You dont have javascript enabled! Please enable it!
মােহাম্মদ সাদেক
মােহাম্মদ সাদেক ১৯৩৯ সালের ৩১ মে তৎকালীন ভােলা। মহকুমার (বর্তমান জেলা) দক্ষিণ ইলিশার দারােগার হাওলার সরবদ্দি মাঝি বাড়িতে জন্ম নেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি পরাণগঞ্জ হাই স্কুল ও ভােলা সরকারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সাদেক ১৯৫৪ সালে ভােলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে বরিশালের ব্রজমােহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং একই কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে বি. এ. পাস করেন সাদেক। ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে তিনি বি, এড, এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে এম. এড. ডিগ্রি অর্জন করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, ভােলার পরাণগঞ্জ হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে চাকরি করেন। এরপর ১৯৫৯-৬০ সালে তিনি ভােলা জেলার ব্যাংকেরহাট কো-অপারেটিভ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ভােলার দৌলতখানে অবস্থিত পি. টি. আই.-তে তিনি প্রশিক্ষক পদেও কাজ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন। তিনি কিছুদিন এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সাথেই যুক্ত ছিলেন। মােহাম্মদ সাদেক ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম. এ. ডিগ্রি নিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলে মােহাম্মদ সাদেক তাতে যুক্ত হন। তিনি থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের ১১ নম্বর ভবনের নিচতলায়। ৭ মার্চ থেকে তার বাসার বারান্দায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। এছাড়া ২৩ মার্চ বিক্ষোভ দেখানাের অংশ হিসাবে নিজের ঘরের বারান্দায় তিনি কালাে পতাকাও উড়িয়েছিলেন। এই কালাে পতাকা তিনি বানিয়েছিলেন তার স্ত্রীর শাড়ির কাপড় ছিড়ে। সাদেক এ দেশের জনগণের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। পেশাগত জীবনে নির্লোভ, দৃঢ়চেতা, সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেন মােহাম্মদ সাদেক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের শেষে ২৬ মার্চ ভােরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিজের বাসায় নিহত হন মােহাম্মদ সাদেক। এদিন ভােরের দিকে পাকিস্তানি সেনারা মােহাম্মদ সাদেকের ১১ নম্বর ফুলার রােডের বাসার দরজায় ক্রমাগত লাথি মারতে থাকে। বিপদ হতে পারে জেনেও তিনি নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ঘাতকরা তাঁর দিকে রাইফেল তাক করলে তিনি নির্ভয়ে ইংরেজিতে তাদের বলেছিলে, “নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর এভাবে আক্রমণ করা যায় না।” বলাবাহুল্য, মােহাম্মদ সাদেকের এই যুক্তি ঘাতকদের কাছে কোনাে যুক্তিই নয়। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। তিনি লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে।
সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মােহাম্মদ সাদেকের স্ত্রী সামসুন্নাহার বেগম জানিয়েছেন, পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের ১১ নম্বর ভবনে ঢুকে তার চোখের সামনেই সাদেককে গুলি করে। এ সময় তাঁর দুই হাত খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। পরে বুকে গুলি করলে তিনি চিকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকেন ঘরের মেঝেতে। কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। কারফিউ শিথিল হলে একটি পুরনাে চাদর দিয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ ৮-১০ জন মিলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রােডে সমাহিত করা হয়।  ওই দিনের স্মৃতিচারণ করে মােহাম্মদ সাদেকের ছেলে কামরুল হাসান লিখেছেন :ঘাতকদের প্রচণ্ড পদাঘাতে আমাদের প্রধান ফটক ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। বাবা বললেন, “ওরা দরজা ভেঙে ঢুকলে সবাইকে হত্যা করবে।”
বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন যুক্তির মাধ্যমে ওদেরকে মােকাবিলা করার জন্য। তাই তিনি আমাদের। শত নিষেধ সত্ত্বেও দরজা খুলতে গেলেন। বাবা দরজা খুলে মুখােমুখি। দাঁড়ালেন একদল হিংস্র হায়েনার।মারণাস্ত্র গর্জে উঠল। গুলিবিদ্ধ হলাে বাবার দুটি হাতে। বাবা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। । ফেরার সময় বাবার গলায় বেয়নেট চার্জ করল তারা। হত্যাকারীর দল চলে। যাবার পর আমরা সকলে দৌড়ে গেলাম বাবার নিকট। রক্তস্নাত মেঝেতে বাবা পড়ে ছিলেন। বাবাকে ধরাধরি করে বিছানায় শােয়ানাে হলাে। তখনও তিনি। জীবিত। আমার মা বাবাকে তখন হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু তার । পূর্বেই বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড) মােহাম্মদ সাদেক মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন বীরােচিতভাবে। ২৭ তারিখ সকালে যখন কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়, তখন তার দেহ ১১ নম্বর ভবনের ঠিক পেছনের সীমানায় মাটি দেওয়া হয়। বিয়ের মাত্র ৮ বছরের মাথায় স্বামীকে হারান সামসুন্নাহার বেগম। তাদের সংসারে ছিল দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিটের তৃতীয় পর্যায়ে মােহাম্মদ সাদেকের ছবি সংযােজন করে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-২০১১ সালের ক্যালেন্ডারে ‘স্মৃতিতে ৭১ : শহীদ শিক্ষকবৃন্দ। শিরােনামে ২০ জন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে শহীদ মােহাম্মদ সাদেকের ছবিটি স্থান পায়।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!