You dont have javascript enabled! Please enable it!
মােহাম্মদ ফজলে রাব্বী
মােহাম্মদ ফজলে রাব্বীর জন্ম ১৯৩২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার হেমায়েতপুর থানার ছাতিয়ানী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আফসার উদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম সুফিয়া খাতুন। আফসার উদ্দিন আহমেদ সরকারি চাকরি করতেন। চার ভাই ও চার বােনের মধ্যে ফজলে রাব্বী ছিলেন সবার বড়। তার ডাকনাম ছিল ঠান্টু। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন ফজলে রাব্বী। তিনি ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় বিশিষ্ট স্থান দখল করে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ভি. পি. আই. ও জেলাভিত্তিক বৃত্তি পান। তার পরবর্তী শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঢাকা কলেজে। আই. এসসি. পাস করে ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তিনি এম, বি, বি, এস,-এ প্রথম পর্বের পরীক্ষায় অ্যানাটমি ও ফার্মাকোলজিতে সম্মান লাভ করেন। তিনি এম, বি. বি. এস. চূড়ান্ত পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অধিকার করেন এবং সারা পাকিস্তানে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৫০-৫৫ সাল পর্যন্ত ছাত্র থাকাকালে প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রসেক্টর হন। ফজলে রাব্বী ১৯৫৫’৫৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহকারী সার্জন  হিসাবে যােগ দেন। ১৯৫৯-‘৬০ সালে তিনি মেডিসিনে রেজিস্ট্রার পদে উন্নীত হন।
কলম্বাে প্ল্যানের অধীনে উচ্চশিক্ষার জন্যে ১৯৬০ সালের মার্চে তিনি ইংল্যান্ডের এডিনবরায় যান। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি কার্ডিওলজিতে এম, আর, | সি, পি, ডিগ্রি লাভ করেন। ফজলে রাব্বী ১৯৬২ সালের প্রথম দিকে ইন্টারনাল মেডিসিনে এম, আর, সি, পি. ডিগ্রি অর্জন করেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে দুটি বিষয়ে এম, আর, সি, পি. ডিগ্রি অর্জনের ঘটনা লন্ডনের রয়্যাল কলেজের ইতিহাসেও রেকর্ড। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে তিনি লন্ডনের হ্যামারস্মিথ হাসপাতালে সিনিয়র রেজিস্ট্রার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৩ সালের ১ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং মার্চ মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সহযােগী অধ্যাপক হিসাবে যােগ দেন। অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিনের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এ সময় প্রফেসর অব কার্ডিওলজি’র দায়িত্বও তিনি পালন করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ফজলে রাব্বী দেশের একজন বিশিষ্ট হৃদরােগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। শুধু দেশের নয়, উপমহাদেশের অসংখ্য মানুষ তার কাছে দুরারােগ্য রােগের চিকিৎসার জন্য আসতেন।
গানবাজনা ও কবিতা খুব পছন্দ করতেন ফজলে রাব্বী। ফটোগ্রাফি ও টাইপিংয়ের দিকে ঝোক ছিল তার। পছন্দ করতেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়। নিয়ে পড়তে। প্রচুর বই কিনতেন, আর লেখালেখির প্রতিও আগ্রহ ছিল খুব। অধ্যাপনা, চিকিৎসা এবং অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি গবেষণার কাজও করেছেন। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধগুলাে সেই সময়ে আলােড়ন তুলত, যার ভেতর অন্যতম ছিল “Spirometry in Tropical Pulmonary Eosinophilia and A Case of Congenital Hyperbilirubinaemia (Dubin-Johnson Syndrome)’ 4919T TOPIC তার প্রচুর গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ফজলে রাব্বী মেডিসিন বিষয়ে। একটি পাঠ্যবই লিখেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি।
ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছিলেন ফজলে রাব্বী। কিন্তু বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বসে থাকার ছাত্র তিনি ছিলেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ই তিনি। ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হন এবং বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ওই সময় থেকেই তিনি বামপন্থি রাজনীতির সাথেও যুক্ত হয়ে পড়েন। সাম্যবাদী। ভাবাদর্শ তাঁর চিন্তা-চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একদিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে লড়াই, অন্যদিকে একটি গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই করে গেছেন ডা. মােহাম্মদ ফজলে রাব্বী। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি শহীদ মিনারে এক সমাবেশে গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “চিকিৎসা সেবা গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে।”
প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও জনদরদি চিকিৎসক হিসাবে জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন ফজলে রাব্বী। তাঁর মতাদর্শ এবং ব্যক্তিগত জীবনাচরণের কারণে স্বাধীনতাকামী তরুণ চিকিৎসক সমাজের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনুকরণীয় আদর্শ। ১৯৭০ সালে ফজলে রাব্বী ‘Pakistan best professor award’-এর জন্যে নির্বাচিত হন। কিন্তু পশ্চিমাদের শােষণের প্রতিবাদে তিনি সেই পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান। এই ঘটনার কারণে তিনি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর শত্রুতে পরিণত হন। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার পর ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্যে কারফিউ স্থগিত হলে ডা. রাব্বী তার স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাসা থেকে। চলে আসেন তার প্রিয় মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা আর কালরাত্রির নৃশংসতা নিজের চোখে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন, দেশের সঙ্কটে কিছু করতে হবে। যে কারণে পরবর্তী ৯ মাস তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করেছেন। দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনেক সুযােগ থাকা সত্ত্বেও একটিবারের জন্যেও সে কথা না ভেবে কাজ করে যান দেশের জন্যে। গােপনে গােপনে তিনি ঢাকার গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা, ওষুধপত্র এবং টাকা-পয়সা দিয়ে সহযােগিতা করেছেন।
ফজলে রাব্বীর একমাত্র ছেলে টিংকুর বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। এই কিশােরও মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে গিয়েছিল। প্রায় দুমাস পরে ফজলে রাব্বী গিয়ে। তাকে সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনেন। সে সময় তাঁর বাসায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই আসতেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ডা. আলীম চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সেনাসহ রাজাকার-আলবদরের একটি দল ডা. ফজলে রাব্বীকে তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বর দিনের বেলায় তাঁর ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ডাক্তার ফজলে রাব্বীর শহীদ হওয়া সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী ডাক্তার জাহানারা রাব্বীর লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন : ১৫ ডিসেম্বর। বিকেল ৪টা। আর একটু পেছন থেকে বলছি। ১১ ডিসেম্বর। আমি অফিসে গিয়ে দেখি দুই-তিনজন ছাড়া কেউ নেই। সারা অফিস খালি। আমি হাসপাতালে তার কাছে গেলাম। আরও কয়েকজন প্রফেসর বসেছিলেন। ইতস্তত করে কথাটা বললাম, “দেখুন সবাই বলছে তাড়াতাড়ি শহর ছেড়ে চলে যেতে। আর বােধহয় থাকা ঠিক হবে না। বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে আমি আবার তাকে বললাম, “দেখাে গাে, কোথাও যেতে হয়।” তিনি বললেন, “আচ্ছা। দেখি কারও সঙ্গে আলাপ করে। আজ বিকেলে কিছু ঠিক করা যাবে।” হাসপাতাল থেকে প্রায় রােগীরা বিদায় নিচ্ছে তখ ন ঢাকায় তখন কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। সেদিনই হঠাৎ বেলা ৩টার সময় কারফিউ জারি হলাে।
আমি চমকে উঠলাম। “টিংকুর আব্বা, ওরা কি জানে আমরা পালাবাে আজ?” আমি প্রশ্ন করলাম। ডা. রাব্বী বিমূঢ় হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। “যুদ্ধের সময় পৃথিবীর কোথাও কোনাে কারফিউ দেওয়ার রীতি নেই। এবার হয়তাে ওরা আমাদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে মারবে।” স্বামী বললেন। ১২ তারিখ কারফিউ উঠলাে না; ১৩ তারিখ দুই ঘণ্টার জন্য উঠলাে। ১৪ তারিখ। উঠলাে না। ১৫ ডিসেম্বর কয়েকজন প্রফেসরের বাড়িতে তিনি ফোন করলেনবেশিরভাগ লােকদেরই তিনি বাড়িতে পেলেন না। ঢাকার প্রায় টেলিফোন তখন অকেজো। অসম্ভব ভয় লাগছিল আমার ভয়ে সিটিয়ে আসছি তখন। ঝকে ঝাকে ঝলকে ঝলকে আকাশে প্লেন আসছে। রকেট ফেলছে, শেল পড়ছে। হঠাৎ। বেলা ১০টার দিকে শােনা গেল কারফিউ উঠেছে দুই ঘণ্টার জন্যে। তিনি গাড়ি নিজে বের করে পুরান ঢাকায় যাবেন এক অবাঙালি রােগী দেখতে। আমি পেছনে পেছনে নেমে এলাম। একতলায়, বললাম- “যেয়াে না তুমি, ও তাে অবাঙালি।” তিনি হাসলেন। হাসি ছাড়া তিনি কথা বলতেন না। “ভুলে যেয়াে না সে মানুষ।” আমি আবার বললাম- “তুমি যে বলাে আজই ওরা আত্মসমর্পণ করবে। তাে। মিরপুর, মােহাম্মদপুরের লােকদের আমরা ক্ষমা করতে পারবাে?” গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে তিনি বললেন, “আহা! ওরাও তাে মানুষ। তাছাড়া ওদের দেশ নেই।” আমি বললাম, “কিন্তু এতাে সবের পর ওদেরকে ক্ষমা আমরা কেমন করে করবাে?” “হ্যা, ক্ষমাও করবে এবং আমাদের স্বাধীন দেশে থাকতেও দেবে।’ স্বাধীন বাংলার এতাে স্বপ্ন দেখতেন ডা. রাব্বী। দেশকে এতাে ভালােবাসতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এতাে সাহায্য করেছিলেন আমার স্বামী।
 বােমা পড়ছে, যুদ্ধ চলছে। রেডিওতে বিভিন্ন ভাষায় ইন্ডিয়ান আর্মি স্টাফ জেনারেল মানেকশয়ের আত্মসমর্পণের আহ্বান এক অজানা সর্বনাশা ভয়ে আমি কুঁকড়ে আসছি। দুপুরে আমি তাকে অনুরােধ করলাম- “চলাে এখন যাই। একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।” অ্যাম্বুলেন্সের জন্য তিনি ফোনও করেছিলেন। পরে বললেন “আচ্ছা দুপুরটা একটু গড়িয়ে নিই।” আমার মুখে কোনাে কথাই জোগালাে না। আমি আস্তে আস্তে কেমন যেন নির্জীব হয়ে আসছিলাম। বিকাল চারটা। আমাকে একটা লিব্রিয়াম খাওয়ালেন। হেসে ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন, “দেখাে তােমার আম্মা কেমন ভয়ে নীল হয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি প্লেন থেকে রকেট পড়া দেখছিলেন। আমি ডাকলাম, “ঘরে আসাে। স্প্রিন্টার ছুটে এসে লাগতে পারে।” আমি খাটে শুয়ে। তিনি মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ডান হাত আমার বাঁ গালে রাখলেন। হেসে বললেন, “মনি ভয় পেয়াে না। এই তাে স্বাধীন হয়ে গেলাে।”   বাবুর্চি এলাে- ফিসফিস করে বলল, “সাহেব বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরাগাড়ি।” তিনি সােজা সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম। হ্যা- বহু রাজাকার, আলবদর, আর্মি। একটা সাদা কাদা মাখানাে মাইক্রোবাস, একটি জিপ। তিনি নিচু গলায় পেছনে না ফিরেই বললেন, “টিংকুর আম্মা, আমাকে নিতে এসেছে।” আমি মুহূর্তে দৌড়ে গিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে ওদের শােবার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করলাম।
কাছের এক বাড়ির ভদ্রলােক বারান্দায় ছিলেন, তাকে চিক্কার করে ডাকলাম। তারপর দেখলাম আশপাশের সব দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে গেলাে। আমি দৌড়ে সামনের বারান্দায় এলাম। ইতােমধ্যে ডা. রাব্বী দারােয়ান ইদ্রিসকে ডেকে তালা বন্ধ করে সদর দরজা ও সিড়ির দরজা খুলে দিতে বলেছিলেন। এসে দেখলাম তিনি ওদের সঙ্গে হাঁটতে  শুরু করেছেন। চারদিক থেকে পাঁচ-সাতজন সশস্ত্র সৈন্য তাঁকে ঘিরে আছে। তিনি নামতে শুরু করলেন সিড়ির দরজা পেরিয়ে আমি দৌড়ে গিয়ে বাধা দিতে চেষ্টা করলাম। হল্ট’ বলে দুজন এগিয়ে এসে আমার বুকে বন্দুকের নল চেপে ধরলাে- আমি স্থাণুর মতাে দাড়িয়ে গেলাম। আমি দেখলাম পেছন থেকে তিনি মাথা উঁচু করে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলাে। ওরা আমার বুক থেকে বন্দুক নামালাে।
তখন বেলা চারটা- ১৫ ডিসেম্বর। কয়েক মিনিটের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তারপর টেলিফোন করতে লাগলাম চারদিকে পাগলের মতাে। অবশেষে কর্নেল হেজাজী স্বীকার করলেন, “ডা, ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী ও ইউনিভার্সিটি থেকে বিশজন প্রফেসরকে নিয়েছি। রাজনৈতিক অপরাধবশত। কাল সকালে দেখা যাবে।” কাল সকাল আর তাঁদের জীবনে আসেনি। ১৬ ডিসেম্বরের সূর্যলাল আকাশ তাদের জন্য ছিল না। ১৫ ডিসেম্বর দিনগত রাত তিনটায় লালমাটিয়া ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ট্রাকে তুলে এদেরকে রায়ের বাজারের ইটখােলায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে সে সময়ে খুন করা হয়। একটা ছেলে যে বেঁচে আসতে পেরেছিল সে-ই পরে এসে একথা আমাকে বলে গিয়েছিল- গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই ‘টিংকুর আম্মা’ বলেই তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। আর সে রাত দশটায় ডা. রাব্বীকে প্রশ্ন করেছে পাক আর্মি, “তুমি ডা, রাব্বী?” “হ্যা।” “কত টাকা দিয়েছিলে মুক্তিযােদ্ধাদের?”
“আমি সরকারি চাকুরে, তাদের আমি কোনাে আর্থিক সাহায্য করিনি।” ধীর শান্ত উত্তর। অনেকে কেঁদেছে বন্দিদের মধ্যে, প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। তিনি অবিচলভাবে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছেন। মাথা নােয়াননি। “আমাদের যখন মেরেই ফেলবে তাে ওদের সঙ্গে কথা বলা বৃথা।” তিনি বলেছিলেন শান্তস্বরে। এই আমার স্বামী।  ১৮ ডিসেম্বর। অবশেষে তাঁর মৃতদেহ খুঁজে বাড়ি আনলাে আমার এক আত্মীয়। হ্যা, তিনি ঘুমিয়ে আছেন শান্তিতে। মুখটা ডানদিকে একটু হেলানাে। বা দিকের গালের হাড়ে ও কপালের বাঁ পাশে বুলেটের ছিদ্র। সারাটা বুকে বহু বুলেটের চিহ্ন- কত আমি গুনিনি। তবে একথা মিথ্যে যে তার বুক কেটে ফেলা হয়েছিল। আমি সে বুক দুহাতে ধরে দেখেছি। (স্মৃতি : ১৯৭১, প্রথম খণ্ড) উল্লেখ্য, পাবনা মেডিকেল কলেজ থেকে ডা. ফজলে রাব্বীর বাড়ি ছাতিয়ানি গ্রামের দূরত্ব মাত্র ১০০ গজ। ২০০৮ সালে পাবনা মেডিকেল কলেজ উদ্বোধনের দিনে বিখ্যাত সাংবাদিক রণেশ মৈত্র মেডিকেল কলেজটির নাম ‘শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী মেডিকেল কলেজ রাখার দাবি তুলেছিলেন। রণেশ মৈত্রসহ আরও অনেকেই এ দাবিতে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করেছেন। কিন্তু এ দাবিটি এখনও উপেক্ষিত। শহীদ ফজলে রাব্বীর স্ত্রী ডা. জাহানারা রাব্বী ২০০০ সালের ২৫ মে মারা গেছেন। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!