You dont have javascript enabled! Please enable it! যােগেশচন্দ্র ঘােষ - সংগ্রামের নোটবুক
যােগেশচন্দ্র ঘােষ
শিক্ষাবিদ ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রবিশারদ যােগেশচন্দ্র ঘােষ ১৮৮৭ সালে শরীয়তপুর জেলার গােসাইরহাট উপজেলার জলছত্র গ্রামে জন্ম নেন। তার বাবার নাম পূর্ণচন্দ্র ঘােষ। েশিশুকাল থেকেই যােগেশচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।। গ্রামের এক বিদ্যালয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও মেধা দেখে পূর্ণচন্দ্র ঘােষ তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে ঐতিহ্যবাহী জুবিলি স্কুলে তিনি ভর্তি হন। ১৯০২ সালে ১৫ বছর বয়সে যােগেশচন্দ্র ঘােষ এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর ১৯০৪ সালে তকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি এফ. এ. পাস করেন এবং ১৯০৬ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে বি, এসসি. ডিগ্রি নেন। এরপর ১৯০৮ সালে যােগেশচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে এম. এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ই তাকে দেশজ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের বিষয়ে উৎসাহিত করেন। যােগেশচন্দ্র ঘােষ ১৯০৮ সালে ভাগলপুর কলেজে রসায়নের শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি লন্ডন কেমিক্যাল সােসাইটির ফেলাে (এফ. সি. এস.) নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেমিক্যাল সােসাইটিরও (এম. সি. এস.) তিনি সদস্য ছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে রসায়নের অধ্যাপক পদে যােগ দেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে নিয়ােজিত ছিলেন। পরে তাকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। দুই বছর অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৪৮ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।
মানুষকে অল্প খরচে রােগ থেকে মুক্তি দিতে যােগেশচন্দ্র ঘােষ দেশীয় গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরির কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনাকালে তিনি ১৯১৪ সালে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় ৭১, দীননাথ সেন রােডে। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তােলেন ‘সাধনা ঔষধালয়’। এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল পূর্ববঙ্গে আয়ুর্বেদীয় ওষুধ তৈরির প্রথম কারখানা। তখন থেকে প্রতিষ্ঠানটি আয়ুর্বেদীয় ওষুধের প্রসারে কয়েক দশকব্যাপী গৌরবের স্বাক্ষর রাখে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে যােগেশচন্দ্র ঘােষের ব্যাপক গবেষণার ফলে ওষুধ প্রস্তুত প্রণালী উন্নত হয় এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিও আধুনিক মানে উন্নীত হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং দেশের বাইরেও সাধনা ঔষধালয়ের শাখা স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি একটি মহীরুহে। পরিণত হয়। বাংলায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার পথিকৃৎ যােগেশচন্দ্র ঘােষ তার জীবনের দীর্ঘ ছয় দশক আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়ােজিত রাখেন। বিখ্যাত টুথপাউডার ‘সাধনা দশন থেকে শুরু করে শ্রী গােপাল তেল তারই সৃষ্টি। যােগেশচন্দ্র ঘােষের অমর সৃষ্টি সাধনা ঔষধালয় দেখে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছিলেন : প্রফেসার শ্রীযােগেশচন্দ্র ঘােষ, আয়ুর্বেদশাস্ত্রী, এম. এ., এফ. সি. এস. (লন্ডন), এম. সি. এস. (আমেরিকা) কর্তৃক পরিচালিত সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা পরিদর্শন করিয়া বড়ই প্রীতি লাভ করিলাম। এখানে বহুল পরিমাণে ঔষধাদি প্রস্তুত হইয়া থাকে এবং প্রফেসার ঘােষ স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া কারখানা তত্ত্বাবধান ও ঔষধাদি প্রস্তুত করিয়া থাকেন। ঔষধগুলি যাহাতে বিশুদ্ধ ও অকৃত্রিম হয় তপ্রতি অধ্যক্ষের বিশেষ দৃষ্টি আছে। এই কারখানার ঔষধ বিশুদ্ধভাবে প্রস্তুত করা হয় বলিয়াই এখানকার ঔষধগুলি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। দেশসমূহে খুব কাটতি হইতেছে- ইহাই আমার বিশ্বাস ও ধারণা। প্রফেসার ঘােষ আমার একজন প্রাক্তন ছাত্র। আয়ুর্বেদে তাহার এই অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়া বড়ই আনন্দ লাভ করিলাম।
সাধনার ওষুধ ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছিল কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যােগেশচন্দ্র ঘােষকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন : কিছুদিন হইতে আপনাকে পত্র লিখিব লিখিব মনে করিতেছিলাম। কারণআপনার সর্বজ্বর বটী খাইয়া আমার জ্বর সারিয়াছে, এই কথাটা ইচ্ছা ছিল । আপনাকে কৃতজ্ঞতার সহিত নিবেদন করিব। আমি মুখে মুখেও বহু পরিচিত ব্যক্তিকে ইহার উল্লেখ করিয়াছি। ব্যক্তি যােগেশ ও তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছেন : আমি ঢাকার সাধনা ঔষধালয় পরিদর্শন করিয়াছি এবং তাহাদের ঔষধ সুসংরক্ষণ, প্রস্তুত প্রণালী ও সৌষ্ঠবযুক্ত কাৰ্য্যসম্পাদন-ব্যবস্থা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি। সাধনার প্রস্তুত ঔষধাবলীর শাস্ত্রীয়তা ও অকৃত্রিমতা সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণরূপে নিঃসন্দেহ হইয়াছি। অধ্যক্ষ মহাশয়ের জনহিতৈষণার মনােভাবও বিশেষ প্রশংসার যােগ্য। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মপ্রচেষ্টাকে সমর্থন করিলে আয়ুর্বেদকেই সমর্থন করা হইবে। সত্যাসত্যই আয়ুর্বেদানুসারী বলিয়া। সাধনার প্রস্তুত ঔষধাবলীর ব্যবহারের দ্বারা যে কেবল রােগ-আরােগ্যের পক্ষে।
বাঞ্ছিত লাভই হইবে তাহা নয়, পরন্তু ঔষধগুলির এই প্রকার ফলপ্রসূশক্তি আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসকগণের জনপ্রিয়তাকেও বহুল পরিমাণে বর্ধিত করিবে। ঢাকার এই সৰ্ব্বপ্রধান ঔষধালয়ের কর্তৃপক্ষ যেরূপ নিষ্ঠা ও সফলতার সহিত আয়ুর্বেদের সেবা করিতেছেন, তাহাতে আমি তাহাদিগকে অভিনন্দিত না করিয়া পারিলাম না। যােগেশচন্দ্র রােগব্যাধির কারণ, আয়ুর্বেদীয় ওষুধ ও চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়ে কয়েকটি বই রচনা করেন। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে ‘অগ্নিমান্দ্য ও কোষ্ঠকাঠিন্য’, ‘আরােগ্যের পথ’, ‘গৃহ-চিকিৎসা, চর্ম ও সাধারণ স্বাস্থ্য বিধি, ‘চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা ও মুখরােগ চিকিৎসা, ‘আমরা কোন পথে’, আয়ুর্বেদ ইতিহাস’, *Whither Bound Are We’, ‘Home Treatment’ এবং পাঠ্যপুস্তক ‘Text Book of Organic Chemistry’, ‘Simple Geography’, ‘Simple Arithmetic’.  যে কোনাে জনহিতকর কাজে তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন এবং পৃষ্ঠপােষকতা দিতেন সমাজকল্যাণমূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে। ঢাকায় ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি আশেপাশের এলাকার বহু ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু পরিবারকে তার কারখানা ও বাড়িতে আশ্রয় দেন এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যােগেশচন্দ্র ঘােষ নিজের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশজ মানুষের সংযােগের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন : ব্যক্তিগত কল্যাণের উর্ধ্বে উঠিয়া দেশের বৃহত্তম কল্যাণ কামনায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করিলে সেই প্রতিষ্ঠান দেশেরও প্রিয় হয়। সিংহ যখন জাগে, তখন তাহার স্বপ্ন, তন্দ্রা এবং দ্রিা যায় না, তাহার সিংহত্ব জাগে। জাতি যখন জাগে, তখন সকল দিক দিয়াই জাগে। একার চেষ্টাতে জাগে না, সকলের চেষ্টাতেই জাগে। সর্বপ্রকার পরিপুষ্টি লইয়া দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হউক, এই কামনা প্রতিদিনের কামনা। সুতরাং জনসাধারণ সাধনা ঔষধালয়কে তাহাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বলিয়া গণ্য করিবেন না কেন?
১৯৭১ সালের মার্চে সাধনা ঔষধালয়ের সব হিন্দু কর্মচারী কারখানা ছেড়ে চলে যায়। যােগেশচন্দ্র ঘােষ শুধু একজন ব্যক্তিগত সহকারী ও দুজন দারােয়ানসহ তাঁর বিশাল প্রতিষ্ঠান আগলে রয়ে যান। তার একমাত্র সাধনাস্থল এ কারখানা। এখানেই তিনি কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়, করেছেন গবেষণা। পাকবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় ঢাকায় তাদের গণহত্যা কর্মসূচির অংশ হিসাবে প্রধানত হিন্দুদের বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা শুরু করে। ২৫ মার্চের পর একে একে সবাই চলে গেল। গেলেন না কেবল দুজন কারখানার দারােয়ান সুরুজ মিয়া ও রামপাল। তারা দীর্ঘ ১৭ বছর যােগেশ বাবুর সঙ্গে কাটিয়েছেন। ২৫ মার্চের পরের কোনাে একদিন গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাড়ির গেটের তালা ভেঙে ফেলে এবং কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায়। পাহারাদার সুরুজ মিয়াও পাল্টা গুলি চালায়। গােলাগুলির এক পর্যায়ে সেনারা পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর সুরুজ মিয়া যােগেশচন্দ্রকে পালিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু যােগেশচন্দ্রের এক কথা, “মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব। আমার সন্তানসম। এসব ছেড়ে আমি কোথায় যাব?” এর কয়েকদিন পর ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল, স্থানীয় শান্তি কমিটির এক সদস্যকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা আবার ফিরে আসে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও লােকবল নিয়ে। পাকিস্তানি সেনারা নিচে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করায়। অফিসে তল্লাশি চালাবার অজুহাতে চারজন পাকসেনা যােগেশচন্দ্র ঘােষকে নিয়ে ভবনের দোতলায় ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের সহায়তা করার অভিযােগ এনে যােগেশচন্দ্র ঘােষকে তার অফিস কক্ষে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। জানা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুধু তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ‘সাধনা ঔষধালয়ের সমস্ত সম্পদও লুট করে নিয়ে যায়।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা