মােজাম্মেল হক চৌধুরী
মােজাম্মেল হক চৌধুরী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম। মােজাম্মেল হক চৌধুরী ১৯৩০ সালের ১ জুলাই দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার একইর গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্ম নেন। তার বাবার নাম মােসলেহউদ্দিন চৌধুরী, মায়ের নাম বসিরুন্নেছা চৌধুরানী। ছয় ভাই ও চার বােনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছােট। আই. এসসি. পাস করার পর ১৯৫২ সালে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসাবে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন মােজাম্মেল হক চৌধুরী। সেখান থেকে পাস করার পর সি, এ. এস. পরীক্ষা দিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে যােগ দেন ১৯৫৩ সালের ৬ এপ্রিল। পরিচিতদের কাছে মােজাম্মেল চৌধুরী ছিলেন ‘দেবতুল্য। স্বল্পভাষী, বিনয়ী, নিরহংকারী মােজাম্মেল ছিলেন প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবােধসম্পন্ন। রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও অপমানসূচক আচরণ তিনি মানতে পারতেন না। যে কারণে তিনি বলতেন যে ১৮ বছর হলেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। অফিসের গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করলে তা ব্যক্তিগত হিসাবেই উল্লেখ করতেন। ৫ এপ্রিল ১৯৭১, তার চাকরির ১৮ বছর পূর্ণ হবে। এরই মধ্যে হঠাৎ অফিসের কাজে তার জাপান যাওয়ার প্রােগ্রাম ঠিক হয়। ২২ এপ্রিল তার জাপান যাওয়ার কথা। কিন্তু তার জাপানও যাওয়া হয়নি, চাকরি থেকে অবসরও নেওয়া হয়নি।
১৯৭১ সালে মােজাম্মেল হক চৌধুরী বাস করতেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেল কোয়াটারের এফ/থ্রি নম্বার বাংলােতে। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে। চট্টগ্রামের অবাঙালিরাও সেখানকার বাঙালিদের ওপর হামলা শুরু করে। এ অবস্থায়
রেল কর্মকর্তা নাসিরউদ্দীন, হামিদ, এল. আর. খান এবং শামছুর রহমান তার রেল কোয়ার্টারের বাসায় এসে আশ্রয় নেন। ৩ এপ্রিল নাসির ও শামছুর রহমান তার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল। সকাল ৯টার দিকে প্রায় দেড়শ অবাঙালি তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়। তাকে এ অবস্থা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন অবাঙালি রেল কর্মকর্তা ওয়ারেস। কিন্তু তিনিও হামলাকারীদের মুখে অসহায় হয়ে গেলেন। হামলাকারীরা বাড়ির মেয়েদের আলাদা ঘরে আটকে রাখে। তারপর একে একে মােজাম্মেল হক চৌধুরী, তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া হামিদ এবং এল, আর, খান এবং বাড়ির অন্য পুরুষদের জবাই করে হত্যা করে। হামলাকারীরা তাদের বাসার সব জিনিসপত্র এবং গাড়ি লুট করে নিয়ে যায়।
বেলা ১১টার দিকে একজন আটকানাে ঘরের দরজা খুলে দিলে মােজাম্মেল চৌধুরীর স্ত্রী দুরই-সাহওয়ার চৌধুরী ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি দেখতে পান, তার স্বামী তখনও বেঁচে আছেন, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কিন্তু অবাঙালিদের অসহযােগিতার কারণে তিনি স্বামীর কোনাে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেননি। তিনি গিয়ে আশ্রয় নেন অবাঙালি কর্মকর্তা ওয়ারেসের বাসায়। সন্ধ্যার পর হামলাকারীরা আবার ফিরে আসে। এবার তারা মােজাম্মেল হক চৌধুরীর স্ত্রী দুরইসাহওয়ারের খোঁজ করে। ওয়ারেসের স্ত্রী ও তার মেয়ে একটি ওয়ার্ডরােবের ভেতর লুকিয়ে রেখে তাকে রক্ষা করেন। দুই দিন তিনি ওই বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। দুই দিনই হামলাকারীরা তাঁর খোজ করেছে। তৃতীয় দিন ওয়ারেস এবং তার স্ত্রী তাদের গাড়িতে লুকিয়ে দেবপাহাড়ে রেলের সাবেক কর্মকর্তা ইকবালের বাসায় তাঁকে পৌছে দেন। তারপর একসময় তিনি ঢাকায় নিজের বাবা-মার কাছে পৌছতে সক্ষম হন। ৫ এপ্রিলের ঘটনার বীভৎসতায় শহীদ মােজাম্মেল হক চৌধুরীর স্ত্রী দুরইসাহওয়ার চৌধুরী দীর্ঘ ১৩ বছর ঘুমাতে পারতেন না, ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। এই দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা