You dont have javascript enabled! Please enable it! লুৎফুন নাহার হেলেন - সংগ্রামের নোটবুক
লুৎফুন নাহার হেলেন
লুৎফুন নাহার হেলেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মাগুরা শহরে। তার বাবার নাম ফজলুল হক, মায়ের নাম সফুরা খাতুন। ফজলুল হক ন্যাপ এবং কৃষক সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের পরিবারটি ছিল মাগুরা শহরের অন্যতম শিক্ষিত ও প্রগতিশীল পরিবার। হেলেনের বড় ভাইয়ের নাম মাহফুজুল হক নিরাে, যিনি মাগুরাতে ‘নিরাে প্রফেসর হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও নয় বােন। বােনদের মধ্যে হেলেন ছিলেন ষষ্ঠ।। ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছিলেন হেলেন। পঞ্চম শ্রেণিতে তিনি বৃত্তি পেয়েছিলেন। হেলেন ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৬৩ সালে। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজের আই, এ ক্লাসে। কিন্তু এখানে তার মন বসেনি। আট মাস ঢাকায় কাটানাের পর তিনি মাগুরা ফিরে যান, ভর্তি হন মাগুরা সরকারি কলেজে। এ কলেজ থেকে তিনি আই. এ. পাস করেন। হেলেন ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. পাস করেন। এরপর তিনি মাগুরা গার্লস হাই স্কুলে (বর্তমানে সরকারি গার্লস হাই স্কুল) সহকারী শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি | মাগুরার বাম রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
বড় ভাই মাহফুজুল হকের মাধ্যমে স্কুলজীবন থেকেই হেলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারবিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ফেস্টুন হাতে মিছিলের প্রথম সারিতে স্লোগান দিতেন। পরে তিনি মাগুরা মহকুমা শাখার সভানেত্রী, মাগুরা কলেজের মহিলা শাখার সম্পাদক ও মাগুরা কলেজের ছাত্রী সংসদের মহিলা কমনরুম সম্পাদিকা ছিলেন। হেলেন বিশ্বাস করতেন সাম্যবাদী ভাবাদর্শে, একটা শােষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন। ছােটবেলা থেকেই তিনি জেদি প্রকৃতির ছিলেন। পড়াশােনা করে অনেক বিখ্যাত হবেন- এই ছিল তার ইচ্ছে। আশেপাশের যে কারও বিপদে-আপদে ছুটে যেতেন বলে অনেকের কাছে হেলেন ছিলেন খুবই নির্ভরশীল মানুষ। শুধু নিজে পড়াশােনা করে আলােকিত হবেন না, অন্যকেও শিক্ষার আলােয় আলােকিত করতে হবে- এই ব্রত নিয়েই তিনি গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েকে অক্ষরজ্ঞান দিয়েছেন।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে হেলেন তাঁর। ডায়েরিতে লিখেছিলেন : সরকারের এক বিশেষ নির্দেশে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। বাঙালির ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার জন্য আবার সরকারি মহল তৎপর হয়ে উঠেছে। এদের এই ধরনের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় একুশে। ফেব্রুয়ারির ঘটনাপঞ্জীকে। … আজ এরা রবীন্দ্র সঙ্গীত বাদ দিচ্ছে, কাল এরা বলবে রবীন্দ্র সাহিত্যই মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকূলে নয়। এদের এই বহুল ব্যবহৃত ‘মুসলিম ঐতিহ্যের’ (?) দোহাই দিয়ে এরা আরও কত কী যে করবে । হঠাৎ স্বাধীনতা লাভের ২০ বছর পর মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ ভারতের কবি।… রবীন্দ্রনাথ তাে শুধু পশ্চিম বাংলার কবি নন। তিনি বাঙালির কবি।… তিনি বিশ্বকবি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাগুরা শহর থেকে পাকিস্তানি  সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগীদের কাজের খবরাখবর জেনে মুক্তিযােদ্ধা স্বামীর কাছে পাঠাতেন হেলেন। ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট, পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর চক্রসহ ফজলুল হকের বাড়ি ঘেরাও করে। হেলেনের বড় ভাই মাহফুজুল হক ও তাঁর অন্য ভাইদের হত্যা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্যে। সেদিন তারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। হেলেনের ভাইদের ধরতে না পেরে টহল দিতে এসে একদিন কয়েকজন রাজাকার বৃদ্ধ ফজলুল হককে ধরে নিয়ে যায় চোখ বেঁধে। পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা তাকে ছেড়ে দেয়। হেলেনের ছােট ভাই জাহাঙ্গীর কবির দাদুকেও একদিন রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় এবং তার ওপর।
নির্যাতন চালায়। তার দুহাত পিছমােড়া করে বেঁধে মাগুরা ডাকবাংলাের চার দেয়ালের মধ্যে ফেলে রাখে। এমন বিপজ্জনক পরিবেশের কারণে হেলেনের অন্য বােনেরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তখন ঢাকায় চলে আসে। কিন্তু এ রকম বিপদের মধ্যেও হেলেন মাগুরা শহরে কাটিয়েছেন তাঁর দুই বছরের শিশু ছেলে দিলীরকে নিয়ে।
সেপ্টেম্বরে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করার জন্য মাগুরার মহম্মদপুর এলাকায় যান। সেখানে নারীদের, বিশেষত ভূমিহীন গরিব কৃষক পরিবারের নারীদের তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেন। পাশাপাশি স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের খাওয়াদাওয়া, দেখাশােনা ও অসুস্থদের সেবা ও সাহায্য-সহযােগিতা করতেন হেলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে রাজাকাররা হেলেনকে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার এক গ্রাম থেকে ছেলে দিলীরসহ আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে তুলে দেয়। একাত্তরের ৫ অক্টোবর, পাকিস্তানি সেনারা নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে লুৎফুন নাহার হেলেনকে। এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর স্বামী আলী কদরের রচনায়। তিনি লিখেছেন : হেলেনের মৃত্যুঘটনা ছিল করুণ ও মর্মান্তিক। … মহম্মদপুর থানার এক গ্রামে অবস্থানকালে রাজাকার ও ঘাতক দালালদের গুপ্তচরের সহায়তায় হেলেন ২ বছর ৫ মাস বয়স্ক শিশু পুত্র দিলীরসহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তাকে তারা সরাসরি নিয়ে আসে মাগুরা শহরে। এরপর পাকিস্তান বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাকে সােপর্দ করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। হেলেনের এই দুঃসংবাদে তার বৃদ্ধ পিতা ও কতিপয় আত্মীয়স্বজন দুগ্ধপােষ্য শিশুর মাতা হেলেনের মুক্তির জন্য শত অনুরােধ সত্ত্বেও জামাতপন্থি ঘাতক দালালরা তার মুক্তির ব্যাপারে সব চাইতে বেশি বাধা সৃষ্টি করে। আলােচনায় পাকবাহিনী কর্মকর্তাকে জানায় যে, হেলেন মাগুরার বামপন্থি নেতা মাহফুজুল হক সাহেবের বােন এবং মহম্মদপুর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের বাহিনী প্রধান বামপন্থি নেতা আলী কদরের স্ত্রী। সুতরাং তার মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না।
 হেলেনের মৃত্যু হয় ১৯৭১ সালের ৫ অক্টোবর রাত্রিবেলায়। ওই রাত ছিল সকল মুসলমানদের এক পবিত্র রাত শব-ই-বরাত। ওই রাতেই তারা হেলেনের শিশু পুত্র দিলীরের করুণ-কান্নাকে উপেক্ষা করে তাকে মায়ের কোল । থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাঠিয়ে দেয় নানা বাড়িতে। তারপর অমানবিক নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে হেলেনকে। (স্মৃতি : ১৯৭১, অষ্টম খণ্ড) পাকবাহিনী এবং রাজাকার চক্র এরপর আরও নির্মমতার পরিচয় দেয়। হত্যার পর রাজাকাররা হেলেনের মৃতদেহ পাকসেনাদের জিপের পেছনে বেঁধে শহর দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। বহু মানুষ এ দৃশ্য দেখতে পায়। এভাবে টানতে টানতে বীরকন্যা হেলেনের ছিন্ন ভিন্ন দেহটি খুনিরা মাগুরার নবগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। তার মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনের স্বামীর নাম আলী কদর, তাদের একমাত্র ছেলের নাম লুৎফে আলী দিলীর।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা