মাে. মােয়াজ্জেম হােসেন
বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বাদোখালী গ্রামে ১৯৩২ সালের ১ ডিসেম্বর মাে, মােয়াজ্জেম হােসেনের জন্ম। তার বাবার নাম মাে. আবদুল গনি মােল্লা, মায়ের নাম বরু বিবি। মাে. মােয়াজ্জেম হােসেন ১৯৪৮ সালে চিতলমারী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে আই, এ, এবং ১৯৫২ সালে বি. এ. পাস করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম. এ. পাস করেন। এম. এ. পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই মােয়াজ্জেম চিতলমারী হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন। এখানে ৮ মাস দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫৫ সালের ১৬ আগস্ট তিনি বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র। কলেজে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে যােগ দেন। একাত্তরে তিনি ওই বিভাগের। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে তিনি তিনটি বই লিখেছিলেন যা ছাত্রপ্রিয় ও প্রশংসিত। হয়েছিল। তার রচিত বইগুলাে হলাে : ‘ফলিত অর্থনীতিসহ পাকিস্তানের অর্থনীতি’, অর্থনীতি’, ‘সহজ অর্থনীতি’, ‘সরল ব্যাংক ব্যবস্থা’, ‘Essentials of Banking’, এবং ‘Handbook of Economics’। শিক্ষকতার পাশাপাশি মােয়াজ্জেম নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। গ্রামে হাট বসানাে, মাদ্রাসা স্থাপন, খাল। কাটা, খালে পুল নির্মাণ ইত্যাদি কাজে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও মােয়াজ্জেম বাঙালিদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। উনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় বাগেরহাটে (তখন খুলনা জেলার মহকুমা) পাঞ্জাবি জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে পুলিশ ছাত্রদের ওপরে গুলি চালালে দুজন ছাত্র নিহত হয়। বহু ছাত্র প্রাণভয়ে মাে. মােয়াজ্জেম হােসেনের অফিস কক্ষে আশ্রয় নেয়। তিনি নিজে ছাত্রদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মােয়াজ্জেম হােসেন তাতে সক্রিয় অংশ নেন। এপ্রিলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বাধীনতাবিরােধীদের সহায়তায় বাগেরহাটে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ও উন্নত অস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে পাকিস্তান সেনা ও স্বাধীনতাবিরােধীদের মােকাবিলা করবেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ২১ অক্টোবর নিজ এলাকায় ফেরেন। ২৮ অক্টোবর স্বাধীনতাবিরােধীদের হাতে তিনি শহীদ হন। এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, তাঁর ছােট ছেলে জাকির খানের কাছ থেকে। তিনি বলেন : আমাদের এলাকায় স্বাধীনতাবিরােধীদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে বাবা আমার বড় ভাই ও স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান। বাবার এই কাজগুলােতে মা ভীত ছিলেন। কারণ, সাত ছেলেমেয়েকে অনিশ্চিত অবস্থায় রেখে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারটা বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় ছিল না। সে বছর আমার বড় ভাই ও বড় বােনের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। আর আমি ছিলাম সবার ছােট।
বাবা ভারতে এক মাসের ট্রেনিং ও কয়েকটি সীমান্তযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেড় মাস পর গ্রামে ফেরেন। সেদিন ছিল ২১ অক্টোবরের রাত- প্রথম রমজান। সেহরির সময় তিনি আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অনেক মুক্তিযােদ্ধা। বাদোখালি প্রাইমারি স্কুলে মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্প করেন। বাবাকে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন এই এলাকার মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা করে পাঠানাে হয়েছিল। কয়েকটি দল তার অধীনে ছিল। এলাকাতে আসার পর প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাবা। রাতে তিনি ক্যাম্পে না থেকে বাড়িতে থাকতেন। ২৮ অক্টোবর সকালে বাবা বাড়ি থেকে ক্যাম্পে যান। তখন একবারও মনে। হয়নি এই তার শেষযাত্রা। বাবার এক কাধে ছিল স্টেনগান আরেক কাধে তাঁর অতি প্রিয় দোনলা বন্দুক। সেদিন আমাদের এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ছােট ছােট যুদ্ধ চলছিল। চারদিক থেকে শুধু গােলাগুলি শােনা যাচ্ছিল। সন্ধ্যা থেকে মা ও আমার বড় বােনরা। বাবার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ক্যাম্প থেকে একজন এসে আমার মা ও বড় বােনকে জানায়, বাবার ফিরতে দেরি হবে। এরপর তারা ঘুমাতে যান। গভীর রাতে বাড়ির কাছে গুলির শব্দে আমার মাসহ আমাদের বাড়ির বড়রা। সবাই জেগে ওঠেন। বাবা গভীর রাতে ক্যাম্প থেকে একা নৌকায় বাড়িতে ফিরছিলেন। ওই সময় আমাদের বাড়ির কাছে স্বাধীনতাবিরােধীরা লুকিয়ে ছিল। বাবা ঘাটে পৌছে নৌকা থেকে নামছিলেন। এমন সময় তারা তাকে পেছন থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ বাবা নৌকার মধ্যে পড়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। (জাকির খান, সাক্ষাঙ্কার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) মাে. মােয়াজ্জেম হােসেনের স্ত্রীর নাম ফাতেমা বেগম। তাদের সংসারে তিন ছেলে ও চার মেয়ে ছিল।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা