You dont have javascript enabled! Please enable it!
শহীদ সাবের
শহীদ সাবের নামে যিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন, বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন এ. কে. এম. শহীদুল্লাহ। তার জন্ম ১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর, কক্সবাজার জেলার ঈদগাহ গ্রামে নানার বাড়িতে। সাবেরের বাবার নাম সালামতউল্লাহ এবং মায়ের নাম শফিকা খাতুন। ঈদগাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাবেরের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সাবের যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র, তখন তার বাবা কাজের সুবাদে কলকাতায় চলে যান। সাবেরকেও কলকাতায় যেতে হয়। তিনি সেখানকার বিখ্যাত হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কলকাতা হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সাথে যুক্ত হন। পার্ক সার্কাস এলাকায় যার ‘ছােটদের আসর এবং কিশাের সংঘ’ নামে দুটি সংগঠনের সাথে সাবের যুক্ত হন। কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস রােডে “ছােটদের আসর’ সংগঠনের একটি গ্রন্থাগার ছিল, এর গ্রন্থাগারিক ছিলেন শহীদ সাবের। কিশাের সংঘ’ ছেলেমেয়েদের বিতর্কসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনার আয়ােজন করত। সাবের উৎসাহের সাথে তাতে অংশ নিতেন। এ সংঘ ‘ছন্দশিখা’ নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করত। ‘ছন্দশিখা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন। সাবেরের সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে ছন্দশিখা’ পত্রিকার ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। ছন্দশিখার কয়েকটি সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন সাবের। এই সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই কিশাের সাবেরের মানস গড়ে উঠতে থাকে।
এ সময় আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত শহীদ সাবেরের লেখা ‘বিষকন্যা’ অনেকেরই দৃষ্টি কাড়ে। এই পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখতেন জহুরি সম্পাদক কবি আহসান হাবীব। আহসান হাবীবের সম্পাদনা উত্তীর্ণ হয়ে কোনাে লেখা প্রকাশ পাওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। সাবের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “অমন সপ্রতিভ ছেলে আমার চোখে পড়েনি। বয়সের তুলনায় তার মানসিক পরিপকৃতা ছিল অনেক বেশি।”  ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সাবের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর আই, এ. ক্লাসে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় তিনি মুকুল ফৌজ” আন্দোলনে শরিক হন। এ সময় তিনি সংগঠনের কাগজ ‘মুকুল’ পত্রিকায় লিখতেন এবং পত্রিকা বিক্রির কাজও করতেন। নন্দনকাননের ‘উদয়ন’ পত্রিকায়ও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের আই. এ. প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে সাবের পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যােগ দেন। 
পাকিস্তানি শাসকদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে চট্টগ্রামের যতীন্দ্র মােহন সেন (জে. এম. সেন) হলের এক অনুষ্ঠানে ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীসহ অন্য অনেকের সাথে মুসলিম লীগের গুন্ডাদের আক্রমণের শিকার হন সাবের। মুসলিম লীগ সরকার বামপন্থি নেতা-কর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার শুরু করলে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনিও গ্রেফতার হন। ১৯৫১ সালে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আই. এ. পাস করেন। মুসলিম লীগ সরকারের পতন হলে চার বছর কারাবন্দি থাকার পর ১৯৫৪ সালে সাবের মুক্তি পান। রাজপথে আন্দোলনে শরিক হতে না পারলেও ঢাকা জেলে থাকা অবস্থায় প্রগতিশীল নেতারা ভাষা আন্দোলন বিষয়ে যেসব বৈঠক করেন, তাতে সাবের উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।
শহীদ সাবের ১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেন। এরপর কিছুদিন তিনি ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসাবে চাকরি করেন। পরে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদে যােগ দেন। এ সময় তিনি ফেডারেল ইনফরমেশন সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু রাজনৈতিক মামলা থাকার কারণে তাঁকে নিয়ােগ দেওয়া হয়নি। _ কারাবন্দি থাকা অবস্থাতেই প্রকাশিত হয় শহীদ সাবেরের বিখ্যাত রচনা ‘আরেক দুনিয়া। এ লেখাটি তিনি শুরু করেছিলেন চট্টগ্রাম জেলে বসে, শেষ করেন রাজশাহী জেলে। নিরাপত্তা বন্দি’ বলে স্বনামে লেখা ছাপানাে সম্ভব ছিল না। তাই ‘জামিল হােসেন’ ছদ্মনামে গােপনে রাজশাহী জেল হয়ে কলকাতার অনিল সিংহ সম্পাদিত ওই সময়ের নামকরা নতুন সাহিত্য পত্রিকার চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশ করা। হয়। লেখাটি কলকাতার পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়। এরপর থেকেই কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবেরের যাত্রা শুরু হয়। কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখে নতুন এই সাহিত্য প্রতিভাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আরেক দুনিয়া’ ১৯৫১ সালে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়। 
চট্টগ্রামে থাকার সময় তারই বন্ধু মাহবুব উল আলম চৌধুরী সম্পাদিত ‘সীমান্ত পত্রিকায় তিনি “শহীদুল্লাহ সাবের” নামে কয়েকটি লেখা লিখেছেন। পরে তিনি ‘শহীদ সাবের’ নামে স্থিত হন। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় গল্প সংকলন ‘এক টুকরাে মেঘ’ (১৯৫৫) এবং শিশু সাহিত্য ‘ক্ষুদে গােয়েন্দার অভিযান (১৯৫৮)। এছাড়া তিনি বেশ কিছু বই অনুবাদ করেছেন। সেগুলাে হলাে : ‘ইসকাপনের বিবি’ (আলেকজান্দার পুশকিন), ‘পাগলের ডায়েরি (লিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গােগল) এবং কালাে মেয়ের স্বপ্ন (ক্যাথরিন ওয়েন্স পিয়ার)। সাবের বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু সেগুলাে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটি জেলের বাইরে প্রথম মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেন। শহীদ সাবের। এ নাটকটি তখনও বই আকারে বের হয়নি। জেলখানা থেকে মুনীর চৌধুরীর হাতে লেখা একটি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন সাবের। আর তার উদ্যোগেই ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম শহরের জে, এম. সেন হলে মঞ্চায়িত হয় এ নাটক। পাকিস্তান আমলে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এ. জে. কারদারের পরিচালনায় নির্মিত ‘জাগাে হুয়া সাবেরা’ সিনেমার একজন সহকারী চিত্র পরিচালক ছিলেন শহীদ সাবের। ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে শহীদ সাবেরের মানসিক বৈকল্য ঘটে। তিনি আর। সুস্থ হননি। শহীদ সাবের থাকতেন ‘দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অফিস ভবনে। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তান সেনারা সংবাদ অফিস পুড়িয়ে দিলে আগুনে পুড়ে শহীদ সাবেরের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালে শহীদ সাবেরের স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে কক্সবাজারের। ‘ঈদগাহ জাহানারা ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘শহীদ সাবের পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলা একাডেমি থেকে সেলিনা হােসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘শহীদ সাবের রচনাবলী’, যা এখন আর পাওয়া যায় না।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!