ফয়জুর রহমান আহমেদ ১৯২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রামে জন্ম নেন। তিনি ১৯৩৯ সালে কিশােরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৪১ সালে কিশােরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মােহন কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। |১৯৪৬ সালে ফয়জুর পুলিশ বিভাগে সাব-ইন্সপেক্টর পদে যােগ দেন। চাকরিজীবনে বিভিন্ন পদে তিনি সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও কুমিল্লায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার হিসাবে পিরােজপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পিরােজপুরে কর্মরত অবস্থায় অসহযােগ আন্দোলন শুরু হলে ফয়জুর রহমান আহমেদ তাতে সম্পৃক্ত হয়ে যান এবং সেখানকার রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যােগাযােগ গড়ে তােলেন। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ফয়জুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করে পিরােজপুরের রাজনৈতিক মহলকে জানিয়ে দেন। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্রাগারে সংরক্ষিত অস্ত্র সরবরাহ করে প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তােলেন এবং ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন।
একাত্তরের ৪ মে পাকবাহিনী পিরােজপুর শহর দখল করে নেয়। সে সময় ফয়জুর রহমান আহমেদের পরিবারের সদস্যরা পিরােজপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ছিলেন। তিনি সেখানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান। পরদিন ৫ মে পিরােজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চিঠি পেয়ে তিনি কর্মস্থলে এসে পৌঁছলে পাকবাহিনী তাকে বন্দি করে এবং বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তার মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেয়। স্থানীয় জনগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার মৃতদেহ নদী থেকে তুলে নদীতীরেই সমাহিত করে। স্বাধীনতার পর তার মৃতদেহ পূর্ণ মর্যাদায় ওই কবর থেকে পিরােজপুর কবরস্থানে স্থানান্তরিত করা ফয়জুর রহমান আহমেদ একজন সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি হিসাবে পিরােজপুরে জনপ্রিয় ছিলেন। সাহিত্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণে তিনি কলকাতার ‘সওগাত’, ঢাকার ‘ডিটেকটিভ’, সিলেটের ‘আল ইসলাহ’, চট্টগ্রামের অস্তিকা ইত্যাদি পত্রিকা ও সাময়িকীতে লিখতেন। পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৬৫ সালে লেখা ‘দীপ নেভা যার ঘরে’ নামে তার একটি গল্প-সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।
পুলিশে চাকরি করলেও ফয়জুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক শিল্পী-স্বভাবের। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা বা অর্থ উপার্জনের বিষয়ে তাঁর কোনাে আকর্ষণ ছিল না। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার বাবা ফয়জুর রহমান। আহমেদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন : ১. বাবার মৃত্যুর পর দেখা গেল, এই জীবনে তিনি চার হাজারের মতাে বই এবং পােস্টাপিসের পাশ বইয়ে একশ ত্রিশ টাকা ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। বইয়ের সেই বিশাল সংগ্রহও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্দেশে পিরােজপুরের একদল হৃদয়হীন মানুষ লুট করে নিয়ে যায়। বাবাকে ধরে নিয়ে যায় বলেশ্বর নদের তীরে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ভরা পূর্ণিমায় ফিনকি ফোটা জ্যোত্যায় তার রক্তাক্ত দেহ ভাসতে থাকে বলেশ্বর নদে। দেশ স্বাধীনের পর গণহত্যা ও পাকিবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে প্রথম মামলাটি দায়ের করেছিলেন শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ। আয়েশা ফয়েজ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের সংসারে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ফয়জুর রহমান আহমেদের ছেলে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে নিজ নিজ প্রতিভায় খ্যাতিমান।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা