নিজাম উদ্দিন আহমদ
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে কয়েকজন সাংবাদিক দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, নিজাম উদ্দিন আহমদ তাঁদের অন্যতম। নিজাম উদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯২৯ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার মাওয়া গ্রামে। তাঁর ডাকনাম দাদন। নিজাম উদ্দিন আহমদের বাবার নাম সিরাজ উদ্দিন আহমদ, মায়ের নাম ফাতেমা বেগম। চার ভাইবােনের মধ্যে নিজাম ছিলেন দ্বিতীয়। সিরাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন জাহাজের অডিট অফিসার। ছেলেবেলায় নিজাম উদ্দিন আহমদের লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামেরই মাওয়া প্রাইমারি স্কুলে। এই স্কুলটি তাঁদের পরিবারের উদ্যোগেই তৈরি । পরে তিনি স্থানীয় কাজির পাগলা এ, টি, ইনস্টিটিউশনে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। ১৯৪৬ সালে বিক্রমপুর ভাগ্যকূল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে নিজাম উদ্দিন আহমদ ম্যাট্রিক পাস করেন। তাঁদের পরিবারটি ছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনেকখানি অগ্রসর। স্কুলে পড়ার সময় তিনি পরিবারের সব সদস্য মিলে বাড়িতে নাটক-গান-আবৃত্তি করতেন।
নিজাম উদ্দিন মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। হরগঙ্গা কলেজে পড়ার সময় তিনি সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন তক্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখ। রাজনীতির কারণে তখন তিনি মুন্সিগঞ্জের আনাচে-কানাচে চষে বেড়িয়েছেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। নিজাম উদ্দিন ১৯৫১ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি এবং ১৯৫২ সালে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি আর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। এ সময় তিনি সাংবাদিকতা, সাঁতার আর সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিয়েই বেশি মেতে থাকেন। ছােটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একজন তুখােড় সাঁতারু। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন। সাঁতারে বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যাম্পিয়ন হিসাবে নিজাম উদ্দিন আহমদ ছিলেন সকলের প্রিয়। সাঁতারে তিনি প্রাদেশিক প্রতিযােগিতায়ও পুরস্কার পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতে তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। ১৯৫০ সালে করাচি থেকে প্রকাশিত ‘সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। এরপর ‘দৈনিক মিল্লাত’, দৈনিক আজাদ’, ‘পাকিস্তান অবজারভার’, ‘ঢাকা টাইমস’, ‘ইউ. পি. আই.’, এ. এফ. পি.’, ‘এ. পি. পি.’, রয়টার্স’ প্রভৃতি সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় কাজ করেন। নিজাম উদ্দিন খুব দ্রুত প্রথম সারির সাংবাদিক হিসাবে দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালে’ (পি. পি, আই,, বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বি. এস, এস.) যােগ দেন এবং পরবর্তীতে এ সংস্থার জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব পান।
নিজাম উদ্দিন আহমদ একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে তাঁর ছিল দৃঢ় আস্থা। তিনি ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ‘৫৮-র রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ‘৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-র ছয় দফা, ‘৬৯-র গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন সেই নির্বাচনে ১৯৬৫ সালে নিজাম উদ্দিন আহমদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাগরিক হিসাবেও খুব সম্মানিত ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় পাট বাের্ড, যক্ষ্মা সমিতি ও সেন্সর বাের্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ২৫তম অধিবেশনে তিনি যােগ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে নিজাম উদ্দিন আহমদ ছিলেন ‘বি. বি. সি.’র বাংলাদেশের সংবাদদাতা, একই সাথে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল ম্যানেজার। সরকারি সংস্থার দায়িত্বে থেকেও একাত্তরে বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে সােচ্চার অবস্থান নিয়েছিলেন নিজাম উদ্দিন। ১৯৭১ সালের মার্চে সােয়াত জাহাজে করে চট্টগ্রামে অস্ত্র আনার বিষয়টি তিনিই প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান। এ সময় তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনৈতিক খবর শেখ মুজিবকে সরবরাহ করতেন। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি অফিসেই ছিলেন। সারা শহরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচরণ। রাত ৮টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা কামারুজ্জামান তাকে ফোন দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চান। নিজাম উদ্দিন তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের কথা জানান।
পরদিন ২৬ মার্চ ভােরের আলাে ফোটার আগেই তিনি একটা ছােট ট্রানজিস্টার নিয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হন। স্ত্রী রেবা তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, “এখন কি ঘরে বসে থাকার সময়? আমাকে বাইরে গিয়ে দেখতে হবে কোথায় কী হলাে; তাছাড়া আমার অফিসে টেলিপ্রিন্টারের অপারেটর ও অন্যান্য লােকজন আছে, তাদের খোঁজ নিতে হবে।” এই বলেই তিনি বেরিয়ে যান। সারাদিন ঘুরে দেখেন ঢাকা শহরে পাকবাহিনীর বর্বরতা। মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়েই তিনি সংগ্রহ করেন গণহত্যার সংবাদ। আবার যথাসময়ে সেগুলাে পাঠিয়েও দেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘বি, বি. সি.’র সংবাদদাতা হিসাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে নিজাম উদ্দিন আহমদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। “নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ম্যাক ব্রাউন নিজাম উদ্দিন আহমদের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য ও ছবির ভিত্তিতে পাকিস্তানি বর্বরতা ও গণহত্যার উপর প্রতিবেদন করেছিলেন। পাকিস্তান সরকারের আরােপিত কড়া সেন্সরশিপের মাঝেও তিনি ‘বি, বি, সি,’কে নিয়মিত পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি, বাঙালি গণহত্যা, পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা এবং মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে নিয়মিত তথ্য দিতেন। তিনি ম্যাক ব্রাউনকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অনেক সাবধানতার পরেও তিনি পাকিস্তানি গােয়েন্দাদের নজরে পড়ে যান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাকিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ পাঠানাে ও ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগের অভিযােগে তাকে দুবার পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী (বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের রূপকার) ডেকে পাঠায় এবং তাকে সতর্ক করে দেয় যে কোনাে অবস্থাতেই যেন গণহত্যার কোনাে খবর বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করা না হয়। যদি এর অন্যথা হয় তবে তাকে সমস্যায় পড়তে হবে। কিন্তু নিজাম উদ্দিন আহমদ এসব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নিজের মতাে করেই সংবাদ পাঠাতে থাকেন। এ ঘটনায় পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী। তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একসময় তাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠানাে হয়। “পি, পি, আই.’র আরেকজন সাংবাদিক ও একজন। ব্যাংকারকেও একই কারণে ডেকে পাঠায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। নিজাম উদ্দিন আহমদ কৌশলে পাকিস্তানে যাওয়া এড়ান, কিন্তু অন্য দুজন যেতে বাধ্য হন। তার মধ্যে ব্যাংকারকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী।
রাও ফরমান আলী তাকে হুমকি দেওয়ার পর ‘বি, বি, সি,’ থেকেও তাকে সাবধানে থাকতে অনুরােধ করা হয়। এসব ঘটনার পর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকা শুরু করেন। আবারও তাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠানাে হয়, কিন্তু তিনি এবারও কৌশলে তা এড়িয়ে যান। নিজাম উদ্দিন আহমদ পুরান ঢাকার কলতাবাজারের ১২/সি নম্বর রােকনপুরের বাসায় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এদিন চারপাশ থেকে পাওয়া খবরগুলাের ভিত্তিতে তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে বাঙালির বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। “বি, বি. সি.’তে পাঠানাের জন্যে খবর টাইপ করা অসমাপ্ত রেখে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনি দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন। সেদিন কারফিউ ছিল। বাড়ির পেছনের গলি দিয়ে মিলিটারি আর কালাে কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা একদল আলবদর তার বাসায় হানা দেয়। ঘাতক দল ধরে নিয়ে যায় নিজাম উদ্দিন আহমদকে। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২’এ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় নিজাম উদ্দিনের ছেলে শাফকাত নিজাম বাপ্পি জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে বাসার সবাই দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। দরজা খােলামাত্রই বাসায় দুজন অস্ত্রধারী প্রবেশ করে। তারা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমদের নাম ধরে খোজ করতে থাকে। পরিবারের সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজাম উদ্দিন খাবার টেবিল থেকে উঠে অস্ত্রধারীদের কাছে বলেন, “আমিই নিজাম উদ্দিন আহমদ।” পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য অস্ত্রধারীরা তাঁর কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চায়। তখন তিনি তাদেরকে পরিচয়পত্র দেখান।
পরিচয়পত্র দেখানাের পরে ঘাতক দল দেরি না করে তাদের সঙ্গে নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় তার স্ত্রী কোহিনুর আহমদ রেবা তাদের পিছু পিছু যেতে থাকলে অস্ত্রধারীরা তাকে পেছনে আসতে মানা করে। নিজাম উদ্দিনকে তারই গায়ের গেঞ্জি ছিড়ে চোখ এবং হাত বেঁধে একটি কাদা মাখানাে মিনিবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। এ সময় ওই গাড়ির পেছন দিকে হাত এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও অনেক ব্যক্তি ছিলেন। এরপর থেকে নিজাম উদ্দিন আহমদের আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীনের পরে ‘বি. বি. সি.’র সাংবাদিক মার্কটালিসহ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা অনেক খুজেছেন, কিন্তু কোথাও তার লাশ পাওয়া যায়নি। বি. বি. সি.’ তার পরিবারের জন্য একটি ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। তার স্ত্রী কোহিনুর আহমদ রেবা ১৯৯৩ সালে মারা গেছেন। তাদের সংসারে দুই মেয়ে ও এক ছেলে ছিল। বড় মেয়ে শামানা নিজাম সিলভিয়া, ছােট মেয়ে শারমিন রীমা (মারা গেছেন) এবং ছােট ছেলে শাফকাত নিজাম বাপ্পি। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য নিজাম উদ্দিন আহমদকে ১৯৯৩ সালে মরণােত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা