ফজলুর রহমান
ফজলুর রহমান ছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের যন্ত্র প্রকৌশলী। ১৯৭১ সালে তিনি রেলওয়ে ওয়ার্কশপের ঢালাইঘরের ইনচার্জ হিসাবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাকে অন্য একটি শাখায় বদলি করা হয়েছিল। তাঁর স্ত্রীর নাম হােসেন আক্তার। ফজলুর রহমান তার স্ত্রী এবং চার ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে রেল কলােনিতে বাস করতেন। ফজলুর রহমান রাজনীতি করতেন না, কিন্তু বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে মনেপ্রাণে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি বাড়ির বারান্দায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিলেন। তিন দিন পতাকা উড়লেও চতুর্থ দিন অন্যদের অনুরােধে তিনি পতাকা নামিয়ে ফেলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে সৈয়দপুরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারির আগের রাতে অবাঙালিদের একটা অংশ মেথরদের সহযােগিতায় সৈয়দপুর বাংলা হাই স্কুল প্রাঙ্গণের শহীদ মিনারে মানুষের মল ঢেলে দিয়েছিল। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। থেকে অবাঙালিরা বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার হন ফজলুর রহমানের বন্ধু ও সহকর্মী জামান। এরপর অসংখ্য বাঙালি পরিবার সৈয়দপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। যে কয়টি পরিবার সেখানে ছিল, তারা সবাই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে থাকত। এ সময় বদ্ধ ঘরের মধ্যে ফজলুর রহমান লােহার পাত দিয়ে তীর-ধনুক বানিয়ে ছেলেমেয়েদের তীর-ধনুক চালানাে শেখান। স্ত্রীকে বলেন, সারাক্ষণ চুলায় গরম পানি। বসিয়ে রাখতে আর মরিচ গুড়া করে রাখতে, অবাঙালিরা হামলা করলে যাতে গরম পানিতে মরিচ গুলিয়ে তাদের প্রতিরােধ করা যায়।
এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযােগিতায় অবাঙালিরা ফজলুর রহমানের বাসায় তিনবার তল্লাশি চালায়। এ কারণে শুভানুধ্যায়ীরা তাকে গ্রামে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। অনেক চাপাচাপির পর ১৪ এপ্রিল রাতে ফজলুর রহমান তার বড় মেয়ে। কাজলকে বন্ধু ইলিয়াসের সাথে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল। সেদিন ছিল বাংলা নববর্ষ। সকাল ১০টার দিকে কয়েক বাস ভর্তি অবাঙালি দিনাজপুর থেকে সৈয়দপুরে আসে। তারা দিনাজপুরে বাঙালি এবং সাঁওতালদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা যায়। বেলা ১১টার দিকে অবাঙালিরা দলে দলে বিভিন্ন বাঙালি কর্মকর্তার কলােনির বাসায় গিয়ে হামলা চালায়। অবাঙালিদের ছুটে আসতে দেখে ফজলুর রহমান তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে আসেন এবং স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের খাটের নিচে। লুকিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে দেন। অবাঙালিরা শাবল দিয়ে দরজার কজা ভেঙে ফেলে।
ফজলুর রহমান দৌড়ে পালাতে গেলে অন্য একটি দরজার সাথে তার পাঞ্জাবি আটকে যায়। অবাঙালিরা তখন তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। তিনি ওখানেই মারা যান। | এটা দেখে তাঁর মেজো ছেলে হসিনুর রহমান হিরণ খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে। বাবাকে ধরতে গেলে অবাঙালিরা তার পিঠে ছুরি মারে। হিরণ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর ঘাতকের দল খাটের নিচ থেকে ফজলুর রহমানের স্ত্রী হােসেন আক্তারসহ একে একে সবাইকে বের করে আনে। হােসেন আক্তার প্রাণভিক্ষা চাইলেও তারা রেহাই দেয়নি, তাকে টেনে নিচে নামিয়ে ভাঙা দরজার কাছে নিয়ে ছুরি মারে। তার কাছে থাকা একটা থলেতে প্রায় দেড় হাজার টাকা রাখা ছিল। ঘাতকেরা সেটা ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে টেনেহিচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এরপর একে একে ঘাতকেরা ছুরি মারে ফজলুর রহমানের ছেলে মােস্তাফিজুর রহমান মজনু ও আজিজুর রহমান বাবুকে। মজনু, হিরণ ও বাবুকে পরে একজন অবাঙালি ডাক্তারের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবাঙালিরা তাদের তিনজনকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। এই গণহত্যার হাত থেকে বেঁচে যান ফজলুর রহমানের ছােট ছেলে সাইদুর রহমান ও তিন বছরের মেয়ে কাকন। বড় মেয়ে দিলরুবা খান কাজলও বাড়িতে না থাকায় বেঁচে যান।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা