নূতনচন্দ্র সিংহ
সমাজসেবী ও শিক্ষাব্রতী নূতনচন্দ্র সিংহ জন্মেছিলেন ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর, রাউজানের গুজরা (গহিরা) গ্রামে মামার বাড়িতে। তার বাবার নাম অখিল চন্দ্র সিংহ এবং মায়ের নাম গয়েশ্বরী সিংহ। নূতনচন্দ্র মাত্র আড়াই বছর বয়সে মা এবং আট বছর বয়সে বাবাকে হারান। তিনি ছয় বছর বয়সে। জগৎপুর পূর্ণানন্দ আশ্রমে অক্ষরজ্ঞান লাভ করেন। | আট বছর বয়সে নূতনচন্দ্র বাবার সাথে বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) চলে যান। সেখানে মুদির দোকানে কাজ করেন। এরপর তিনি আকিয়াব যান এবং সেখানে সাবান ও ঔষধ তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। দীর্ঘদিন সেখানে ব্যবসা পরিচালনার পর তিনি বিহারের কুণ্ডধাম তীর্থ দর্শন করে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন এবং ‘কুণ্ডেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে নূতনচন্দ্র নিজ গ্রাম গহিরায় কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় নামে একটি ওষুধ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়’ ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ছােটবেলা থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন নূতনচন্দ্র। এক পর্যায়ে তিনি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। কিন্তু এই অর্থ ভােগবিলাসে খরচ না করে তিনি জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়ােগ করেন। শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজসেবায় নূতনচন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নিজের টাকা খরচ করে ১৯৬০ সালে কুণ্ডেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ও ‘কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির এবং ১৯৬৯ সালে কুণ্ডেশ্বরী মহিলা কলেজ স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি কুণ্ডেশ্বরী ভবন এবং ডাকঘর স্থাপন করেন। কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির ও কুণ্ডেশ্বরী মহাবিদ্যালয় এলাকায় নারীশিক্ষার প্রসারে এখনও অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এলাকায় অসহায় মানুষের অভাব-অনটনে তার সাহায্যের হাত ছিল সবসময় খােলা।
১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-বুদ্ধিজীবীদের আশ্রয় ও পরামর্শস্থল ছিল নূতনচন্দ্রের কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স। তকালীন রাজনীতিকদের অনেকেরই যাতায়াত ছিল সেখানে। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আসা ইপিআর (পরে ইবিআর) সদস্যদের খাদ্য সরবরাহ ও যুদ্ধ প্রস্তুতিতে নানাভাবে সহযােগিতা দেন নূতনচন্দ্রের ছেলে প্রয়াত সত্যরঞ্জন সিংহ এবং প্রফুল্লরঞ্জন সিংহ। পাকসেনারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পৌছলে ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ২৮টি পরিবারের সদস্য কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় নেন এবং ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান, ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ফজলী হােসেন, ড. রশিদুল হক, ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী প্রমুখ। এ ছাড়াও এসেছিলেন মাহবুব তালুকদার, এম এ হান্নান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদসহ অনেকে। এসব কারণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগী রাজাকার-চুক্র বিশেষ করে মুসলিম লীগপন্থি ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা ‘কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্স’ ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। দালালরা প্রচার চালায়, কুণ্ডেশ্বরীতে ভারতীয় সেনা ও অস্ত্র সমাবেশ হয়েছে এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কুণ্ডেশ্বরী ভবন নিরাপদ নয় জানতে পেরে শিক্ষক পরিবার ও অন্যরা ১০ এপ্রিলের মধ্যে একে একে চলে যান সেখান থেকে কুণ্ডেশ্বরীতে আক্রমণ হতে পারে জেনে শুভানুধ্যায়ীরা নূতনচন্দ্রকে এলাকা ছাড়ার জন্য অনুরােধ জানান। কিন্তু তার জবাব ছিল, “আমি তাে কারও ক্ষতি করিনি। জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি।
এই শেষ বয়সে নিজের দেশ, মাটি আর আরাধ্য দেবী কুণ্ডেশ্বরীকে ফেলে কোথাও যাব না। যদি মরতে হয় এখানেই মরব। এখানে যদি মৃত্যু হয়, তাহলে জানব এটাই মায়ের ইচ্ছা।” ১৩ এপ্রিল, সকাল প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানিদের দালাল রাজাকার চক্রের একটি দল কুণ্ডেশ্বরীতে হামলা চালায়। এ সময় কুণ্ডেশ্বরী মাতৃমন্দিরের সামনে প্রার্থনায় বসেছিলেন নূতন সিংহ। প্রার্থনারত অবস্থা থেকেই তাকে ধরে এনে গুলি। করে হত্যা করা হয়। গুলি করে ও গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে ধ্বংস করা হয়। ‘কুণ্ডেশ্বরী ভবন-সংলগ্ন ওষুধ কারখানা ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলাে। পরে রাজাকার ও তাদের সহযােগীরা লুট করে নিয়ে যায় কুণ্ডেশ্বরীর সব অস্থাবর সম্পদ। জানা যায়, এদিন নূতনচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুরেন্দ্র বিজয় চৌধুরীসহ আশপাশের অন্তত ৪৩ জন নারী-পুরুষকেও হত্যা করা হয়।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা