You dont have javascript enabled! Please enable it! মােহাম্মদ শামসুজ্জামান - সংগ্রামের নোটবুক
মােহাম্মদ শামসুজ্জামান
মােহাম্মদ শামসুজ্জামানের জন্ম ১৯২৬ সালে, নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার মধ্যনগর গ্রামে। তার বাবার নাম মােহাম্মদ তায়েবউদ্দিন আহমদ। শামসুজ্জামান ১৯৪৩ সালে কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে আই. এসসি. পাস করেন। পরে তিনি কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫০ সালে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। কর্মজীবনের শুরুতে শামসুজ্জামান চাঁদপুর ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে সহকারী প্রকৌশলী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে যােগ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান। দেশে ফিরে আগের কাজেই যােগ দেন শামসুজ্জামান। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী পদে উন্নীত হন।  মােহাম্মদ শামসুজ্জামান ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালােবাসতেন, গুন গুন করে গাইতেন। তাঁর বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল । ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে বন্দরে ভিড়ে থাকা পাকিস্তানি জাহাজ ‘সােয়াত’ থেকে অস্ত্র যাতে না নামানাে হয়, সে ব্যাপারে বাঙালি শ্রমিক-কর্মচারীরা বাধা দেয়। প্রায় তিন সপ্তাহ এই জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানাে যায়নি। এই প্রতিরােধে শামসুজ্জামানের ভূমিকা ছিল। এ কারণে তিনি পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে গােপন বেতারকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারেও তিনি প্রত্যক্ষ সহযােগিতা করেন। জানা যায়, মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘আমার সােনার বাংলা’ গানের রেকর্ড ও শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের যে ক্যাসেট বাজানাে হতাে, তা শামসুজ্জামান নিজের সংগ্রহ থেকেই দিয়েছিলেন। অপারেশন সার্চলাইটের দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকিস্তানিরা চট্টগ্রাম পুনর্দখল করার পর ২১ মে বন্দর থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদস্যরা মােহাম্মদ শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। মােহাম্মদ শামসুজ্জামান ওইদিন অফিসে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তার আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিনের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় তার মেয়ে সালমা চৌধুরী জলির লেখায়। তিনি লিখেছেন : সেদিন শুক্রবার ২১ মে, ১৯৭১। দুপুর একটার মধ্যে (আব্বা) বাসায়। চলে আসার কথা। আম্মা অফিসে ফোন না করেই খাবার বেড়ে আমাদের ডাকছিলেন। কেন জানি বলতে পারব না মন ভালাে লাগছিল না। তাই খাওয়া শুরু করার আগে অফিসে ফোন করলাম। ফোন কেউ ধরলেন না। বললাম, দশ মিনিট বসি। এলে একসাথেই খাব। সেই সুযােগ আর এল না। ১০, ১৫, ২০, ৩০ মিনিটও পার হয়ে গেল, আব্বা এলেন না। তখন নূর। হােসেন (তখন চট্টগ্রাম বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী) চাচাকে ফোন করে। জানতে পারি, আব্বা বলেছেন, ওনার আসতে দেরি হবে, কারণ চেয়ারম্যান (কমােডর মালিক, পাকিস্তানি) সাহেব ওনাকে একটা কাজ দিয়েছেন করতে।
যখন বললাম, আধা ঘণ্টার ওপরে অফিসে ফোন করে কাউকে পাচ্ছি না, তখন উনি চিন্তিত হয়ে বললেন, “আমি দেখছি।” আল্লাহ আল্লাহ করছি। এমন সময় ফোন এল। নূর হােসেন চাচা বললেন, আব্বাকে চাটগা। নৌঘাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখনই আমার বড় ভাই ছুটল। চেয়ারম্যানের বাসায়। আব্বা কোথায় জানতে চাইল। ভাইয়াকে বললেন, “বাসায় যাও, আমি খোজ নিয়ে জানাচ্ছি।” ঘণ্টাখানেক পরে মেসবাউদ্দিন চাচা ফোন করে জানালেন, চেয়ারম্যান বলেছেন আববা নৌঘাটিতেই ছিলেন। ওখানে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিল, ছেড়েও দেওয়া। হয়েছে অনেকক্ষণ। হয়তাে ভয় পেয়েছেন, কোথাও লুকিয়ে আছেন। চলে। আসবেন। আম্মা বললেন, “যদি ছেড়েই দেয়, তাহলে লুকাবে কেন?” চাচাও সঠিক উত্তর দিতে পারলেন না। শুনে সে যে কী কান্না আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল, বলতে পারব না। আব্বা আর ফিরে আসেননি। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) মােহাম্মদ শামসুজ্জামান ১৯৫১ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা