You dont have javascript enabled! Please enable it! মােহাম্মদ মাের্তজা - সংগ্রামের নোটবুক
মােহাম্মদ মাের্তজা
মােহাম্মদ মাের্তজার জন্ম ১৯৩১ সালের ১ এপ্রিল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটের চণ্ডিপুর গ্রামের রক্ষণশীল এক মুসলিম পরিবারে। তাঁর দাদা মােহাম্মদ আব্বাস আলী ছিলেন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি মওলানা আকরম খা সম্পাদিত বিখ্যাত পত্রিকা মাসিক মােহাম্মদী’র মালিক ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে মােহাম্মদ আব্বাস আলীই প্রথম কোরানের বাংলা অনুবাদ করেন। মাের্তজার বাবা মওলানা আব্দুল মান্নান আল আযহারী এবং মা সায়েরা খাতুন। কলকাতার ক্যাম্পবেল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার কারণে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় আব্দুল মান্নানকে। মাের্তজার যখন বয়স মাত্র দুই মাস, তখনই তার বাবা আব্দুল মান্নান দেশ ছেড়ে মিশর চলে যান। পরবর্তীতে কায়রাের আল আজহার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতকোত্তর হয়েছিলেন।
মাের্তজার বাবা দেশে ফিরে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। এতে তার মা সায়েরা মানসিকভাবে খুবই আঘাত পান এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর মাের্তজার এক বােন জন্মে। এরপর সায়েরা খাতুন আর বেশিদিন বাঁচেননি। এসব ঘটনায় বাবার সঙ্গে মাের্তজার এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হলেও আব্দুল মান্নান ছেলে মাের্তজার সততা ও মানবিক আচরণে গভীর আস্থা রাখতেন। দেশে ফিরে আব্দুল মান্নান কলকাতার বালিগঞ্জ সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি বগুড়া ও যশাের জিলা স্কুলে এবং সর্বশেষ ‘ঢাকার আজিমপুর গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।  সায়েরা খাতুন অল্প বয়সেই তার বাবাকে হারিয়েছিলেন। তিনি লালিত হয়েছেন তাঁর এক নিঃসন্তান মামার বাড়িতে। আব্দুল মান্নান কায়রাে চলে গেলে সায়েরা খাতুন চলে যান কেওঁশা গ্রামে, তার মামার বাড়িতে। মায়ের মৃত্যুর পর মাের্তজাও। এখানে লালিত পালিত হন। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মনােযােগী এবং মেধাবী ছিলেন। তিনি তবে কিশাের মাের্তজা দুষ্টুমিতেও কম যেতেন না। ছােটবেলায় তাকে দারুণ। অভাবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ভালাে গান গাইতেন তিনি। অর্থের অভাবে মাঝে। মাঝে এক চাচার সাথে গ্রামের বিভিন্ন বাজারে গান গাইতে বেরিয়ে যেতেন।
গান গেয়ে যে টাকা পেতেন তা যেমন নিজের জন্য খরচ করতেন, তেমনি গ্রামের অভাবী মানুষের বিপদে-আপদেও সহযােগিতা করতেন সে টাকায় গ্রামের বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হলেও মাের্তজার প্রাথমিক শিক্ষা বাবার কর্মস্থল কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলে। ১৯৪৬ সালে বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন মাের্তজা। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও প্রথম বিভাগে পাস করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। পরিবারের সবার আগ্রহ ছিল যাতে মাের্তজা ডাক্তার হন। সেজন্যে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছেড়ে তিনি এসে ভর্তি হন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় পরপর দুই বছরই তিনি প্রথম হয়েছিলেন। এই কৃতিত্বের কারণে তিনি শিক্ষকদের মনােযােগ ও স্নেহ পেয়েছিলেন।
কিন্তু ১৯৫০ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেওয়ায় তাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়াশােনার ইতি টানতে হয়। একেবারে শূন্য হাতে মাের্তজা চলে আসেন অচেনা শহর ঢাকায়, যেখানে বন্ধু নেই, নেই কোনাে আত্মীয়-স্বজন। তিনি যখন ঢাকায় আসেন, তখন তাঁর সম্বল ছিল একটা চিঠি ও ঠিকানা লেখা এক টুকরাে কাগজ। কলকাতা মেডিকেলের সাবেক অধ্যাপক ডা. টি, আহমেদ তখন ঢাকা মেডিকেলের অধ্যক্ষ। তার চিঠি পেয়েই মাের্তজা ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা। মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন। সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ গড়ে উঠেছিল শৈশবেই। প্রথম জীবনে তিনি ভাবতেন, সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়গুলাে তুলে ধরবেন। তাই সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি বাংলা-ইংরেজিসহ বিশ্বসাহিত্য নিয়ে পড়াশােনা করতেন। এক সময় তিনি বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’য়ের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে ওঠেন। নিজেও নাটক লিখতে আগ্রহী হন। মেডিকেলে তিনি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন পড়াশােনার অংশ হিসাবে রােগীদের রােগের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রাখতে হতাে তাকে। এ কাজ করতে গিয়ে রােগীদের অভাব, দুর্দশা ও অসহায়ত্ব দেখে তিনি খুবই কষ্ট পেতেন। তাঁর মনে হলাে, রােগীদের অনেকেই শারীরিক ব্যাধির চেয়ে অনেক বেশি শিকার হয়েছে সামাজিক ব্যাধির। শুধু দেহের ও মনের চিকিৎসায় তাদের রােগ ভালাে হবে না। মানুষের সুস্থতার জন্যে সবার আগে দরকার সমাজের চিকিত্স। ১৯৫১ সালের ২৭ এপ্রিল ডায়রিতে লিখেছিলেন, “কবিতা আমার জন্মগত আর চিকিৎসা আমার অবস্থাগত। … হতভাগ্য মুসলমান সমাজের জন্য একটা কিছু করিবার অপরাজেয় বীৰ্য্যবান কামনা লইয়া সকল অবস্থায় তীব্র শক্রতার মাঝখানে আমি আমার যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছিলাম।” এই উপলব্ধি থেকেই তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশােনা করতে শুরু করেন।
মানুষের প্রতি গভীর মমতা আর ভালােবাসা তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল কৈশাের বয়সেই। কিশাের মাের্তজা তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। গ্রামের এক নারীর অসহায়ত্ব তাকে কষ্ট দেয়। তিনি এর প্রতিবাদ জানান এক অভিনব কায়দায়- কবিতা লিখে। এজন্য তাকে অভিভাবকদের বকাঝকাও খেতে হয়েছিল। নিপীড়িত মানুষের প্রতি এই দরদই তাকে সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে এবং বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করেছিল । ঢাকা মেডিকেলে পড়ার শেষ দিকে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি, যুক্ত হন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাথে । মেডিকেলে পড়ার পাশাপাশি লিখছিলেন কবিতা, নাটক, ছােটগল্প, উপন্যাস। ১৯৫১ সালে তিনি লিখেছিলেন সমাজপতি’ নাটক। ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে সমাজপতিরা যেভাবে নিজেদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করে তাই তিনি তুলে ধরেন এ নাটকের মাধ্যমে।
১৯৫৪ সালে এম. বি. বি. এস. পাস করেন মাের্তজা। এরপর চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্যে বিদেশ যাওয়ার সুযােগ এসেছিল তার। তিনি সেই সুযােগ নেননি। কারণ তিনি মনে করতেন, চিকিৎসক হয়ে সমাজের কিছু মানুষের। উপকার করা যায়, কিন্তু অভাব, শােষণ ও বৈষম্য থেকে যে রােগ জন্মায়- তা দূর করা যায় না। এজন্য চাই সমাজকে শােষণ-বৈষম্যমুক্ত করার রাজনীতি। তাই তিনি দেশে থেকে দেশের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন। ব্যক্তিগত উন্নতির হাতছানি এড়িয়ে ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের সহকারী কর্মকর্তা হিসাবে কাজ শুরু করেন মাের্তজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নেওয়ার একটা কারণ ছিল, এখানে থাকলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারবেন এবং নিরিবিলিতে পড়াশােনা চালিয়ে যেতে পারবেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি এ পদেই চাকরি করেছেন। এই ১৬ বছরের অধিকাংশ সময়ই দিনের অর্ধেকটা ব্যয় করতেন চিকিৎসা করে আর বাকি অর্ধেকটা কেটে যেত গ্রন্থাগারে। বাসায় ফিরেও চলত পড়াশােনা আর লেখালেখি । রাত ২টা-৩টার আগে ঘুমাতে যেতেন না। ঘুম কাটানাের জন্য একটা লেকচারস্ট্যান্ডের মতাে উচু টেবিল বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেটার ওপর বইপত্র রেখে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়াশােনা ও লেখালেখি করতেন।
চিকিৎসক হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সবার কাছে মাের্তজা ছিলেন অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য। যখনই কারও অসুখ-বিসুখে ডাক পড়ত, তিনি ছুটে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেই চলে যেতেন পাবনা, কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা, বরিশাল। বিনামূল্যে চিকিত্সা করতেন গ্রামের মানুষের, আর নমুনা হিসাবে পাওয়া বিনামূল্যের ওষুধ বিলি করতেন গরিবদের মাঝে। রিকশায় চড়তেন না মাের্তজা। অন্যের ঘাড়ের ওপর আয়েশ করে চলাটাকে অমানবিক এবং অপমানের বিষয় মনে করতেন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে যায়। মাের্তজা যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অংশের সাথে । নিজের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সাম্যবাদী রাজনীতি বিষয়ে পাঠচক্র নিতেন মাের্তজা।
১৯৬৭ সালের ২৩ এপ্রিল সাঈদার সাথে বিয়ে হয়ে মােহাম্মদ মাের্তজার । মুস্তাফা পান্না লিখেছেন, “ডাক্তার মাের্তজা ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র নেতৃস্থানীয় সদস্য। এসময় তাকে ঘিরে বেড়ে উঠেছিল একদল তরুণ। তিনি এসব তরুণদের কেবল রাজনৈতিক শিক্ষাই দিতেন না, তাদের খাওয়া-পরা-শিক্ষার ব্যয়ের সিংহভাগ বহন করতেন। (বােধ করি সে কারণে তিনি বিলম্বে বিয়ে করেছিলেন)।” (শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ) | মোর্তজা নিজেই পছন্দ করেছিলেন সাঈদাকে। বিয়েতে মাের্তজার অভিভাবক ছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বিয়ের স্মৃতিচারণ করে সাঈদা মাের্তজা লিখেছেন : বিয়ের এক সপ্তাহ আগেও জানি না আমার বিয়ে হচ্ছে এবং তা ডা. মাের্তজার সঙ্গে। তিনি খালার কাছে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছেতেই তিনদিনের মধ্যে বিয়ে ঘটে গেল। বিয়ে হলে ফুলার রােডের বাসায়। এলাম (শহীদ) মুনীর চৌধুরীর গাড়িতে। মুনীর চৌধুরী নিজেই ড্রাইভ করেছিলেন।  বিয়ের প্রথম রাতেই ডা. মাের্তজা আমাকে আত্মপরিচয় ব্যক্ত করে বললেন, এই সমাজের নানা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই সমাজকে ভেঙে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি। আমি যেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার চেষ্টা করি। শােষণের রাজনীতি আর শােষণমুক্ত সমাজ গড়ার রাজনীতি- এসব কিছুই বুঝতাম না আমি। তবে মানুষকে কষ্ট দেওয়া, অন্যায় করা দেখলে আমার খুব খারাপ লাগত। তাই তার। কথা সেদিন মন দিয়ে শুনেছিলাম। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) ‘সমাজপতি’র পর মাের্তজা ‘প্রেম ও পুরুষ” নামে আরও একটি নাটক রচনা করেন। এই দুটো নাটকের পর বেশকিছু ছােটগল্প রচনা করেন তিনি। তার এসব রচনায় মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমস্যাকেও একটা বড় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তার আরও একটি উল্লেখযােগ্য রচনা হলাে উপন্যাস ‘চরিত্রহানির অধিকার’। এই উপন্যাসে তিনি বাঙালির আর্থরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ধরে কিছু চরিত্র উপস্থাপন করেছেন যেগুলাে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি। উপন্যাসের নায়ক মালেক চৌধুরী বাঙালি জাতীয়তাবাদী। মালেক চৌধুরী বাঙালির ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মানস-সন্তান। আবার নায়িকা রােকেয়া ইসলাম ইংরেজ উপনিবেশবাদের ফসল। মালেক যেমন বাংলা ভাষার ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন, রােকেয়া তেমনি অধিকাংশ কথাই বলে ইংরেজিতে। দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির একটা জগাখিচুড়ি মিশ্রণে সৃষ্ট অপজাত সমাজের সন্তান রােকেয়া মনে করে, মাতৃভাষাটা সে যেমন বলে তেমনি হওয়া উচিত। রােকেয়ার মাধ্যমে মােহাম্মদ মাের্তজা বাঙালি সমাজের বিত্তশালী একটা অংশের যে চিত্র তুলে ধরে ছিলেন, তা এখনও বর্তমান। নাটক, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদির চেয়ে ডা. মােহাম্মদ মাের্তজার চিন্তা ও মননশীলতার শক্তিশালী প্রকাশ হচেছ তার প্রবন্ধে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যাগুলাে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেগুলাে সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি তাঁর প্রবন্ধগুলােতে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়েও ভাষা নিয়ে তর্ক-বিতর্কে অংশ নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ভাষার রূপ’ (১৯৫৮)। বাঙালির ভাষার রূপ কী হবে তা তিনি আলােচনা করেছেন এ প্রবন্ধে। শিক্ষার জগাখিচুড়ি: কিন্ডারগার্টেন বনাম মাদ্রাসা (১৯৬৩) প্রবন্ধে সমসাময়িক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলাে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যৌতুক সমস্যা নিয়ে।
লিখেছেন ‘বাণিজ্যিক বিবাহ’ প্রবন্ধ। প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক’ নামের একটি বই লিখেছিলেন তিনি। মানুষের প্রেম ও বিয়ের সনাতন ধারণার অচলায়তনে আঘাত। করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি এই লেখার মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে জনসংখ্যা ও সম্পদ’ বইয়ের জন্যে মাের্তজা পেয়েছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার। এই বইতে তিনি জনসংখ্যা কখন সমস্যা এবং কখন। সমস্যা নয়, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার বিভিন্ন দিক তিনি তুলে ধরেছেন ওই বইতে। চিকিৎসক হওয়ায় সাধারণ মানুষের পাঠের উপযােগী চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ক বইও তিনি অনুবাদ করেছেন। সেগুলাে হলাে : ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের কাহিনী’ ও ‘প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস’। এছাড়া তিনি লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’, ‘শান্তি না শক্তি’, ‘হুনানের কৃষক আন্দোলন’, ‘জনযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘজীবী হােক’, ‘পাক-ভারত যুদ্ধের তাৎপর্য, প্রাচীন ভিজনানের কাহিনী’ ইত্যাদি প্রবন্ধ ও বই।  ১৯৮৫ সালে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে মােহাম্মদ মাের্তজা রচনাবলী’ প্রকাশিত হয়েছিল।
সমাজ ও মানুষের কল্যাণের আকাক্ষা থেকে প্রত্যক্ষ প্রয়ােজনের কথা বিবেচনা করে তিনি কলম চালিয়েছেন। এই মনােভাব থেকেই এক সময় সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছাও জেগেছিল মাের্তজার মনে। দেশের মানুষকে সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন ও অনুপ্রাণিত করতে তিনি ও বদরুদ্দীন উমর মিলে ‘গণশক্তি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। বদরুদ্দীন উমর ছিলেন সেই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় উপ-সম্পাদকীয়সহ দুই-তিনটি লেখা থাকত মাের্তজার। এ পত্রিকায় তিনি ছদ্মনামেও অনেক লেখা লিখেছেন। দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ” শিরােনামে একটি লেখা তিনি নিয়মিত লিখেছেন। মােহাম্মদ মাের্তজা সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু বিষয় নিয়ে আলােচনা করেছেন তাঁর লেখায়। তার সব লেখারই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বাঙালি জাতিকে সচেতন করে তুলতে তিনি লিখেছেন ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তাৎপর্য’, ‘মধ্যবিত্ত কোন পথে’, “প্যালেস্টাইনবাসীদের মুক্তিযুদ্ধ কোন পথে?’, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণ-আন্দোলন, ‘জাপানে ছাত্র-শ্রমিকের সংগ্রাম’, লাওসে গণযুদ্ধ’, ‘ধােফারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নাভিশ্বাস’, ‘বার্মায় জনযুদ্ধের সাফল্য’, থাইল্যান্ডের গণযুদ্ধ এগিয়ে চলেছে’ ইত্যাদি প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধের মাধ্যমে মােহাম্মদ মাের্তজা নিজের দেশ ও জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন। মানুষ হিসাবে কতটা মানবিক ও অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন মােহাম্মদ মাের্তজা সেটা বােঝার জন্যে কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের মেয়ে দ্যুতির বয়স যখন মাত্র আট-নয় মাস, তখন একদিনের ঘটনা স্মরণ করে সাঈদা লিখেছেন : একদিন সকালে মেয়েকে কমলা খাওয়াচ্ছি। তিনি এলেন বাইরে থেকে। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “তােমার মেয়েকে দুধ খাওয়ালে, ডিম খাওয়ালে, এখন আবার কমলা খাওয়াচ্ছে। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ যে এই মুহূর্তে এই পৃথিবীর কত অসংখ্য শিশু রয়েছে জন্মেই যারা এক ফোটা বিশুদ্ধ পানিও পাচ্ছে না?
সাঈদা আরও লিখেছেন : একবার আমি তাঁকে তিন টাকা গজের কাপড় দিয়ে শার্ট করে দিয়েছিলাম। শার্টতাে কোনােদিন পরেনইনি, উপরন্তু এ নিয়ে আমাকে প্রচুর তিক্ত কথা শুনিয়েছেন। ঈদ-পর্বে আমাদের বাসায় কাজের লােক থাকলে তাদের জামাজুতাে সবই হতাে। কিন্তু নিজেদের কখনও এসব হতাে না। দেখেছি, অনেক উচ্চপদস্থ লােকের ‘কল’ প্রত্যাখ্যান করতে, কিন্তু রাত-দুপুরে কোনাে সাধারণ। কর্মচারী কিংবা অসুস্থ ছাত্রের জন্য ত্বরিৎগতিতে চলে যেতেন।
 ১৯৭০ সালের শেষ দিকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাের্তজা। গ্রামের সাধারণ মানুষকে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করা আর তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া ছিল তার উদ্দেশ্য। ওই সময় টঙ্গি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলন ছিল বেশ শক্তিশালী। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাকে টঙ্গি থাকার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার সম্ভাবনা দেখে আব্দুর রাজ্জাকের কথায় তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েননি।
তাঁর স্ত্রী সাঈদা মাের্তজা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করেছেন। তারা তখন থাকতেন ফুলার রােডের আবাসিক এলাকায় ১৪/১ ভবনে। এই দম্পতির দুই সন্তান- বড় মেয়ে দ্যুতি অরণি এবং ছােট ছেলে অর্ণব নীলিম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর দিকে অর্ণব নীলিমের জন্ম। ২৫ মার্চের পাকবাহিনীর গণহত্যার পর ২৭ মার্চ স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মাের্তজা ফুলার রােডের বাসা ছেড়ে চলে যান গ্রিন রােডে সাঈদা মাের্তজার এক ভাইয়ের বাসায়। সপ্তাহ দেড়েক পরে সবাইকে নিয়ে আবার ফুলার রােডের বাসায় ফিরে আসেন। চারপাশের পরিস্থিতি দেখে সাঈদা ভয় পেতেন। আর সাঈদার ভয় দেখে মাের্তজা রসিকতা করে গান গাইতেন- ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি আহত মুক্তিযােদ্ধাদের ঔষধপত্রসহ চিকিৎসাসেবা এবং আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায়। এতে সাঈদার ভয় আরও বেড়ে যায়। তিনি মাের্তজাকে বাসা ছাড়তে বললেন। মাের্তজা বললেন, “ওঁদের ছেড়ে দেয় কি-না তা আগে দেখি। ছেড়ে না দিলে চলে যাব।” এর কয়েকদিন পর শিক্ষকরা ছাড়া পেলেন। এতে মাের্তজার সাহস বেড়ে যায়। স্ত্রীকে বললেন, “হয়তাে এখন পাকবাহিনী যা ইচ্ছে তা করবে না। শিক্ষকদের ভালােভাবে ছেড়ে দিল দেখে মনে হচ্ছে ওরা পলিসি পরিবর্তন করেছে। কিছুদিন পরেই তার মনে হয়েছিল পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে সুযােগ আর তিনি পাননি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৮টা। মাের্তজার ফুলার রােডের বাসার সামনে এসে থামল কাদামাখা একটি বাস। বাস থেকে লাফিয়ে নামল কাপড়ে মুখ ঢাকা সাত-আটজন রাইফেলধারী আলবদর, ঢুকে গেল তারা মাের্তজার বাসায়। মাের্তজার তখনও সকালের নাশতা হয়নি। আলবদর সদস্যরা মাের্তজার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে মেয়ে অরণির ওড়না দিয়ে তার চোখ দুটো বেঁধে ফেলে। সাঈদা সামনে এসে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। আলবদর বাহিনী মাের্তজাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর (কোনাে কোনাে সূত্রে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর) তার গলিত মৃতদেহ মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। তাঁর মেয়ের ওড়না দেখে ডা. মাের্তজার লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
মৃত্যুর আগে তার মনােভাব কেমন ছিল সে সম্পর্কে সাঈদা মাের্তজা লিখেছেন : ৭১-এর ডিসেম্বরে যখন চূড়ান্ত যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে তখনও তার কোনাে ভয় ছিল।  আমাকে বলতেন, “যুদ্ধ একটা জাতীয় প্রয়ােজন। যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জাতির চরিত্র তৈরি হয়। তাই আমি চাই যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমি মরে যাব, আমার ছেলে প্রাণ দেবে, তার ছেলে এভাবে একদিন সত্যিকারের মানুষ তৈরি হবে। এবং তারাই একদিন এদেশকে সুন্দর করবে, শােষণমুক্ত করবে।” কত আশা ছিল। তার একদিন এদেশে সত্যিকারের স্বাধীন হবে- অর্জন করবে অর্থনৈতিক মুক্তি। আমি বলতাম, “তােমার আকাশ-কুসুম চিন্তা কোনােদিন বাস্তবে রূপ পাবে না।” তাঁর বড় আশা ছিল ভবিষ্যতের বংশধরদের উপর।  তার একটি অমূল্য কথাই এখনও বুকে লালন করে বেঁচে আছি- “ একজন মানুষ ক্ষয় হয়ে যাবে; কিন্তু তার চিন্তার কোনাে ক্ষয় নেই, চিন্তার কোনাে মৃত্যু নেই।” (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জনের একটি আলবদর দল ডা. মাের্তজাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। ১৬ ডিসেম্বরের পর মিরপুর বধ্যভূমি থেকে সিরাজুল হক খান ও ফয়জুল মহী ছাড়া বাকি ছয়জনের লাশ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মােহাম্মদ মাের্তজাসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২’।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা