You dont have javascript enabled! Please enable it! বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া - সংগ্রামের নোটবুক
বাগ্মীশ্বর বড়ুয়া
বাগীশ্বর বড়ুয়া ছিলেন চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের নেতা ও মহান বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের অনুসারী। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামে। তিনি ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তার বাল্যনাম ছিল ‘শশাংক বিমল বড়ুয়া। বাগীশ্বর তার মামাতাে ভাই রুহিনী বড়ুয়ার মাধ্যমে সূর্যসেনের বিপ্লবী দলে যােগ দিয়েছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে কিশাের বয়সেই তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার নির্যাতিত হন। একবার তার হাতের আঙুলের নখে সুঁচ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ১৯৩২ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে লাল তালিকাভুক্ত অপরাধী হিসাবে ঘােষণা করে। ১৯৩৫ সালে তাঁর ভাই রুহিনী বড়ুয়ার ফাসির খবর শােনার পর বাগ্মীশ্বর মানসিকভাবে খুবই আঘাত পান এবং গােপনে বিপ্লবী কাজ চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতা চলে যান। গােপনে বিপ্লবী কাজ পরিচালনার জন্য তিনি ত্রি-চীবর বা গেরুয়া বেশ গ্রহণ করেন। এ সময় তার নাম হয় ‘বঙ্গীশ ভিক্ষু।  বাগীশ্বর ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে আই. এ. পাস করেন। বাগ্মীশ্বর ১৯৪১ সালে পালি সূত্র বিশারদ উপাধি পান। তিনি ১৯৪৬ সালে বি, এ. এবং ১৯৬১ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বি. এড, পাস করেন। ১৯৪৯ সালে বাগীশ্বর এবং বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরাে মিলে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় ‘বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ’ গড়ে তােলেন। বাগীশ্বর ওই সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলনে বাগীশ্বর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৫৪ সালে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত ‘ষষ্ঠ সংখ্যায়না’তেও তিনি একজন প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ভারতে, ১৯৫৯ সালে জাপানে এবং ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। বাগ্মীশ্বর বড়য়া ঢাকার কমলাপুরে জাতীয় বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন।  বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল শুরু হলে ১৯৬০ সালের শেষের দিকে বাগ্মীশ্বর মর্মাহত হন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে স্বার্থপরতা এবং রেষারেষির কারণে অত্যন্ত মনােকষ্ট নিয়ে তিনি ত্রি-চীবর ত্যাগ করেন। পরে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। তিনি চন্দ্রঘােনা নারাণগিরি পাইলট হাই স্কুল, চট্টগ্রামের কাটিরহাট হাই স্কুল, সফরভাটা উচ্চ বিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলেও তিনি কিছুদিন পালি শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। বাগীশ্বর চট্টগ্রাম রেঞ্জের স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ে যােগ দেন। ১৯৬৯ সাল থেকেই বাগ্মীশ্বর স্বাধীনতার পক্ষে তৎপর ছিলেন। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার শামসুল হক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযােদ্ধা রশিদ আহম্মদ চৌধুরী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৭১ সালের অসহযােগ আন্দোলনের সময় থেকে তারা একসাথে কাজ করা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে কাপ্তাইতে এক বিরাট মশাল মিছিল বের হয়, যার নেতৃত্বে বাগীশ্বরও ছিলেন। তাদের পরামর্শে অবাঙালিদের হামলা ঠেকাতে কলােনিতে প্রতি রাতে পাহারা বসানাে হয়।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকবাহিনী কাপ্তাইয়ে ঢোকে। বিপদের আশঙ্কা থাকলেও তখন কাপ্তাই থেকে বের হওয়ার কোনাে উপায় ছিল না। ২০ মে বাগীশ্বর। তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানেও তিনি গ্রামের যুবক-তরুণদের সাথে নিয়ে বৈঠক করেন। ১৩ জুন বাগ্মীশ্বর কাপ্তাইয়ের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাগীশ্বরের কোনাে খোঁজ পাননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জানা যায়, কাপ্তাইয়ের শান্তি কমিটির সদস্যরা বাগীশ্বর বড়ুয়াকে পকিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। শহীদ বাগ্মীশ্বর বড়ুয়ার স্ত্রীর নাম সবিতা বড়ুয়া। শহীদ বাগীশ্বরের নামে কাপ্তাইতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ –  আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা