মধুসূদন ধর
মধুসূদন ধরের জন্ম ময়মনসিংহের গৌরীপুরে । তার পারিবারিক নাম ছিল ‘হীরেন্দ্র চন্দ্র ধর’ । কিন্তু রাজনৈতিক কারণে একসময় তিনি মধুসূদন ধর নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। সবাই তাকে চিনতেন ‘মধুদা’ নামে। গৌরীপুর শহরে তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। মধুসূদন ধর স্কুল জীবন থেকেই ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ করতেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যখন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে এসেছিলেন, তখন তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন কিশাের মধুসূদন। তিনি ফুটবল এবং ক্রিকেট ভালাে। খেলতেন। তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়া সংগঠক এবং একজন রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন, যদিও সাংসারিক ভাবনা তার একেবারেই ছিল না। তাঁর স্ত্রীর চাকরির আয়ে আর কৃষিজমির আয়ে সংসার চলত। রাজনীতিতে ভিন্নমত সত্ত্বেও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রায় ৭৫ জন কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজন। তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মধুসূদন সাধ্যমতাে চেষ্টা করেছেন সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে। বাড়ির পিছনে তিনি বাঙ্কার খুড়েছিলেন, বিপদে মেয়েরা যাতে আশ্রয় নিতে পারে। এত মানুষ বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ায় বিষয়টি সহজেই রাজাকারদের নজরে পড়ে যায়।
এ সময়ই একদিন তার বাড়িতে রাজাকাররা ডাকাতির উদ্দেশ্যে হানা দেয়। আশ্রিত একজন আত্মীয়কে রাজাকাররা বল্লম দিয়ে আঘাত করে। তিনি আহত হয়েও ওই ডাকাতকে পাল্টা আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারপরের দিনও ডাকাতরূপী রাজাকাররা হানা দেয়। তারও একদিন পর ১৯৭১ সালের ১৬ মে। সকালে লােকজন পাকবাহিনীকে আসতে দেখে যে যার মতাে দৌড়ে পালায়। কয়েকজন পুলিশ সাথে নিয়ে পাকবাহিনী এসে মধুসূদন ধরের খোঁজ করে। মধুসূদন বেরিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেন। তার পরনে তখন লুঙ্গি আর শার্ট। এ অবস্থাতেই পাকবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। মধুসূদনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার স্ত্রী আর বাড়ির পুরনাে কাজের লােক পাঞ্জর দৌড়ে গিয়েছিলেন গৌরীপুর থানায়। কিন্তু সেখানে মধুসূদন ছিলেন না, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রেল স্টেশনে। পাঞ্জর দৌড়ে রেল স্টেশনে যান। তখনও ট্রেন স্টেশনে। দাড়িয়ে। মধুসূদন পাঞ্জরকে দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “পাঞ্জর ভাই, খিদে পেয়েছে খুব।” এক টুকরাে রুটির জন্য স্টেশনের এমাথা-ওমাথা করেও এনে দিতে পারেননি পাঞ্জর। এরপর থেকে মধুসূদন ধরের আর কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। শহীদ মধুসূদন ধর ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই ছিলেন নেতাজী সুভাষ বসুর গড়া “আজাদ হিন্দ ফৌজের সক্রিয় সদস্য। ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়েই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালােবাসা গড়ে ওঠে। মধুসূদন ধরের স্ত্রীর বাবা ছিলেন জমিদারগােত্রীয়, অঢেল সম্পত্তির মালিক। দেশভাগের সময় তিনি সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। সে সময় মধুসূদন তাকে একটি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন তিনি কেন দেশ ছাড়বেন না। তার টানেই ওই তরুণী পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে আসেন বাংলাদেশে, বিয়ে করেন মধুসূদন ধরকে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এসব শুনে অনেকেই এসে মধুসূদনকে বলেছিলেন, “দাদা, চলে যান ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তিনি সেসব কথা শােনেননি। অনেকে বলেছিলেন, “দাদা, মেয়েটা আপনার বড়, ওকে নিয়ে বিপদ হতে পারে। তিনি তখন বলেছিলেন, “মেয়ে জন্ম দিতে পেরেছি, বিষ খাইয়ে মেরেও ফেলতে পারব, তবুও দেশ ছাড়ব না।” মধুসূদন ধরের ছােট মেয়ে সুপ্রীতি ধর দুঃখ করে বলেছেন, “স্বাধীন দেশের ঘৃণ্য রাজনীতিতে বাবা ‘শহীদের মর্যাদা পেলেন না। মা বেঁচে থাকতে খুব চেয়েছিলেন, বাবা যেন অন্তত শহীদের মর্যাদাটুকু পায়! কোনাে সুবিধা চায়নি কোনােদিন।” শহীদ মধুসূদন ধরের স্ত্রী ছিলেন অসম্ভব স্বাধীনচেতা, ১৯৬৫ সাল থেকেই তিনি চাকরি করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই চাকরিকে সম্বল করেই চার ছেলেমেয়েকে তিনি বড় করেছেন।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ – আলী মাে. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা