You dont have javascript enabled! Please enable it! রাখাল চন্দ্র দাস - সংগ্রামের নোটবুক
রাখাল চন্দ্র দাস
রাখাল চন্দ্র দাসের জন্ম ১৯৩২ সালের ১ জুলাই, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ধানীখােলা মধ্যভাটিপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম গুরুদয়াল দাস এবং মায়ের নাম অনন্তময়ী দাস। দুই বােনের পর তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান। রাখাল চন্দ্র গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। এরপর ১৯৪৯ সালে দরিরামপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ময়মনসিংহের আনন্দ মােহন কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আই, এসসি. পাস করেন। তিনি ময়মনসিংহের লিটন মেডিকেল স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে এল, এম. এফ. এবং ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এম. বি. বি. এস. ডিগ্রি নেন। এল, এম, এফ, ডিগ্রি পাওয়ার পর রাখাল চন্দ্র ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহের মহারাজ সূর্যকান্ত হাসপাতালে সহকারী সার্জন হিসাবে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৬ সাল। পর্যন্ত তিনি এ হাসপাতালে কাজ করেন। এরপর তিনি সিলেট জেলার কুলাউড়া থানার দিলদারপুর চা বাগান হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার (১৯৫৭-১৯৫৯), এবং ময়মনসিংহের ত্রিশালে ধানীখােলা দাতব্য হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার (১৯৫৯ ,১৯৬৬) পদে কাজ করেন। ১৯৬৮ সালে এম. বি. বি. এস. ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি ধানীখােলা বাজারে ‘গুরুদয়াল ফার্মেসি’ নামে একটি ওষুধের দোকান খােলেন এবং ওই ফার্মেসি সংলগ্ন চেম্বারে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু রাখাল চন্দ্র অর্থ উপার্জনের দিকে মােটেই মনােযােগী ছিলেন না। এলাকার গরিব রােগীদের বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা সেবা এবং বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার ফলে অচিরেই তিনি ব্যবসায়ে লােকসান দিতে থাকেন। একসময় তার ব্যবসায়ের পুঁজি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে তিনি বাধ্য হয়ে ফার্মেসি বন্ধ করে দেন এবং ১৯৬৯ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে মির্জাপুর ইস্পাহানী চা বাগান হাসপাতালে মেডিকেল অফিসারের চাকরি নেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু করার পর পাকসেনারা সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা এপ্রিল মাসে শ্রীমঙ্গলে ঘাঁটি স্থাপন করে হত্যা-নির্যাতন শুরু করে। চা বাগানের শ্রমিকরা পাশের গ্রামের মানুষের সাহায্যে প্রতিরােধ গড়ে তুলে চা বাগান এলাকায় পাকবাহিনীর প্রবেশে বাধা দেয়। তারা বড় বড় পাথর ফেলে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে এবং রাস্তার সংযােগ সেতু ও কালভার্ট ভেঙে দেয়। গাছপালা ও ঝােপের আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে তাঁরা চা বাগান এলাকায় পাকবাহিনীর গতি ঠেকিয়ে দেয়। এই সংঘর্ষে প্রায় প্রতিদিনই কিছু কিছু মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসতে থাকে। রাখাল চন্দ্র দাস আহতদের চিকিত্সার জন্য চিকিৎসকদের একটি বিশেষ টিম গঠন করেন। ১৯৭১ সালের ১২ মে সকালবেলা পাকবাহিনী অতর্কিতে চা বাগান এলাকায় ঢুকে পড়ে। পাকবাহিনী হাসপাতাল ঘেরাও করে। একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল সেনা হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তারদের কেবিন তছনছ করে। পাকবাহিনী চিকিৎসায় নিয়ােজিত রাখাল চন্দ্র দাসকে ধরে নিয়ে যায়। জানা যায়, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পাকবাহিনীর কাছে বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা পেশ করে, তাতে রাখাল চন্দ্র দাসের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর তার আর কোনাে সন্ধান পাওয়া যায়নি।  রাখাল চন্দ্র দাস ছিলেন একজন সংস্কৃতিসেবী, নামকরা ক্রীড়াবিদ, নাট্যাভিনেতা এবং লেখক। বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে তাঁর বেশ কিছু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন রেডক্রস সােসাইটি, স্কাউটস অ্যাসােসিয়েশন ও লায়ন্স ক্লাবের সদস্য। রাখাল চন্দ্র তার আত্মজীবনী লিখে গেছেন। তিনি তাঁর নিজ এলাকায় কয়েকটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তােলেন। এদের মধ্যে রয়েছে ‘ধানীখােলা মুকুল সমিতি’ এবং ‘ধানীখােলা মিলন সমাজ। তিনি ‘ধানীখােলা মিলন সমাজের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্র দাসের স্ত্রীর নাম লাবণ্য প্রভা দাস। তাদের সংসারে দুই মেয়ে ও তিন ছেলে ছিল।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা