মাে. মমিনুল হক
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামােশংকর বাটির মণ্ডলপাড়ায় ১৯২০ সালের ২০ ডিসেম্বর মাে. মমিনুল হকের জন্ম। তার বাবা মৌলভী মাে. এমাজউদ্দিন ছিলেন একজন আইনজীবী, মায়ের নাম এফরাতুন্নেসা। এমাজউদ্দিন অবিভক্ত ভারতের মালদা জেলা বাের্ডের নির্বাচিত এবং স্থানীয় বাের্ডের মনােনীত সদস্য হিসাবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। আট ভাই, দুই বােনের মধ্যে মাে. মমিনুল হক ছিলেন দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে বড়। তার দুই ভাই শৈশবেই মারা যান, অন্য ভাইয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাবার পেশার সূত্রে মমিনুলের শৈশব-কৈশাের কেটেছে মালদা শহরে। সেখানকার অক্রোমনি হাই স্কুল থেকে তিনি ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেন। ১৯৪৬ সালে মমিনুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে মাে. মমিনুল হক পাকিস্তান সরকারের অধীনে সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে পরিদর্শক পদে যােগ দেন।
১৯৫৫ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে মমিনুল নবাবগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ এবং প্রথম ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কলেজকে গড়ে তােলার জন্যে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। প্রথম অবস্থায় ছাত্র সংগ্রহের জন্য তিনি নৌকা ও গরু গাড়িতে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাজির হতেন, অভিভাবকদের রাজি করাতেন এবং তাদের ছেলেমেয়েদের কলেজে ভর্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রথম তিন বছর তিনি কলেজ থেকে কোনাে বেতন নেননি। গরিব ছাত্রদের জন্যে তিনি লজিংয়ের ব্যবস্থাও করতেন। ১৯৭০ সালে তিনি চাপাইনবাবগঞ্জে একটি নৈশ কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। চণ্ডীমণ্ডপ স্কুলে (পরবর্তীতে নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়) ক্লাসও শুরু হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ আর এগােয়নি। চাপাইনবাবগঞ্জ পাঠাগার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্লাব ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। মমিনুল হক সরাসরি কোনাে রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে তিনি মনে-প্রাণে সমর্থন করতেন।
একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতেই তৎকালীন ই. পি. আর., পুলিশ এবং মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা ই. পি. আর. ক্যাম্পে অবস্থানকারী পাকবাহিনীকে পরাজিত করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্বাধীনতা যুদ্ধকে পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট (পরে দশ সদস্যে উন্নীত করা হয়) স্টিয়ারিং, কমিটি গঠন করা হয়, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন মমিনুল হকের ছােট ভাই ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাে. সেরাজুল হক শনি মিয়া। দুই ভাই একই বাড়িতে বাস করতেন। তাঁদের বাড়িতেই প্রতিদিন স্টিয়ারিং কমিটির সভা হতাে। ছােট ভাইয়ের কাছ থেকে মমিনুল যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে খোঁজ নিতেন। ১৯ এপ্রিল চাপাইনবাবগঞ্জ শহর পুনরায় পাকবাহিনীর দখলে যায়। পাকবাহিনী দুই ভাইয়ের বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মাে. মমিনুল হক শহর ছেড়ে প্রথমে মহারাজপুরে তার মামার বাড়িতে, পরে চৈতন্যপুরে তাঁর বড় বােনের শ্বশুরবাড়িসহ বিভিন্ন আশ্রয়ে ছিলেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারত চলে যাবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু যেদিন তার যাওয়ার কথা, সেদিনই বিকেলে পাকিস্তানি হানাদারদের একদল দালাল চৈতন্যপুরে তার এক বােনের শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে আটক করে।
গ্রেফতার করার পর মমিনুলকে প্রথমে নাটোর সেনানিবাসে ও পরে ঢাকা। কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। ঢাকায় অবস্থানরত তার ভাই ড. মাে. বজলুল হক মাঝে-মধ্যে তার সাথে দেখা করার সুযােগ পেতেন। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি আগস্ট মাসে মুক্তি পান। সামরিক জান্তার চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে কলেজে যােগ দেন। কাজে যােগ দিলেও ভারতে অবস্থানরত তাঁর দুই ভাই মাে. সেরাজুল হক এবং অধ্যাপক ড. রশিদুল হকের কাছে খবর পাঠান, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কোনাে অবস্থাতেই তারা যেন দেশে ফিরে না আসেন। তাঁর দুই ছেলে তার গ্রেফতারের দিনই ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদেরও তিনি দেশে ফিরে আসতে নিষেধ করেন। ১১ অক্টোবর আবার পাকবাহিনী মমিনুলকে গ্রেফতার করে রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জোহা হলে নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানাে হয়। অক্টোবরের ২০ তারিখ তাকে মুক্তি দেওয়া হলেও পরিচিতজনদের কাছে তিনি প্রায়ই আশঙ্কা ব্যক্ত করতেন যে তাঁকে যে কোনাে সময় মেরে ফেলা হতে পারে। তার সে আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর, রাত সাড়ে ৯টায় পাকবাহিনীর চারজন সহযােগী তার বাসায় হানা দেয়। এদের সকলের পরনে লুঙ্গি-শার্ট, মুখ মাফলার দিয়ে আধাঢাকা। তারা জানায়, জরুরি প্রয়ােজনে তাকে এখনই তাদের সাথে থানায় যেতে হবে। অন্যথায় তার বিপদ হবে। তিনি বাড়ির ভিতরে এসে শার্ট-প্যান্ট, ঘড়ি পরেন। এবং তার মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলেন, “মা আমার জন্য দোয়া করিস।” এ কথা বলে পরিবারের সবার কান্নার মধ্যেই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। সে রাতেই মমিনুলকে জিপে করে রাজশাহীতে নেওয়া হয়। সেখানে পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযােগ করে বলা হয় যে তিনি তার দুই ছেলেকে মুক্তিবাহিনীতে পাঠিয়েছেন, তার মেজো ভাই মুক্তির নেতা, তিনি আওয়ামী লীগ করেন, সরস্বতী পূজায় কলেজ ফান্ড থেকে হিন্দুদের চাঁদা দিয়েছেন ইত্যাদি।
তাঁকে জানানাে হয় যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এরপর তাঁকে রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিচতলার একটি কক্ষে তাকে দুই দিন অভুক্ত অবস্থায় আটক রেখে তৃতীয় দিন তিনতলার অন্য একটি কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই আটক ছিলেন মাে. কসিম উদ্দিন (বর্তমানে মৃত)। তাদের তিনি সব ঘটনা খুলে বলেন। উল্কণ্ঠার মধ্যে কয়েকদিন চলে যায়। ২০ নভেম্বর অর্থাৎ ‘চাদ রাতে’ (শাওয়াল মাসের প্রথম চাদ দেখা রাতে) ২টার সময় পাকবাহিনীর ঘাতক দল তার কক্ষে উপস্থিত হয়। তাঁর নাম-ধাম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাঁকে কক্ষের বাইরে নিয়ে যায়। তার চোখ কালাে কাপড়ে এবং হাত দুটো পেছনে পিঠমােড়া করে বেঁধে অন্যান্য ১০ জন বন্দির সাথে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পরে তার কক্ষে আটক অন্য সহবন্দিরা দূর থেকে ভেসে আসা ব্রাশফায়ারের গুলির ক্ষীণ শব্দ শুনতে পান। ধারণা করা হয়, মমিনুল ২০ নভেম্বর দিন শেষে রাত ২টার পরে শহীদ হন। এ কারণেই তার মৃত্যুর তারিখ হচ্ছে ২১ নভেম্বর ১৯৭১, ঈদ-উল-ফিতরের দিন।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়ে মাে. কসিম উদ্দিনই প্রথম মাে. মমিনুল হকের পরিবারকে সমস্ত ঘটনা জানান এবং মমিনুলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বন্দি অবস্থায় তার ব্যবহৃত সােয়েটার, চশমা, হাতঘড়ি ও টর্চ এবং টাকা তার পরিবারকে পৌছে দেন। তাঁর আত্মীয়রা শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পাশে ইটের ভাটা, কাটাখালী ছাড়াও রাজশাহী, নাটোরের সকল বধ্যভূমি, গণকবর এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তন্নতন্ন করে খুজেও তার লাশ পায়নি। মাে. মমিনুল হক ১৯৪৩ সালে তার আপন চাচাতাে বােন নাসেহা খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। কসিম উদ্দিনের সামনে দেওয়া শহীদ মমিনুল হকের বক্তব্যের সূত্র ধরে স্বাধীনতার পর পরই কর্নেল রিজভি, মেজর শেরােয়ানী, রুহুল আমিন এবং তিনজন দালাল শিক্ষকের বিরুদ্ধে নবাবগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু তঙ্কালীন সরকারের নিস্পৃহতার কারণে মামলাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। ১৯৮৯ সালে চাপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা শহীদ মমিনুল হকের বাসভবন থেকে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ পর্যন্ত সড়কটি তার নামানুসারে নামকরণ করে। নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে একটি নতুন এগজামিনেশন ও একাডেমিক ভবনও শহীদ মমিনুল হকের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা