You dont have javascript enabled! Please enable it! মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক
মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী
শিক্ষাবিদ মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর জন্ম ১৯২৬ সালের ২২ জুলাই নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার খালিশপুর গ্রামের মিয়াবাড়িতে। তাঁর বাবা বজলুর রহিম চৌধুরী এবং মা মাহফুজা খাতুন উভয়েই ছিলেন শিক্ষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত। এই দম্পতির ছিল পাঁচ সন্তান। বজলুর রহীম ছিলেন সেকালের ম্যাট্রিকুলেট, তিনি সাহিত্য অনুরাগীও ছিলেন। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধে যােগ দিয়ে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পদক পেয়েছিলেন। মাত্র নয় বছর বয়সে মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তার বাবাকে হারান। এ অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরােধ শুরু হলে তার মা চলে যান নিজের বাবার বাড়িতে। যে কারণে মােফাজ্জল হায়দারের শৈশব ও কৈশাের কেটেছে মামার বাড়িতে। শৈশবে নােয়াখালীর বিভিন্ন স্কুলে পড়লেও মােফাজ্জল। হায়দার চৌধুরীর স্কুল জীবনের শেষ চার বছর কেটেছে নােয়াখালী আহমদিয়া হাই ইংলিশ স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন মােফাজ্জল হায়দার। এরপর তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে বাংলায় (সম্মান) ভর্তি হন। কিছুদিন পর এই কলেজ ছেড়ে ১৯৪৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু বাংলা বেশি ভালােবাসতেন বলে শান্তিনিকেতনে চলে যান ও সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুসারে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাভবনে বাংলা সাহিত্যে সম্মান পড়ার সুযােগ পান। ১৯৪৬ সালে তিনি নন-কলেজিয়েট পরীক্ষার্থী হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এ সাফল্যের জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘সুরেন্দ্রনলিনী স্বর্ণপদক’ দিয়েছিল। কৃতী ছাত্র হিসাবে মােফাজ্জল হায়দারের বরাবরই খ্যাতি ছিল। তিনি জীবনের সকল পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
১৯৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম, এ, পড়েন। কলকাতায় তখন দাঙ্গা পরিস্থিতি। এ অবস্থায় ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র-ভবনের বৃত্তি পেয়ে সেখানে ফিরে যান। ১৯৪৮ সালে শান্তিনিকেতনের লােকশিক্ষা সংসদের সাহিত্য ভারতী’ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন। এ সময় তিনি অধ্যাপক প্রবােধ চন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্র সাহিত্যে গবেষণা করছিলেন। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমােদন না থাকায় শান্তিনিকেতনের সাহিত্য ভারতী’ উপাধি এম. এ. ডিগ্রির সমমানের বলে গণ্য করা হতাে না। | শান্তিনিকেতনের শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে পাণ্ডুলিপি রচয়িতা হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৫০ সালে তিনি তঙ্কালীন জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যােগ দেন। তিনি এ সময় সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে (বর্তমান নটরডেম কলেজ) খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. প্রথম ও শেষ পর্ব পরীক্ষায় অংশ নেন। এই দুটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম পর্বে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম এবং শেষ পর্বে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। 
মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে বৃত্তি পেয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্যে যান। সেখানে দুই বছর গবেষণার পর তিনি কথ্য বাংলার শব্দের ছন্দোবিজ্ঞানের ওপর একটি অভিসন্দর্ভ লেখেন (Some SupraSegmental Phonological Features of Bengali-1959)। কিন্তু তার গবেষণার ধরন তঙ্কালীন মার্কিন ধারার ভাষাবৈজ্ঞানিক গবেষণাপন্থার অতিমাত্রায় অনুসারী ছিল বলে এই অভিসন্দর্ভটি প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমি থেকে এটি প্রকাশ করা হয়। পরের বছর, ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে আবারও ‘স্যার আশুতােষ স্বর্ণ পদক’ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ১০০ বছরের ইতিহাসে তার মতাে এত বেশি নম্বর পেয়ে কেউ বাংলা সাহিত্যে সম্মান ডিগ্রি পায়নি।  ১৯৬৪ সালে মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাষাবিজ্ঞান পড়ার জন্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোনাে এক কারণে তাঁর এ চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৭০ সালে তকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ড রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে তাকে সংবর্ধনা দেয়। একই বছরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা রিডার (পরবর্তীতে এ পদের নাম বদলে সহযােগী অধ্যাপক করা হয়) পদে নিযুক্ত হন।
শৈশবে বাবাকে হারানাের কারণে অনেক প্রতিকূলতা মােকাবেলা করেই বড় হতে হয়েছে তাঁকে। স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচটি সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব পড়ে মা মাহফুজা খাতুনের ওপর। এর সাথে যােগ হয় পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে উত্তরাধিকারীদের লড়াই। এসব ক্ষেত্রে মাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তিনি। ঢাকায় উচ্চ মাধ্যমিক বা কলকাতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ার সময় বারবার পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাঁকে ছুটে যেতে হয়েছে নােয়াখালীর খালিশপুরে। ছােট ভাই ও বােনদের লেখাপড়া ও অন্যান্য সহযােগিতার দায়িত্বও তাকেই নিতে হয়েছে। ১৯৫৬ সালে তাঁর সাথে সৈয়দা তাহমিনা মনােয়ারা নুরুন্নাহারের বিয়ে হয়। তাদের সংসারে সুমন ও শােভন নামে দুই ছেলের জন্ম হয়। মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন একই সাথে সৃজনশীল ও মননশীল প্রতিভার অধিকারী। অন্য অনেকের মতাে কিশাের বয়সে কবিতা দিয়েই তার সাহিত্যচর্চা শুরু। অনেক কবিতা, গল্প ও নাটক তিনি লিখেছেন। রক্ষণশীল এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও সাহিত্যরসিক বাবার প্রভাব পড়েছিল তার ওপর। এছাড়া ছােটবেলা থেকেই জগৎ ও জীবনের জটিল রহস্য তার মনকে আন্দোলিত করেছে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘রঙীন আখর” বইতে তাঁর সেই চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। গল্প, কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধ, গান, ভাষা বিষয়ক গবেষণা মিলিয়ে তাঁর রচনার সংখ্যা একেবারে কম নয়। কিন্তু প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালােচনাতেই তার প্রতিভা সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে। অধ্যাপকের মতাে অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ তিনি লেখেননি। তিনি লিখেছেন প্রাণসঞ্চারী লেখা। সাহিত্য তিনি ভালােবাসলেও সাহিত্য রচনা তার কাছে মুখ্য ছিল না। তার কাছে মুখ্য ছিল বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষ, বাংলার ঐতিহ্য, বাঙালির উন্নতি। সেজন্য গল্প, কবিতা, নাটকের আশ্রয়ে নয়, সরাসরি ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম প্রবন্ধকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। গবেষণা কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৭১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ ছিল তার অধ্যয়ন ও চিন্তাচেতনার প্রধান অংশ। শান্তিনিকেতনের ছাত্র হওয়ায় এবং রবীন্দ্র-বলয়ের মধ্যে দীর্ঘকাল কাটানােয় শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার প্রথম উল্লেখযােগ্য গ্রন্থও তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই- ‘রবি পরিক্রমা (১৯৬৩)। রবীন্দ্রনাথকে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন, তা তিনি এই বইতে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বইটির নিবেদন অংশে বলেছেন, “অন্য লােকরা কী বলেন, তার সার সংকলন করে আমার লাভ কী? তাতে আমার বক্তব্যের কিছু মর্যাদা বা গুরুত্ব বাড়ে বলে তাে আমার মনে হয় না।” এছাড়া তার প্রকাশিত বইগুলাের মধ্যে বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার (১৯৬২), ‘সাহিত্যের নব রূপায়ণ (১৯৬৯), Colloquial Bengali’ (১৯৫৯) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও তার প্রচুর অপ্রকাশিত রচনা ছিল। এগুলাে সাহিত্য-বিষয়ক গবেষণা, ব্যক্তিগত ও সৃষ্টিশীল রচনা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা, চিঠি ও ভাষাবিজ্ঞান- এ ছয়টি ভাগে ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে ভাষাবিজ্ঞানী মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান কর্তৃক সঙ্কলিত ও সম্পাদিত ‘মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর রচনাবলী” শিরােনামে তিন খণ্ডে বই আকারে ১৯৭৮, ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়।
ব্যক্তিজীবনে মােফাজ্জল হায়দার ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং পরিশীলিত রুচির অধিকারী। শৃঙ্খলাবােধ ও নিরন্তর সাধনা ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র । সাহিত্যের পাশাপাশি চিত্রকলায় ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায় প্রমুখ বিশ্বখ্যাত শিল্পীর সাহচর্য চিত্রকলায় তার আগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছিল। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি গভীর সমবেদনা থাকলেও বহু মানুষের সংসর্গ এবং কোলাহল থেকে দূরে থাকতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। যদিও বাঙালির অধিকার আদায়ে সংগ্রামে তিনি চিন্তায় ও কর্মে সবসময় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকেছেন। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় বাংলা সাহিত্যকে ইসলামীকরণের একটা চক্রান্ত তীব্র হয়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে হিন্দু লেখকদের অবদান বাদ দেওয়ার মতাে সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিরুদ্ধে সে-সময় দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সামগ্রিক ঐতিহ্য রক্ষায় তিনি লেখায় ও বক্তৃতায় সােচ্চার ছিলেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার লক্ষ্যে বলেছেন, “আজকালকার সংঘাত ধনী আর নির্ধনে, দ্বীনদার আর বেদ্বীনে নয়।” শাসক ও রাজনীতিকরা যখন ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা নিয়েছে, তখনই জাতিকে সচেতন করে দিতে মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলেছেন, “আমরা আধুনিক যুগের, বিংশ শতাব্দীর নাগরিক। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে দেখতে চাই আধুনিক রাষ্ট্ররূপে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাঁওতা দিয়ে আমাদের কেউ আধুনিক রাষ্ট্রের সুযােগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে এ আমরা সহ্য করব কেন?”
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সমাধানের উপায় তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখেছেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণে। শিক্ষার্থীদের শুধু বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাই হয়, তার মনে যে অন্যান্য সুকুমার বৃত্তি থাকে সেগুলাের বিকাশ হয় না। এজন্য শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠে না। তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনকে পরিপূর্ণ করে তােলার জন্যে তার বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি অন্যান্য সুকুমার বৃত্তিগুলাের চর্চার সুযােগ শিক্ষাব্যবস্থায় রাখার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। চার-পাঁচটি ভাষা শেখার ব্যর্থ চেষ্টা থেকে শিক্ষার্থীদের রেহাই দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে। তিনি শিক্ষার সকল স্তরে মাতৃভাষা চালু করার কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরাে সময়টাই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রােডের বাসায়। বন্ধু-বান্ধব শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বারবার কলকাতায় চলে যেতে বলেছেন, সেখানে তার অনেক বন্ধু-বান্ধবও ছিল। কিন্তু তিনি। ঢাকাতেই থেকে গেছেন। যদিও ঢাকায় তাঁর প্রতিটি রাত কেটেছে দারুণ উকণ্ঠায়।
কিন্তু ডিসেম্বরে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে তিনি ফুলার রােডের বাসা ছেড়ে ১০ ডিসেম্বর গিয়ে উঠেছিলেন কে, এম, দাস লেনে শের-এ-বাংলার বাসায়। কিন্তু ওই বাসায় অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। তাই দু-এক দিনের মাথায় ওই বাসা ছেড়ে এসে উঠলেন ছােট ভাই লুফুল হায়দার চৌধুরীর শান্তিবাগের বাসায়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল। ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগগুলাে খুব নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বিনা বাধায় বােমা ফেলছে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউসে। শান্তিবাগে ভাইয়ের বাসার বারান্দায় দাড়িয়ে মােফাজ্জল হায়দার তার সাত বছরের ছেলে সুমনকে সেই দৃশ্য দেখিয়ে বলেছিলেন, “দেখাে দেখাে। স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই। দেখছ না, প্লেনগুলাে কেমন নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বােমা ফেলছে। কেউ বাধা দিতে পারছে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাব আমরা। ওরা আর আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।”  ১৪ ডিসেম্বর দুপুর দেড়টা। টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে। মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যাচ্ছিলেন গােসল করতে। ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। লুল হায়দার চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। খুলে দিয়েই অবাক হলেন তিনি। নাক পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা কতগুলাে লােক হাতের রাইফেল উচিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সংখ্যায় তারা ২০-২৫ জন। তাদের একজন লুফুল হায়দার চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার কি বাসায় আছেন?” তিনি জানতে চাইলেন, “কেন? তাকে কী দরকার?” রাইফেলধারীদের একজন তখন বলল, “আমাদের কমান্ডার গাড়িতে বসে আছেন। উনি স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলবেন।” ততক্ষণে রাইফেলধারী আলবদর বাড়িটা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। বাড়িতে কান্নার রােল পড়ে গেছে। কাঁদছেন মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী তাহমিনা, কাঁদছে বড় ছেলে সুমন। কিন্তু চার বছরের ছােট শােভন ও ইমন (লুফুল হায়দারের ছেলে) ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। শােভন এসে সুমনকে জিজ্ঞেস করল, “মাত্র এই কয়েকটা রাইফেল দেখে তােমরা সবাই ভয়ে কাদছ কেন?” ।
রাইফেলধারীরা যখন মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাহমিনা এসে সামনে দাড়িয়ে বললেন, “আমার স্বামীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? উনি এখনাে গােসল করেননি, ভাত খাননি।” রাইফেলধারীদের একজন বলল, “ভাবি, আপনি ঘাবড়াবেন না। উনি তাে আমাদের স্যার। উনার কি কোনাে ক্ষতি আমরা করতে পারি? আমরা এখনি উনাকে ফেরত দিয়ে যাব।” এদের কথায় মােটেও আস্থা রাখতে পারছিলেন না তাহমিনা। মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন। মান হেসে বললেন, “তােমরা ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তাে কোনাে অন্যায় করিনি।” মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানাে কাদামাখা মাইক্রোবাসটায় গিয়ে উঠলেন। আবারও এগিয়ে গেলেন তাহমিনা ও লুৎফুল হায়দার। বাসের কাছে এসে রাইফেলধারীদের বললেন, “উনাকে যেখানে নিয়ে যাবেন, আমরাও সেখানে। যাব।” আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল, “তার আর দরকার নেই। উনি এখনই চলে আসবেন।” আর কোনাে কথা বলার সুযােগ না দিয়ে তারা মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে চলে গেল।
মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছােট ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী শোভন তাঁর বাবার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন : সময়টা সম্ভবত ভাের। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর যখন বাবাকে হত্যা করা হয়, তখন তাঁর বয়স ৪৫ বছর চার মাস ২২ দিন। বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল তার বুদ্ধি-বিবেচনা আর বিশ্বাসের জন্য। তিনি কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। ছিলেন না কোনাে বজ্রকণ্ঠী বক্তাও। তিনি কেবল তার ধারণাগুলাে খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে জানতেন। তিনি তার অস্তিত্বে বাঙালিত্বটুকু ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। বাবার জীবনের শেষ সময়টাই সম্ভবত তাঁর ব্যক্তিত্ব বােঝাতে যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার ছাত্রদের একজন ছিল চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর যে দলটা বাবাকে তুলে নিতে এসেছিল, মুঈনুদ্দীনও তাদের সঙ্গে ছিল। সে আমার মা, চাচা-চাচিকে কথা দিয়েছিল, বাবাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। সে বলেছিল, তার শিক্ষকের কোনাে। ক্ষতি সে হতে দেবে না।  চোখ বেঁধে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মােহাম্মদপুর শরীরচর্চা কেন্দ্রে। একটা বিশাল বদ্ধ ঘরে বাবাকে ফেলে রাখা হয়েছিল অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ সমমনা আরও অনেকের সঙ্গে। যাদের প্রত্যেকের গায়েই পড়েছিল নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। ছেড়া জামাকাপড় রক্তে মাখামাখি, এমনকি উপড়ে ফেলা হয়েছিল কারও কারও চোখ! দেলােয়ার হােসেন ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। পরের ঘটনা এই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেই শােনা।
রাত তখন সাড়ে আটটার কাছাকাছি। লােহার রড হাতে অন্ধকার ঘরটাতে পা রেখেছিল কিছু যুবক। প্রথমে তারা মুনীর চৌধুরীর মুখােমুখি হয়েছিল। বলেছিল, “ছাত্রদের তাে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আজ আমরা আপনাকে কিছু। শিক্ষা দেব।” তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনি কয়টা বই লিখেছেন?” মুনীর কাকা দুদিকে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, তিনি লেখেননি। বাবার কাছেও ছিল তাদের একই প্রশ্ন। বাবা বলেছিলেন, “হ্যা, আমি লিখেছি।” এ কথা শুনেই লােকগুলাে লােহার রড দিয়ে তাদের মারতে শুরু করে। সকালের শুরুতেই রুমের ভেতরে যারা ছিলেন চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, লেখক সবাইকে কাটাসুর নামে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। দেলােয়ার হােসেন কেবল বেঁচে গিয়েছিলেন। এই ছিলেন আমার বাবা। মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়েও যিনি বলেছিলেন, “হ্যা, আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছি!” শহীদ মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কোনাে সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। এমনকি রায়েরবাজার বধ্যভূমিতেও তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা