রণদাপ্রসাদ সাহা
রণদাপ্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ৯ নভেম্বর ঢাকার সাভারের কাছে শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাছৈড় গ্রামে, তাঁর নানাবাড়িতে। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ পােদ্দার ও মায়ের নাম কুমুদিনী দেবী। তিন ভাই ও এক বােনের মধ্যে রণদা ছিলেন দ্বিতীয়। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামের অধিবাসী। তার নির্দিষ্ট কোনাে পেশা ছিল না। তিনি দলিল লেখক হিসাবে কাজ করতেন, কখনও কখনও তিনি লগ্নি ব্যবসাও করতেন। অভাব ছিল তাঁদের সংসারে নিত্যসঙ্গী। রণদার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হন। সে সময় গ্রামের হিন্দু সমাজে অশৌচের অজুহাতে সেবাযত্ন ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়া ছিল নারীদের নিয়তি। মাকে সেভাবেই, প্রায় বিনাচিকিৎসায় মারা যেতে দেখেছেন সাত বছরের শিশু রণদাপ্রসাদ। এ ঘটনা রণদার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। এরপর তার বাবা পুনরায় বিয়ে করেন। সম্মায়ের আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্টে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে রণদার শৈশব কেটেছে। রণদা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত মির্জাপুর বিদ্যালয়ে পড়াশােনা করেন। এরপর তাঁর পড়শােনা বন্ধ হয়ে যায়। তার বাবা তাকে মামাবাড়ি সাভারের শিমুলিয়ায় পাঠিয়ে দেন। আর তাঁর ছােট ভাই ফণিকে টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়িতে পুষ্যি দেওয়া হয়েছিল। মামাবাড়িতেও আর মন বসেনি রণদার। চৌদ্দ বছর বয়সী কিশাের রণদা সেখান থেকে পালিয়ে চলে যান কলকাতায়। দুমুঠো ভাতের জন্য কুলিগিরি, রিকশা চালানাে, ফেরি করা, খবরের কাগজ বিক্রির মতাে বিচিত্র কাজ করেছেন রণদা। বঙ্গভঙ্গবিরােধী স্বদেশী আন্দোলনে তখন উত্তাল কলকাতা। কিশাের রণদা জড়িয়ে পড়েন স্বদেশী আন্দোলনের সাথে।
এজন্য তাকে পুলিশের নির্যাতন ভােগ করতে হয়, জেলও খাটতে হয়। ১৯১৪ সালে সারা বিশ্বে মহাযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। রণদাপ্রসাদ সাহা বাঙালিদের প্রথম সামরিক ইউনিট বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে যােগ দেন। তিনি ১৯১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে আলিপুর সেনানিবাসে ১৬ রাজপুত রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯১৫ সালের ২৬ জুন তাদের বাহিনী ইরাকের মেসােপটেমিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে মুম্বাই ও বসরা হয়ে ১৫ জুলাই ইরাকের আমারা শহরে পেীছে। সেখানে তারা বেঙ্গল স্টেশনারি হসপিটাল চালু করেন। ১৯১৬ সালের ২৯ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে তুর্কি বাহিনীর যুদ্ধ হয় এবং ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়ে তুর্কিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অন্যদের সাথে রণদাপ্রসাদকেও যুদ্ধবন্দি হিসাবে বাগদাদ নিয়ে যাওয়া হয়। রণদা যখন অন্যদের সাথে বাগদাদে বন্দি, তখন একদিন হঠাৎ সামরিক হাসপাতালে আগুন লেগে যায়। রণদা জ্বলতে থাকা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে একজন রােগীকে উদ্ধার করে বেরিয়ে আসেন। তাকে উদ্ধার কাজে নামতে দেখে আরও কয়েকজন উদ্ধারে যােগ দেয়। শেষ রােগীটিকে বের করে এনে রণদা অজ্ঞান হয়ে যান। এরকম আরও কিছু সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন রণদাপ্রসাদ।
১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে যুদ্ধবন্দি বিনিময়ের সুবাদে ২৬ সেপ্টেম্বর রণদাপ্রসাদ সাহা কলকাতায় ফেরত আসেন। কলকাতায় এসে রণদা ১৯১৬ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নবগঠিত ‘বাঙালি পল্টনে যােগ দেন। একই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি ল্যান্স নায়েক হিসাবে পদোন্নতি পান ও ১৯১৭ সালের ২৫ আগস্ট জমাদার পদে উন্নীত হন। রণদা ভারতের পুনায় অবস্থিত সেন্ট্রাল ফিজিক্যাল ট্রেনিং ও বেয়ােনেট ফাইটিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং ১৯১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানের করাচি ডিপােতে প্রশিক্ষক হিসাবে বদলি হন। ১৯১৮ সালের শুরু দিকে দুমাসের জন্য বাংলাদেশে এসে নতুন সৈনিক ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করেন রণদা। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সামরিক কসরৎ প্রদর্শন আর বক্তৃতার মাধ্যমে বাঙালি তরুণদের পল্টনে যােগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বরে প্রথম মহাযুদ্ধের ‘যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হয়। যুদ্ধবিরতির পর ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯১৯ সালের ২৯ জুলাইকে ‘শান্তি দিবস ঘােষণা করেন। একই তারিখে ইংল্যান্ডে ভিক্টরি মার্চ’ ও ‘পিস সেলিব্রেশনের আয়ােজন করা হয়। ইংল্যান্ডের রাজার পক্ষ থেকে বাঙালি পল্টনের তিনজন প্রতিনিধিকে পিস সেলিব্রেশনে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল যার একজন ছিলেন রণদাপ্রসাদ সাহা। ১৯২০ সালের ১৫ অক্টোবর বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে রণদা কলকাতায় ফিরে আসেন।
সৈনিক জীবনে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় রণদার। বেঙ্গল রেজিমেন্টে ভর্তি হয়ে রণদা যখন ইরাক যান তখন তার সাথে দেখা হয় লম্বা চুল, বড় বড় চোখের প্রাণবন্ত এক যুবকের। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। রণদা তখন অস্থায়ী সুবাদার মেজর, সবাই তাকে ভয় পায়। তরুণ নজরুল কিন্তু সামরিক রেওয়াজের তােয়াক্কা। করতেন না।
রণদা তাকে একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাজী, তুমি গান গাও?” “আজ্ঞে, অল্পবিস্তর চিৎকার করি বটে।” “কবিতা লেখ?” “লােকে তেমন দুর্নামও করে।” রণদাপ্রসাদ সাহা এরপর কাজী নজরুল ইসলামকে সঙ্গীত বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল্লও এতে খুব খুশি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রণদাপ্রসাদ যখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত, হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন মির্জাপুরে, তখন কাজী নজরুল পশ্চিমবঙ্গে। নজরুলের অসুস্থতার খবর পেয়ে রণদা তাকে বাংলাদেশে এনে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু নানা কারণে তার পক্ষে ভারত থেকে নজরুলকে নিয়ে আসা। সম্ভব হয়নি। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা ভারতীয়দের সবাইকে ব্রিটিশ সরকার যােগ্যতা অনুসারে চাকরি দিয়েছিল। লেখাপড়া সামান্য হলেও যুদ্ধে অবদানের কথা বিবেচনা করে রেলওয়ের কালেক্টরেটের চাকরি দেওয়া হয়েছিল রণদাপ্রসাদকে, কর্মস্থল ছিল সিরাজগঞ্জ থেকে শিলাইদহ। ১৯৩২ সালে এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তিনি এ চাকরিতে ইস্তফা দেন। ক্ষতিপূরণ হিসাবে যে টাকাটা পান, তা দিয়ে শুরু করেন কয়লা ও লবণের ব্যবসা। কলকাতায় তখন কয়লার প্রয়ােজনীয়তা বাড়ছে। রেল, লঞ্চ, স্টিমারসহ কলকারখানায় তখন কয়লা ব্যবহৃত হতাে। কিছুদিনের মধ্যেই লবণের ব্যবসা ছেড়ে তিনি শুধু কয়লার ব্যবসায় মনােনিবেশ করেন। প্রথমে বাড়ি বাড়ি কয়লা সরবরাহ করতেন রণদা। পরে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কয়লা সরবরাহের কাজ আসতে শুরু করে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার সতীশ চৌধুরী রণদার
মধ্যে উদ্যম এবং উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ দেখেছিলেন। তিনি রণদার প্রতি অর্থ, পরামর্শ ও সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন।
মাত্র ছয় বছরে কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত কয়লা ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন রণদাপ্রসাদ। এ সময় রণদা লক্ষ করলেন, তার পুরনাে এক খরিদ্দার লঞ্চের মালিক কয়লার দাম পরিশােধ করতে পারছে না। খােজ নিয়ে জানলেন, লঞ্চের ব্যবসা ভালাে চলছে না বলে ওই মালিক লঞ্চ বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছে। রণদা দেখলেন, লঞ্চটা কিনলে তার পাওনা আদায়ও হবে, আবার কম দামে একটি লঞ্চও পাওয়া যাবে। এই লঞ্চ কিনে নিয়েই নৌ-পরিবহনের ব্যবসা শুরু করলেন রণদা। অন্য ব্যবসায়ীরা যখন ব্যর্থ হয়ে কোনােকিছু জলের দামে বেচে দিত, রণদা তা কিনে নিয়ে নতুন করে দাঁড় করাতেন। কোনাে ব্যবসার সমস্যাগুলাে দ্রুত খুঁজে বের করে সেটিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করে তুলতেন তিনি। ১৯৩৯ সালে জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, জাস্টিস জে, এন, মজুমদার ও নলিনী রঞ্জন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে রণদাপ্রসাদ ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ নামে একটি নৌ-পরিবহন কোম্পানি চালু করেন। বেঙ্গল রিভার সার্ভিস মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে মালামাল পরিবহন করত। নৃপেন্দ্রনাথ। চৌধুরী ছিলেন কোম্পানির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার মৃত্যুর পর রণদা ওই পদে বসেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্য শরিকদের কাছ থেকে সমস্ত অংশ কিনে নিয়ে কোম্পানির একক মালিকানা লাভ করেন। প্রকৃত অর্থে এ অবস্থান থেকেই ব্যবসায়ী রণদাপ্রসাদ সাহার উত্থান শুরু। তিনি কোম্পানির লঞ্চগুলাের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জে একটি ডকইয়ার্ড তৈরি করেন। এ অঞ্চলে। এটিই প্রথম ডকইয়ার্ড। এখানে বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের লঞ্চ ছাড়াও অন্যান্য। কোম্পানির এবং ব্যক্তিমালিকানার লঞ্চও মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ করা হতাে।
১৯৪০ সালে রণদা নারায়ণগঞ্জের জর্জ অ্যান্ডারসনের যাবতীয় পাট ব্যবসা কিনে নেন। এটি পূর্বে ডেভিড এন্ড কোম্পানি’ পরিচালনা করত। রণদা পাটের ব্যবসাকে আধুনিকীকরণ করেন। পাট মজুতের জন্য তিনি পাটকল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করেন এবং ১৯৪৬ সালে নতুন করে বেইল প্রেসিং যন্ত্র। স্থাপন করেন। পাটকলের অন্যান্য সকল ইউনিট পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে গেলেও এই। প্রেসিং যন্ত্র সচল ছিল। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ব্রিটিশ সরকার খাদ্য সংগ্রহ ও মজুতের জন্য সারা বাংলায় চারজন প্রতিনিধি নিয়ােগ করে। রণদাপ্রসাদ। ছিলেন তাঁদের একজন। এ ব্যবসায়ও তিনি প্রচুর মুনাফা করেন। এভাবে দেশ বিভাগের পূর্বেই তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা। হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান। এরপরে নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজদের । মালিকানাধীন তিনটি পাওয়ার হাউস কিনে নেন রণদা। এ সময় তিনি চামড়ার । ব্যবসাও শুরু করেন। ব্যবসায় উন্নতি করার পাশাপাশি রণদাপ্রসাদ আত্মনিয়ােগ করেন। সমাজসেবামূলক নানা কাজে। তিনি ১৯৩৮ সালে মির্জাপুরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট ‘কুমুদিনী ডিস্পেনসারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে সেটিই ‘কুমুদিনী হাসপাতাল নামে পূর্ণতা পায়। সে সময়ে এটি ছিল দেশের হাতেগােনা উন্নত চিকিৎসার সুযােগ সমৃদ্ধ হাসপাতালের একটি। দেশের প্রথম ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থাও এ হাসপাতালেই চালু হয়। কুমুদিনী হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনাে শ্রেণিভেদ ছিল না, ধনী ও গরিব সবাই সমান সুযােগ ও চিকিৎসা পেত। বর্তমানে দেশের দূরদূরান্তের গরিব রােগীরা চিকিৎসা পাওয়ার আশায় আসে এ হাসপাতালে। রােগীদের থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সুচিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থা।
কুমুদিনী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যারা এর সাথে জড়িত ছিলেন এবং রণদাপ্রসাদকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা সহায়তা করেছেন, তাঁদের নাম স্মরণীয় করার জন্য ও তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের নামে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের নামকরণ হয়। কুমুদিনী হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য রণদা দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা চিকিৎসকদের হাসপাতালে আমন্ত্রণ করতেন। হাসপাতালের শুরুর দিনগুলােতে মির্জাপুরের মতাে প্রত্যন্ত অঞ্চলে রােগীদের সেবাশুশ্রুষার কাজে নার্সের ঘাটতি পূরণ করার জন্য রণদা গ্রামের দুস্থ ও সহায়-সম্বলহীন নারীদের প্রশিক্ষিত করে তােলেন। পরবর্তীতে হাসপাতালের অভ্যন্তরেই নার্স প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন। রণদাপ্রসাদ কুমুদিনী হাসপাতালের সাথে একটি মহিলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর ২০০১ সালে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। রণদাপ্রসাদ ১৯৪২ সালে ভারতেশ্বরী বিদ্যাপীঠ স্থাপন করে ওই অঞ্চলে নারীশিক্ষার সুযােগ করে দেন, যা ১৯৪৫ সালে ভারতেশ্বরী হােমস’ হিসাবে নামকরণ করা হয়। এটিই দেশের প্রথম আবাসিক মহিলা বিদ্যালয়। ১৯৪৪ সালে মির্জাপুরের মতাে বদ্ধগ্রামে আধুনিক ভাবধারার এই স্কুল ছিল এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। ছাত্রীদের লেখাপড়াসহ অন্যান্য যাবতীয় খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করত। এখানে ছাত্রীদের শরীরচর্চাকেও বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুরুতে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকলেও ১৯৬২ সাল থেকে এটি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা হয়। রণদাপ্রসাদ ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই দেশের প্রথম আবাসিক মহিলা ডিগ্রি কলেজ। তিনি তার বাবার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ স্থাপন করেন, যা বর্তমানে সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ” নামে পরিচিত। এছাড়া আরও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে তিনি আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
১৯৪৩ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ (পঞ্চাশের মন্বন্তর) দেখা দিলে রণদা রেডক্রস। সােসাইটিকে এককালীন তিন লক্ষ টাকা দান করেন। দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য কলকাতা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় চার মাস ধরে ২৫০টি লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন রণদাপ্রসাদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল ছাড়াও তিনি জনস্বার্থে কমিউনিটি সেন্টার, পাবলিক হল, নাট্যমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। ১৯৫৮ সালে রণদার উদ্যোগে ঢাকা সেনানিবাসের সি. এম. এইচ.-এ প্রসূতি বিভাগ চালু করা হয়। ১৯৪৭ সালে রণদাপ্রসাদ তার সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করার জন্য ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ নামে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। ১৯৪৭ সালে রণদাপ্রসাদের সব ব্যবসা ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গলের আওতাভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ ট্রাস্ট যাত্রা শুরু করে। ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয় ছিল নারায়ণগঞ্জে। মানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখার মানসিকতা থেকেই রণদাপ্রসাদের ব্যবসা পরিচালিত হতে থাকে। তিনি এই ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরিবারের ভরণপােষণের খরচ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন কিছুই নিতেন না রণদাপ্রসাদ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ট্রাস্টের কার্যক্রম দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভারতে অবস্থিত ব্যবসাগুলাে পৃথকভাবে পরিচালিত হতে থাকে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে ভারতের কলকাতা, কালিমপং ও মধুপুরের দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলাে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে ট্রাস্টের আওতায় বর্তমানে কুমুদিনী। হাসপাতাল, নার্সিং বিদ্যালয়, মহিলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, ভিলেজ আউটরিচ। প্রােগ্রাম, ভারতেশ্বরী হােমস, ট্রেড ট্রেনিং বিদ্যালয়, কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফটস, জুট বেলিং ও ওয়্যার হাউস, বেঙ্গল রিভার সার্ভিস, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। রণদাপ্রসাদ সাহা গৃহী হয়েও ছিলেন সন্ন্যাসী। সংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি বলতেন, “মানুষের ধর্ম একটাই, সেটা মানবধর্ম।” তাঁর গড়ে তােলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাের শিক্ষার্থীদেরও তিনি এই আদর্শের শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন কর্মের মন্ত্রে দীক্ষিত। কোনাে ফলের আশা নয়, কর্মকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এক গরিব পরিবারে জন্ম নিয়েও জীবনে কঠোর পরিশ্রম করে যে বিশাল সম্পদ তিনি অর্জন করেছিলেন, তার সবটুকুই অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। সম্পদ তিনি নিজের জন্য অর্জন করেননি, করেছেন মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য উল্লেখ করার মতাে ব্যাপার হলাে, রণদাপ্রসাদ সাহা নিজের নামে কোনাে প্রতিষ্ঠান গড়েননি, যা করেছেন সবই অন্যদের নামে।
রণদাপ্রসাদ সাহা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষ। অন্যের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতির গুণ দেখলে তিনি যেমন তা উসূকে দিতেন, তেমনি নিজেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরু থেকেই ভারতেশ্বরী হােমসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়ােজন করতেন তিনি। রণদা সৌখিন অভিনেতা হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। সৈনিক অবস্থায় করাচিতে তার নাট্য জীবন শুরু। ১৯৪৮ সালে মির্জাপুরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘সৌখিন নাট্যসংঘ’ ও ‘আনন্দ নিকেতন মঞ্চ। এমন আধুনিক মঞ্চ তখন পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায়ও ছিল না। ১৯৬৯ সালে ক্ষীরদাপ্রসাদ রচিত ‘আলমগীর’ নাটকটি অভিনীত হয় আনন্দ নিকেতন মঞ্চে। এই নাটকে বাদশাহ আলমগীরের ভূমিকায় রণদাপ্রসাদের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যা ও লুটতরাজ শুরু করলে অনেকেই, বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। শুভাকাক্সক্ষীরা। রণদাকেও দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় যে বাংলাকে মাতৃভূমি হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দুর্দিনে সেই দেশ, দেশের মানুষ, তার গড়া বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রিয়জনদের ফেলে চলে যাওয়ার মানসিকতা তার ছিল না।
যুদ্ধের শুরু থেকেই মির্জাপুরে তাঁবু গেড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কুমুদিনী হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হােমসের কার্যক্রমের প্রতি কড়া নজর রাখছিল তারা। হাসপাতালের রােগী ও হােমসের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে এই দুই প্রতিষ্ঠান ও রণদাপ্রসাদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে এ গ্রামে কোনাে গণ্ডগােল হবে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলােতে আহত মুক্তিযােদ্ধারা সাধারণ রােগীর বেশে এসে চিকিৎসা নিচ্ছিল কুমুদিনী হাসপাতালে। পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকার ও আলবদরদের কারণে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। রণদাপ্রসাদ তখন থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। সপ্তাহ শেষে একবার করে মির্জাপুর আসতেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা মির্জাপুরে এসে থাকা শুরু করে। রণদাপ্রসাদ ও একমাত্র পুত্র ভবানীপ্রসাদ (রবি) তখনও থাকতেন নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল লাট ভবনে পুত্র রবি ও রণদাপ্রসাদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আটক করে। যদিও ৫ মে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেয়ে পিতাপুত্র নারায়ণগঞ্জে ফিরে যান। পরিবারের লােকজনও তাদের ফিরে পেয়ে দারুণ খুশি হয়। সবাই ভেবেছিল, বিপদ বুঝি কেটে গেছে।
কিন্তু দুই দিন পরই শুরু হয় আসল তাণ্ডব। ৭ মে দুপুরের দিকে মির্জাপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ওদুদ মাওলানা টাঙ্গাইল থেকে পাকবাহিনী নিয়ে আসে। হানাদাররা মির্জাপুরে আগুন, লুটতরাজ ও গণহত্যা শুরু করে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তাদের এই নারকীয় উল্লাস। একই দিনে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৭ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনীর দোসররা রণদাপ্রসাদ ও ভবানীপ্রসাদকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেননি এবং তাঁদের কোনাে খোঁজও পাওয়া যায়নি। রণদাপ্রসাদ সাহার স্ত্রী কিরণবালা দেবী ছিলেন বালিয়াটির সম্রান্ত জমিদার বাড়ির মেয়ে। রণদার সুখ-দুঃখের সহভাগীই শুধু নন, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন তিনিও। ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা স্বামী ও সন্তানকে ধরে নেওয়ার পর থেকেই তিনি শােকে শয্যাশায়ী হন। শেষ জীবনে তিনি নির্বাক হয়ে যান। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯৮৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কিরণবালা মারা যান। তাদের সংসারে দুই মেয়ে ও দুই ছেলে ছিল। বড় মেয়ে বিজয়া ও ছােট মেয়ে জয়া, ছেলে দুর্গাপ্রসাদ ছােটবেলায় মারা যায়। সবার ছােট ভবানীপ্রসাদ বাবার সাথে শহীদ হন। সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার রণদাপ্রসাদ সাহাকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার সমাজসেবার জন্য তাকে হেলাল-এ-পাকিস্তান’ খেতাব দেয়। মানবসেবায় অসামান্য অবদান রাখায় ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) দিয়েছে। সমাজসেবায় অবদানের জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ও ১৯৮৪ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার পায়। বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালে রণদাপ্রসাদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা