You dont have javascript enabled! Please enable it!
রফিকুল হায়দার চৌধুরী
রফিকুল হায়দার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্গত শ্রীনগর উপজেলার সােনাকান্দা গ্রামে। তার ডাকনাম ঈষিকা। রফিকুল হায়দার ১৯৪৯ সালে মুন্সিগঞ্জের জে. সি. বােস ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৩ সালে তিনি দার্জিলিং থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন।  রফিকুল হায়দার কর্মজীবনে ছিলেন একটি জীবনবীমা কোম্পানির কর্মকর্তা। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন কথাসাহিত্যিক। বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন রফিকুল। তবে কিছু কবিতাও লিখেছিলেন তিনি যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত রম্যরচনা ‘স্মৃতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এরপর সম্ভাবনা ও ‘পুরান প্রেমের ইতিকথা’ নামে তাঁর দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ‘জার্নাল’ নামে আরও একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করেছিলেন রফিকুল। উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার স্ত্রী হাসিনা চৌধুরীর রচনা থেকে জানা যায়, রফিকুল হায়দার চৌধুরী কিছুটা উদাসীন ও খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন। সাধারণভাবে সংসারী বলতে যা বােঝায়, তা তিনি ছিলেন না। তবে পড়াশােনায় ছিল তার ব্যাপক আগ্রহ। রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও তিনি রাজনীতিসচেতন ছিলেন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরােক্ষভাবে তাতে সহায়তা করেছেন।  রফিকুল হায়দার চৌধুরী বাস করতেন ঢাকার শহীদবাগে। একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় রফিকুল হায়দারকে তার শহীদবাগের ভাড়া বাসা থেকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর মরদেহও পাওয়া যায়নি। ১২ ডিসেম্বর রাতে রফিকুল তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, আর তিন থেকে চারটা দিন কষ্ট করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তার স্বপ্নের সেই স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তার স্ত্রী হাসিনা চৌধুরীর ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন :  হারিয়ে যাওয়ার ১০ ঘন্টা আগেও যে মানুষটি দেখিয়েছিলেন কত সুখের স্বপ্ন, শুনিয়েছিলেন আশার বাণী। বলেছিলেন, আর তিন থেকে চারটা দিন কষ্ট করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। কথাগুলাে বলেছিলেন ১২ ডিসেম্বর রাত ৯টায়। এর মাত্র। ১০ ঘণ্টা পর এল সেই অশুভ তারিখ ১৩ ডিসেম্বর। আমরা তখন থাকতাম ৯২১ শহীদবাগের বাড়ির দোতলায়। বাড়ির মালিক। আজিজুল্লাহ সাহেব থাকতেন তিনতলায়। আর নিচতলায় যিনি বাস করতেন, তিনি একটি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। পরে জেনেছি, তিনি জামায়াতের রমনা শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর, সকাল ৭টা। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে আছি দুই মাসের ছেলেটিকে কোলে নিয়ে। আমার স্বামীও উঠে চেয়ারে বসেছে। এমন সময় বাসার কলবেল বাজতে শুরু করল। সামনে মেয়ে। দাড়িয়ে। ওকে ওর বাবা বলল, “দেখাে তাে কে এসেছে।” মেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলেই দেখে চারজন খাকি পােশাকধারী, মুখে সাদা রুমাল বাধা, হাতে রাইফেল। মেয়েকে তারা জিজ্ঞাসা করছে, “তােমার বাবা কোথায়?”
ও ভয়ে দৌড়ে এসে জানাল, “পাপ্পা, চারজন পুলিশ। এর মধ্যে ওরা সবাই আমাদের শােবার ঘরে ঢুকে পড়েছে এবং রাইফেল তাক করে উর্দুতে বলল, “বাত মাত বলিয়ে, গােলি মার দেঙ্গে।” আর আমার স্বামীকে বলল, “হ্যান্ডস আপ, আপকা নাম?” সে নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। মেয়ে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আমি নির্বাক হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম, কিন্তু ততক্ষণে ওরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেছে গেটের কাছে। আমি বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি, ওরা রুমাল দিয়ে ওর হাত পেছনে বাঁধছে। তখনও সারা শহরে কারফিউ চলছে। এরপর আর কোনাে কিছুই আমার স্মরণ নেই। হারানাে জ্ঞান যখন ফিরে পেলাম, জানলাম আমার সব শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা আমার সাজানাে সংসারটা কেড়ে নিয়েছে। হারিয়ে গেল সে আমার জীবন থেকে। হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য, কোনাে দিন আর এল না ফিরে । (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) শহীদ রফিকুল হায়দার চৌধুরী এক মেয়ে ও ছেলের বাবা ছিলেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!