মােয়াজ্জেম হােসেন
মােয়াজ্জেম হােসেনের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, পিরােজপুর জেলার ডুমুরতলা গ্রামে। তার বাবা মােফাজ্জেল হােসেন সরকারি কর্মকর্তা, মা লতিফুননেছা বেগম গৃহিণী। মােয়াজ্জেম হােসেন ১৯৪৭ সালে বাগেরহাটের কচুয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি বাগেরহাট কলেজে আই, এসসি,-তে ভর্তি হন। কিন্তু প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে সেখানে আর পড়তে পারেননি। পরে তিনি বরিশাল ব্রজমােহন কলেজে ভর্তি হন ও সেখান থেকে আই, এসসি, পাস করেন। মােয়াজ্জেম হােসেন ১৯৫০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যােগ দেন। নৈপুণ্য ও দক্ষতা প্রদর্শন করায় ১৯৫১ সালে তাকে ইংল্যান্ডে নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির জন্য পাঠানাে হয়। প্রায় ৭ বছর তিনি ইংল্যান্ডের রয়াল নেভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশােনা করেন এবং সেখানকার সব পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে পাস করেন। ১৯৫৭ সালে মােয়াজ্জেম দেশে ফিরে আসেন এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সুপারিশে তাঁকে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন দেওয়া হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে এক বছর চাকরি করার পর নৌবাহিনী সংক্রান্ত কারিগরি বিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে আবার তিনি ইংল্যান্ড যান। মােয়াজ্জেম হােসেন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ১৯৫৯ সালে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত তিনি করাচিতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদর দফতরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৬ সালের ১ মে তাকে চট্টগ্রাম নেভাল বেসে বদলি করে প্রধান প্রকৌশলী পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৭ সালের মার্চে তিনি ডেপুটেশনে পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের চাকরিতে যােগ দেন এবং তার নিয়ােগ হয় বরিশাল শাখায়। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিকালে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে সুযােগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বৈষম্য লক্ষ করে তিনি ক্ষুব্ধ হন। একপর্যায়ে বাঙালি অফিসার ও সেনাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করতে শুরু করেন। এর ফলে তিনি পাকিস্তানি, বিশেষত পাঞ্জাবিদের বিরাগভাজন হন। ওই সময় মােয়াজ্জেম সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে একটি ‘গুপ্ত বিপ্লবী সেল গঠন করেন। এই গােপন সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা সদস্যদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দীক্ষা দেওয়া এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা। এই পরিকল্পনা একসময় ফাস হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের একটি দল পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে মােয়াজ্জেম হােসেনকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে ফৌজদারি আইন সংশােধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নামে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ গঠন করে। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত ওই মামলার ৩৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন ছিলেন দ্বিতীয় আসামি।
মােয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালের শুরু থেকে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৌবাহিনীতে অবস্থানরত বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলা, সেনা ও বিমান বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা, কার্যক্রম সফল করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সিভিল সার্ভিসের বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গােপন বৈঠক এবং সংগঠন পরিচালনার তহবিল সংগ্রহ করার অভিযােগ তােলা হয়। প্রবল গণআন্দোলনের চাপে আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে অন্য বন্দিদের সাথে মােয়াজ্জেম হােসেনও মুক্তি পান। তিনি পুনরায় চাকরিতে যােগ দেন এবং ১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ চাকরি থেকে অবসর নেন। অবসর নেওয়ার পর মােয়াজ্জেম প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। ১৯৭০ সালের ২৪ মার্চ তিনি ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ঘােষণা দেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ২৮ মার্চ লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেন। এ লক্ষ্যে তিনি লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন, এক দফা ইত্যাদি পুস্তিকা লেখেন। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মােয়াজ্জেম হােসেন লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটিকে হিসাবে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করেন।
মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের সময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে যে-কোনাে ধরনের সমঝােতার পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেন এবং এ উদ্দেশ্যে ১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর, যশাের, কুষ্টিয়া সফর করেন। অকুতােভয় এই বাঙালি বীরসেনানীকে ২৬ মার্চ ভােরে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা। তার ৩৬ এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, “আমি বাংলাদেশ স্বাধীন চাই।” তার মরদেহ পাকিস্তানি সেনারা সাথে করে নিয়ে যায়। শােনা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর টিক্কা খান নিজে তার মরদেহ দেখে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তার স্ত্রী কোহিনূর হােসেনের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন : ২৫ মার্চ বিকেল থেকেই আমার স্বামী চঞ্চল ছিলেন। রাত সাড়ে ৯টা-১০টার। দিকে আমার এক কাজিন তাকে ফোন করে। তিনি তার সঙ্গে কথা বলে শার্ট গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আমাদের বাড়ি ছিল তিনতলা। আমরা নিচতলায় থাকতাম। দেখলাম রাস্তায় অনেক লােক দাড়িয়ে। রাত পৌনে ১২টা। হবে, এমন সময় দূরে ফায়ারিংয়ের আওয়াজ হলাে। তখন লােকজন মেইন রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে চলে গেল। এ সময় তিনি আমাকে বাচ্চাদের নিয়ে দোতলায় যেতে বলেন। আমি বাচ্চাদের নিয়ে দোতলায় যাই। আমার স্বামী নিচেই থাকলেন।
রাত ১টার দিকে তিনি দোতলায় আসেন। এর আগেই ব্ল্যাক আউট হয়ে। গেছে। রাত ১২টার পর থেকে ট্যাংক চলার ও গােলাগুলির শব্দ শােনা যাচ্ছে। সারা রাতই এভাবে কাটল। ভীষণ ফায়ারিং ও চারদিকে আগুন। খুব ভােরবেলা অন্ধকার থাকতেই উনি ড্রয়িংরুমে গিয়ে সােফায় চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসলেন। তার খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। কাজের লােক নাশতা তৈরি করছিল। এমন সময় কতগুলাে জিপ গাড়ি ও বুটের আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অনেক আর্মি অস্ত্র তাক করে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়ানাে। শব্দ শুনে আমার স্বামীর তন্দ্রাভাব কেটে গেল। আমি তাকে বললাম, আর্মি ঘিরে ফেলেছে। আমাদের বাসা। তিনি ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেলেন অন্যদিকে। কিন্তু পালানাের তাে পথ নাই। চারদিকে আর্মি ঘিরে ফেলেছে।
তিনি কোথাও লুকিয়ে ছিলেন। আর আর্মিরা তাঁকে খুঁজছিল। তাকে না। পেয়ে তারা চেঁচিয়ে বলে, “মিসেস মােয়াজ্জেম কোথায়?” এটা তিনি শুনেছিলেন আর বােধহয় ভেবেছিলেন, আমি আমাকে টর্চার করতে পারে। তখন তিনি বেরিয়ে নিচে গিয়ে বলেন, “আমিই কমান্ডার মােয়াজ্জেম।” আমি প্রথমে তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। ওরা তাঁকে উর্দুতে কয়েকবার বলেছে, “বল, পাকিস্তান। জিন্দাবাদ।” তিনি বলেছেন, “না, আমি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলব না। আমার এক দফা, বাংলাদেশ স্বাধীন চাই।” তখন ওরা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়েও বলেছেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন চাই।” এটা আমি নিজ চোখে দেখিনি। পরে। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি। এদিকে এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দোতলার জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি । আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। এ সময় কয়েকজন আর্মি এল। তারা তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। তার দুই পা ও হাত ধরেছে। মাথাটা ঝুলছে। গােটা শরীর রক্তে একদম ভরা। এ দৃশ্য দেখে আমি চিঙ্কার দিয়ে উঠি। আমি আমার স্বামীর ডেডবডি পাইনি। পরে শুনেছি, পাকিস্তানি আর্মিরা আমার স্বামীর লাশ তখনকার গভর্নর হাউস, এখন যেটা বঙ্গভবন, সেখানে নিয়ে। গিয়েছিল টিক্কা খানকে দেখানাের জন্য। তারপর তার লাশ কী করেছে জানি না। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড)
মৃত্যুর সময় মােয়াজ্জেম স্ত্রী, এক মেয়ে ও দুই ছেলে রেখে যান। তার ছােট ছেলে বাবার নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে নির্বাক ও পঙ্গু হয়ে যায়। এক ছেলে ইতােমধ্যে মারা গেছেন। শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন স্মরণে ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাটির নামকরণ করা হয় ‘বি. এন, এস, শহীদ মােয়াজ্জেম’। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেছে ‘শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন সড়ক।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা