মাে. তসলিম উদ্দিন
মাে. তসলিম উদ্দিনের জন্ম ১৯৩৬ সালে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামােশংকরবাটি গ্রামে। তার বাবার নাম মজিদুল্লাহ বিশ্বাস। মাে, তসলিম উদ্দিন ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের রাজরারামপুর হামিদুলল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ থেকে আই. এ. ও বি. এ. এবং ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল, এল. বি. পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৬২ সালে তিনি রাজশাহী কোর্টে আইন ব্যবসায় শুরু করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে আয়কর উকিল হিসাবে রাজশাহী ইনকাম ট্যাক্স অ্যাডভােকেটস বারে যােগ দেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ পেশাতেই যুক্ত ছিলেন। মাে. তসলিম উদ্দিন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ তাঁকে বিচলিত করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী শহর দখল করলে মাে. তসলিম উদ্দিন গ্রামে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর আবার শহরে ফিরে আসেন। তার গ্রামের বাড়ি থেকে ভারতের সীমান্ত খুবই কাছে। হওয়ার পরও তিনি ভারতে যাননি। দেশের মাটিতে থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাথে পরােক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি একসময় এলাকার স্বাধীনতাবিরােধীদের কাছে। ধরা পড়ে যায়। তসলিম থাকতেন রাজশাহী শহরের কাজিরহাটে। ১৩ নভেম্বর স্থানীয় থানার ওসির নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ ও ইপিকাফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স) তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারা মাে. তসলিম উদ্দিনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে অবস্থিত জোহা হলে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ধারণা করা হয়, নির্যাতন চালানাের পর অন্য বন্দিদের সাথে ১৭ নভেম্বর পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় আইনজীবী ও সাংবাদিক সাঈদউদ্দিন আহমদের ‘আমার সতীর্থ’ রচনায়। তিনি লিখেছেন : শহীদ অ্যাডভােকেট মাে. তসলিম উদ্দিনের চশমা, কলম ও অন্যান্য দু’একটি জিনিস উদ্ধার করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হলের পিছনের একটি গণকবর থেকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন পরে। তসলিম উদ্দিনের লাশটি কিন্তু শনাক্ত করা যায়নি। প্রায় পঞ্চাশটির মতাে লাশ একটা দড়িতে বাঁধা ছিল। এদের কাউকেই শনাক্ত করার অবস্থা ছিল না। এক মাস আগে পোঁতা লাশগুলি পচে গলে গিয়েছিল। জোহা হলের জল্লাদখানা থেকে বরাত জোরে যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে জানা যায় ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে অ্যাডভােকেট তসলিম উদ্দিনকে সহবন্দিদের সাথে জোহা হলের বন্দিখানা থেকে বের করা হয় এবং সেই রাতেই তাদের হত্যা করা হয়। সেদিন ছিল পবিত্র শবে কদরের রাত। ১৩ নভেম্বর বিকেল চারটার সময় অ্যাডভােকেট তসলিম উদ্দিন তার। কাজিহাটা বাড়িতেই ছিলেন। তার ছােট ভাই অ্যাডভােকেট গােলাম রাব্বানীর। কাছ থেকে জানা যায়, বিকেল ৪টার দিকে বােয়ালিয়া থানার তৎকালীন ও. সি. কয়েকজন সিপাই ও ইপিকাফের সদস্যদের নিয়ে একটি গাড়িতে করে তাদের বাড়িতে আসে এবং তসলিম সাহেবকে বলে কিছুক্ষণের জন্য তাঁকে থানায় যেতে হবে। তারা জানায় তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ইফতারের আগেই ছেড়ে দেবে। তসলিম সাহেব তাদের সঙ্গে থানায় যান।
না গিয়ে উপায়ও ছিল না। তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, বােন সকলেরই মনে শঙ্কা ছিল, ফিরে আসবে তাে? না, তসলিম সাহেব আর ফিরে আসেননি। বােয়ালিয়া থানায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে বলা হয়- জোহা হলে যেতে হবে।’ তসলিম সাহেব রােজা ছিলেন। ইফতারের পর থানা থেকে তাকে জোহা হলে। নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরের চার দিনের খবর তাঁর সহবন্দিদের মধ্য থেকে,। ভাগ্যগুণে যারা বেঁচে গেছেন, তাদের কাছ থেকে গােলাম রাব্বানী শুনেছেন। সে। খবর গ্রিহের। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড; সামান্য সম্পাদিত) মাে. তসলিম উদ্দিনের স্ত্রীর নাম সাঈদা বেগম। তিনি রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তাদের সংসারে এক মেয়ে ও তিন ছেলে ছিল।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা