জনপ্রিয় টিভি নাটক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
‘সংশপ্তক’ শব্দের অর্থ হলাে : ‘মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যে সৈনিক লড়াই করে যায় । এক বিরাট পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাস শহীদুল্লা কায়সারের সবচেয়ে স্বার্থক উপন্যাস, এক অনবদ্য সৃষ্টি- একটি খাটি বাংলাদেশি উপন্যাস। ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময় থেকে শুরু হয়ে উপন্যাসে উঠে এসেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান গঠন এবং ভাষা আন্দোলন। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজের ভাঙা-গড়ার এক নিপুণ চিত্র শহীদুল্লা কায়সার এতে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসের দীর্ঘ আয়তনের মধ্যে অনেক চরিত্রের মাঝে পাঠককে নাড়া দেবে এর নারী চরিত্রগুলাের ওপর পুরুষ শাসিত মুসলিম সমাজের নিপীড়ন এবং নারী চরিত্রগুলাের বিদ্রোহ। উপন্যাসের নায়ক জাহেদ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত টগবগে তরুণ। মানুষকে সে ভালােবাসে। জাহেদ মানবতাবাদী এবং আশাবাদী। উপন্যাসের এক জায়গায় জাহেদ বলছে, “এক ধারায় নয়, বহু ধারায় প্রবাহিত মানুষের জীবন। যদি শুকিয়ে যায়, যদি রুদ্ধ হয় একটি ধারা, আরেক ধারায় জীবন বয়ে চলে সার্থকতার পানে। এটাই জীবনের ধর্ম।” জীবন সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত জাহেদকে যখন পাকিস্তানি পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তখন সে চিল্কার করে ঘােষণা করে- “আমি ফিরে আসব ।”
শহীদুল্লা কায়সারের অপেক্ষাকৃত কম সফল উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ (১৯৬২)। কিন্তু এর জন্যই তিনি বাংলাভাষী পাঠকের কাছে অধিকতর পরিচিত। নারীর ভালােবাসা আর জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রামই এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন, যা বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। তার অন্য উপন্যাসগুলাে হলাে : ‘কৃষ্ণচূড়া মেঘ’ (১৯৫৯), “দিগন্তে ফুলের আগুন’ (১৯৬১), কুসুমের কান্না (১৯৬২), ‘চন্দভানের কন্যা’ (অসম্পূর্ণ)। সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে পেশােয়ার থেকে তাসখন্দ ১৯৬৬ সালে রচিত ও প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘রাজবন্দীর রােজনামচা’ তার একটি বিখ্যাত বই। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত বইটি শহীদুল্লা কায়সারের প্রথম প্রকাশিত বই। বইটির উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছেন, “আট বছরের কারাজীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা দুঃখ বেদনায় যারা ছিল নিত্যদিনের সাথী তাদের হাতে তুলে দিলাম বন্দীজীবনের রােজনামচা।” এই বইটির পেছনে ছিল ছােট ভাই জহির রায়হান এবং কারাজীবনের সাথী সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের অবদান।
তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ অপ্রকাশিত ছিল। শহীদুল্লা কায়সারের শেষ এবং অসমাপ্ত রচনা কবে পােহাবে বিভাবরী’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। কারও কারও মতে, বই আকারে অপ্রকাশিত হলেও ‘কবে পােহাবে বিভাবরী’ তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। কিন্তু এই বইটি পাঠকের হাতে খুব কমই পৌছেছে। এ উপন্যাসটির শুরুর প্রেক্ষাপট ঢাকা শহর। সময়টা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। উপন্যাসের প্রথম শব্দটিই ‘বুম’ যা ২৫ মার্চের কালরাত্রির চিত্রকে মুহুর্তেই উপস্থিত করে পাঠকের সামনে। এ উপন্যাসে শহীদুল্লা কায়সার চরিত্রগুলােকে ক্রমে ক্রমে সাধারণ জীবন থেকে নিয়ে গেছেন যুদ্ধ জীবনে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ধীরে ধীরে যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হতে থাকে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আওয়ামী লীগের পক্ষ ও বিপক্ষ, বামপন্থি ইত্যাদি বিভিন্ন অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার ও বােঝার চেষ্টা উপন্যাসে আছে। এত বড় প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করার চেষ্টা সম্ভবত আর কোনাে সাহিত্যিক করেননি। চার খণ্ডে উপন্যাসটি লেখার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু দুই খণ্ড লেখার পর বইটি অসমাপ্ত থেকে যায়। এটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদুল্লা কায়সার রচনাবলী’র চতুর্থ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ উপন্যাস রচনার পটভূমি সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী পান্না কায়সার লিখেছেন : আমরা কায়েতটুলীর বাড়ি ছেড়ে ঢাকাতেই বিভিন্ন পাড়ায় পালাক্রমে থাকতাম বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়দের বাসায়। তখন একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। লিখতে রাতের বেলায়। মােমের আলােতে। লেখা বন্ধ হলে খাতাটাকে মলাটে পেঁচিয়ে লুকিয়ে রাখতাে। (নিপুণ, ঢাকা : ডিসেম্বর ১৯৮৭)
বাংলা একাডেমি থেকে চার খণ্ডে ‘শহীদুল্লা কায়সার রচনাবলী’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ১৯৯৪ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘শহীদুল্লা কায়সারের নির্বাচিত কলাম : উনসত্তর থেকে একাত্তর’। এ বইতে সংকলিত হয়েছে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত সময়ের সংগ্রামী উত্থান পতন নিয়ে তার লেখা কলামগুলাে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের অনেকে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। আবার অনেকে ঢাকায় বা দেশের মধ্যেই আত্মগােপন করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদাররা ‘সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার পর শহীদুল্লা কায়সারকে যখন সবাই আত্মগােপনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, তিনি তখন ভাবছেন কী করে পত্রিকা প্রকাশ করা যায়। তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। ভারতে। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে পান্না কায়সারের বড় বােন সাহিত্যিক খালেদা এদিব চৌধুরী লিখেছেন : ২৭ মার্চ … শহীদুল্লা কায়সার এলেন। অতিব্যস্ত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। তিনি আমাদের সাবধানে থাকতে উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন : “আমাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে ভালাে করে। অবশ্য ইতােমধ্যে তিনি জগন্নাথ হল, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি এলাকা ঘুরে এসেছেন এবং এ-সব এলাকার ভয়াবহ অবস্থার কথা আমাদের জানালেন। |আমি তখন তাকে বললাম : “আপনি পালিয়ে যান কোথাও।” তিনি জবাব দিলেন, “সব কিছু আমাকে দেখতে হবে; সবাই মিলে পালালে ইতিহাস লিখবে কে? দেখা যাক না- কি কি হয়। (মুহম্মদ আব্দুর রাজ্জাক সম্পাদিত, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে, ঢাকা : ১৯৭৩)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে অনেকেই কবি সুফিয়া কামালের কাছে রেশনকার্ড রেখে যান। কবি সুফিয়া কামাল সেইসব রেশনকার্ড দিয়ে চাল, ডাল, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় অনেক জিনিস তুলে এনে বাসায় জড়াে করতেন। শহীদুল্লা কায়সার সেসব জিনিস মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পৌছে দিতেন। দিনের বেলা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা ও ওষুধ সংগ্রহ করে রাতে তা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দিতেন। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন ঢাকার বাইরে। চলে যাওয়ার। তার জন্য সাভারে একটি বাড়িও ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। যদিও এ সময় তিনি নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পরিচিতদের সবাইকে নিরাপদে থাকতে এবং সম্ভব হলে ঢাকার বাইরে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, সন্ধ্যা বেলা। পুরান ঢাকার কায়েতটুলীর বাসায় শহীদুল্লা কায়সার মােমবাতি জ্বালিয়ে রেডিওতে বি. বি. সি. শােনার জন্য বসেছেন। স্ত্রী পান্না কায়সার মেঝেতে বসে মেয়ে শমীকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার সময় ঠক ঠক করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শােনা গেল। ছােট ভাই ওবায়দুল্লাহ নিচ থেকে এসে জানতে চাইলেন, দরজা খুলবেন কিনা। শহীদুল্লা কায়সার ভেবেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধারা এসেছে। তাই তিনি দরজা খুলে দিতে বললেন। নিজে গেলেন গায়ের চাদর খুলে গরম জামা গায়ে দিতে। এমন সময় ঘরে ঢুকে পড়ে ঘাতকের দল। কালাে কাপড়ে মুখ ঢাকা তিন-চার জন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে, “শহীদুল্লা কায়সার কে?” তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আমিই শহীদুল্লা কায়সার।” সঙ্গে সঙ্গে লােকগুলাে তাঁর হাত ধরে টানতে টানতে তাঁকে নিয়ে যেতে শুরু করে। তাঁর স্ত্রী ও বােন চিকার করে বাধা দিতে গেলে লােকগুলাে বন্দুক উঁচিয়ে ধরে। তারপরও তার বােন বন্দুক ধরে টানাটানি করেছে। কিন্তু তাকে ধরে রাখা যায়নি। কারফিউয়ের অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও শহীদুল্লা কায়সারের আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। উল্টো তার খোঁজ নিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলেন ছােট ভাই জহির রায়হান।
১৯৫৮ সালে শহীদুল্লা কায়সারের সাথে বিয়ে হয় কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য জোহরা বেগমের। জোহরা ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মন্ত্রী আবু আহমদের মেয়ে। রাজনীতি করতে গিয়ে তাদের পরিচয়, ভালােবাসা এবং বিয়ে। কিন্তু তাদের দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর শহীদুল্লা কায়সারকে ১৪ অক্টোবর মধ্যরাতে গ্রেফতার করা হয়। স্বামীর মুক্তি অনিশ্চিত জেনে জোহরা কলকাতায় ফিরে যান। ১৯৬১ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শহীদুল্লা কায়সার পান্না চৌধুরীকে (পান্না কায়সার) বিয়ে করেন। তাদের প্রায় তিন বছরের সংসার জীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম হয় । মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সার ও ছেলে অমিতাভ কায়সার। পারিবারিক উদ্যোগে মজুপুর গ্রামে শহীদ ভাইদের বাড়িতে কায়সার-রায়হান স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের ভাই সাইফুল্লাহ ঢাকা থেকে এসে এর তত্ত্বাবধান করেন। তবে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত সরকার কোনাে উদ্যোগ নেয়নি। কোনাে জাতীয় দিবসেও এলাকায় এই দুই শহীদকে নিয়ে অনুষ্ঠান। হয় না বলে জানা গেছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা